একুশে প্রতিবেদক : চট্টগ্রামের সাগরিকা বিসিক শিল্প এলাকায় অবস্থিত সিলভার ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের একটি ছোট কারখানাকে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এক হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। আবার ঋণের জামানত হিসেবে যে জমি দেখানো হয়েছে তার মৌজা মূল্য মাত্র সাড়ে তিন কোটি টাকা এবং দলিলও ভুয়া।
কারখানাটির আকার ও উৎপাদন ক্ষমতা খুবই সীমিত, যা এক হাজার কোটি টাকা ঋণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। স্থানীয়রাও এই বিপুল পরিমাণ ঋণের খবরে বিস্মিত।
নথিপত্র থেকে জানা যায়, গত বছর মাত্র দেড় মাসের মধ্যে ‘বাই মুরাবাহা’ পদ্ধতিতে ৮৫০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। বাকি ১৫০ কোটি টাকা ছিল নন-ফান্ডেড বিনিয়োগ সীমা। বর্তমানে মুনাফা-আসলে এই ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯২৬.৫৫ কোটি টাকায়।
জানা যায়, সিলভার ফুডের ইসলামী ব্যাংকে কোনো পণ্য আমদানির রেকর্ড নেই। ঋণের জামানত হিসেবে তারা চট্টগ্রামের কারখানার ভবন ও দুটি প্লট এবং নারায়ণগঞ্জের ৪৭২ শতক জমি দেখিয়েছে, যার মূল্য ১০৯ কোটি টাকা বলে দাবি করা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের যে জমি বন্ধক রাখা হয়েছে, তা আসলে নাল শ্রেণির। এই ধরনের জমির সর্বোচ্চ মৌজা মূল্য প্রতি শতক ৭৫ হাজার ৫০০ টাকা হলেও, ব্যাংকে এর দলিল মূল্য দেখানো হয়েছে ১৫ কোটি ৭৪ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রকৃত মৌজা মূল্য মাত্র ৩ কোটি ৫৬ লাখ ৩৬ হাজার টাকা।
ঋণ মঞ্জুরিপত্রে কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে মো. মামুনুর রশিদ এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মেহেদি হাসানের নাম উল্লেখ রয়েছে। তবে আশ্চর্যজনকভাবে, তাদের টিআইএন নিবন্ধন হয়েছে ২০২৩ সালের ৩ এপ্রিল, অথচ তারও পাঁচ মাস আগে ২০২২ সালের ৭ নভেম্বর ইসলামী ব্যাংক তাদের নামে হাজার কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দিয়েছে।
মামুনুর রশিদের বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়ায় এবং মেহেদির ঢাকার সবুজবাগে। তবে কারখানায় পটিয়ার কর্মীদের প্রাধান্য লক্ষ্য করা গেছে, অন্যরা কিছুটা কোণঠাসা বলে দাবি করেন।
নথিপত্রে সিলভার ফুডের ঠিকানা হিসেবে চট্টগ্রাম নগরীর খাতুনগঞ্জের ৩৪৭ জিলানী টাওয়ার উল্লেখ থাকলেও, সরেজমিনে সেখানে প্রতিষ্ঠানটির কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও এই প্রতিষ্ঠান বা এর চেয়ারম্যান মামুনুর রশিদ সম্পর্কে কিছুই জানেন না।
পরে হামিদুল্লাহ মিয়া মসজিদ সংলগ্ন একটি ভবনে সিলভার ফুডের একটি সাইনবোর্ড দেখা যায়। চতুর্থ তলায় প্রতিষ্ঠানটির একটি ছোট, আঁটসাঁট কার্যালয় রয়েছে, যা বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকে।
সিলভার ফুডের ব্যবসার ধরন হলো আটা, ময়দা ও সুজি উৎপাদন ও বিক্রি। ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে মামুনুর রশিদ আগের মালিক ফরিদ আহমেদের কাছ থেকে ১৮ কোটি টাকায় কারখানাটি কিনে নেন।
কারখানার কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মালিকানা পরিবর্তনের আগে কারখানায় প্রতিদিন গড়ে ১৬০ টন আটা, ময়দা ও সুজি উৎপাদন হতো, যা এখন অর্ধেকে নেমে এসেছে।
আটা-ময়দার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা জানান, স্থানীয় বাজার থেকে গম কিনে আটা-ময়দা উৎপাদন করতে এ ধরনের কারখানায় সর্বোচ্চ ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ প্রয়োজন, এমনকি যদি প্রতিদিন দেড় শ টন উৎপাদন করা হয় তবুও।
ইসলামী ব্যাংকের আন্দরকিল্লা শাখার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন ছাড়া এ ধরনের বড় ঋণ দেওয়া সম্ভব নয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে প্রধান কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন তারা।
তবে, ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ মুনিরুল মওলার বক্তব্য জানতে একাধিকবার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন মনে করেন, ইসলামী ব্যাংকে এস আলম গ্রুপের মালিকানা প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ব্যাংকটির দুরবস্থা শুরু হয়। তিনি বলেন, নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ দেওয়া হয়েছে এবং এসব ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতি অনুসরণ করা হয়নি।
তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠিত ব্যাংক কমিশন জালিয়াতির মাধ্যমে দেওয়া ভুয়া ঋণ এবং অর্থপাচারের প্রকৃত চিত্র উন্মোচন করবে। কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে এসব অনিয়মের প্রকৃত চিত্র সামনে আসবে বলে তিনি মনে করেন।
পটিয়ার স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সিলভার ফুডের চেয়ারম্যান মামুনুর রশিদ দীর্ঘদিন সৌদি আরবে থাকার পর প্রায় এক যুগ আগে দেশে ফিরে আসেন। তিনি একসময় পটিয়ায় ছোট ব্যবসা করলেও বর্তমানে একটি বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত বলে গুঞ্জন রয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঋণের জামানত হিসেবে যে জমি দেখানো হয়েছে, তা আসলে বাংলাদেশ পুলিশ অফিসার্স বহুমুখী সমবায় সমিতির মালিকানাধীন। দুই ব্যক্তি সমিতির কাছ থেকে জমিটি কিনে পরে সিলভার ফুডের কাছে বিক্রি করেন। ধারণা করা হচ্ছে, ঋণ পেতে ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঋণগ্রহীতাদের যোগসাজশে ভুয়া দলিল তৈরি করা হয়েছিল।
সিলভার ফুডের এক কর্মচারী জানান, সিলভার ফুড স্থানীয় বাজার থেকে কাঁচামাল কিনলেও, তারা বিদেশ থেকে আমদানি করে বলে প্রচার করে এবং ভুয়া বিল দেখিয়ে ঋণ নেয়।
এ বিষয়ে মামুনুর রশিদের বক্তব্য জানতে চেষ্টা করা হলেও তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।