‘আবার তোরা মানুষ হ’: একজন সাবেক শিক্ষকের বেদনা


মো. আনোয়ার হোসেন (শামীম আনোয়ার) : অনেকেই জানেন না, বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে যোগ দেওয়ার আগে আমি বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে সরকারি কলেজের শিক্ষক হিসেবে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলাম। এটি আমার এমনই প্রিয় জায়গা যে, বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে আসার পর যখন রাজশাহীর সারদায় ট্রেনিং করতে গেলাম, তখন প্রায় রাতে আমি স্বপ্ন দেখতাম—আমি ক্লাসে পড়াচ্ছি। ক্লাসভর্তি একদল সদ্যকৈশোরোত্তীর্ণ ছেলেমেয়ে ঘুমঘুম চোখে আমার লেকচার শুনছে। এটি আমার খুব প্রিয় স্বপ্নগুলোরও একটি, যা আমি এখনো মাঝেমধ্যে দেখি, এবং সম্ভবত বাকি জীবনেও আরও অসংখ্যবার দেখব। আরেকটি বিষয় আমি খেয়াল করেছি, যে রাতে এই স্বপ্নটা আসে, তার পরদিনটা আমার ভীষণ ভালো যায়। মনমেজাজ থাকে ভীষণ ফুরফুরে।

শিক্ষকতা পেশার প্রতি আমার একাত্মতা এতটাই যে, যখন দেখি সরকার শিক্ষকদের কল্যাণে ইতিবাচক কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে অথবা কোথাও কোনো শিক্ষক সম্মানিত হয়েছেন, আমি অন্তরে-বাহিরে খুব উৎফুল্ল অনুভব করি। ব্যক্তিগত এই অনুভূতির কথা আমি আশেপাশের কারও কাছ থেকে লুকাতেও চাই না। বিপরীতক্রমে যদি কোথাও দেখি কোনো শিক্ষকের অন্যায়, অন্যায্যতা, অপ্রাপ্তি, অসম্মান, খুব কষ্ট লাগে। মনে হয় সেটা আমার সাথেই ঘটছে।

গতকাল ফেসবুক নাকি ইউটিউবে যেন দেখলাম, কোনো একটা স্কুলের কিশোর ছাত্ররা তাদেরই এক শিক্ষককে মারছে। যে যেভাবে পারছে আঘাত করার চেষ্টা করছে। যে শিক্ষক একজন শিক্ষার্থীর অন্তর্জগতকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করায়, তাকে গড়েপিটে মানুষ করার মহান দায়িত্ব পালন করায় নিরত, তাকেই করা হচ্ছে শারীরিক আঘাত! কেন, কী প্রেক্ষাপটে এটি করা হচ্ছে—সে পর্যন্ত যেতেও পারিনি। সত্যি কথা এ দৃশ্য বেশিক্ষণ সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। শেষ না করেই ভিডিও থেকে বের হয়ে গিয়েছিলাম।

এটা অস্বীকার করা যায় না যে, সব শিক্ষক এক নয়। এ পেশায় ভিকারুননিসা স্কুলের পরিমল জয়ধরের মতো অপ-শিক্ষক যেমন আছেন, তেমনি আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগে আমার শিক্ষক নাজিম উদ্দিন স্যারের মতো মহান হৃদয়ের মানুষেরাও। আমি জানি ক্ষমতার পদলেহী অপ-শিক্ষকদের কাছে প্রকৃত নীতিবান শিক্ষকেরা বেশিরভাগ সময় কোণঠাসা থাকেন। এসব অপ-শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রদের ক্ষোভের প্রকাশও বিভিন্ন সময় দেখা যায়। কিন্তু দায়িত্ব-ত্যাগ কিংবা অন্য যেকোনো উদ্দেশ্যেই হোক, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানকারী একজন শিক্ষককে শিক্ষায়তনের চৌহদ্দির মধ্যেই হেনস্তা করা, ক্ষেত্রান্তরে গায়ে হাত দেওয়া বা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা কোনো বিবেচনাতেই কি গ্রহণযোগ্য?

অপ-শিক্ষকদের মধ্যে যারা প্রশাসনিক পদসমূহে জাঁকিয়ে বসে আছে, তাদের পশ্চাদ্দেশ অবশ্যই চেয়ার থেকে বিযুক্ত করতে হবে, পদ থেকে সরাতে হবে। কিন্তু সেটা হতে হবে প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এক অন্যায়কারীকে সরাতে যেয়ে যেন আরেক অনাচারের উদাহরণ সৃষ্টি না হয়ে যায়। অনুরূপ শিক্ষক লাঞ্ছনা অতীতেও বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের তরফে হয়েছে—বহুবার। এর পুনরাবৃত্তি করার আগে মনে রাখতে হবে এসব দুঃখজনক ঘটনাই কিন্তু ক্ষুদ্রক্ষুদ্র বালিকণার মতো করে মহান ৫ আগস্টের বেদী নির্মাণ করে দিয়েছিল। পুরাতন পঁচাগলা অতীত নতুন স্বাধীন বাংলাদেশের চেতনার সঙ্গে যায় কি?

আজকের জনগণের সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলি, ছাত্র-সমন্বয়কসহ যাঁরা বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে নিয়োজিত রয়েছেন, তাঁরা বারবার নিষেধ করার পরও, তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও চক্ষুপীড়াদায়ক এসব দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে! তবে কি শিক্ষক লাঞ্ছনার কালিমা লেপন করার মাধ্যমে জনগণের সরকারের পক্ষে থাকা সর্বব্যাপী সমর্থন ও জনমতের পালে বিপরীতমুখী হাওয়া দিতে কোনো একটি মহল খুব সচেতনভাবে কাজ করে চলেছে? নাকি এটি জনগণের নৈরাশ্যবাদী অংশের ‘এমন স্বাধীনতাই কি চেয়েছিলাম’—এর যে বয়ান; তাকে শক্তিশালী করারই পরোক্ষ প্রয়াস?

সরকার বাহাদুরের নিকট নগন্য এক সাবেক শিক্ষকের সবিনয় আরজ: প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা পদলেহী অপশিক্ষকদের প্রয়োজনে দ্রুত পদচ্যুত করুন। কিন্তু শ্রেণিকক্ষে পাঠদানকারী একজন শিক্ষাগুরুকে তারই ছাত্রছাত্রী কর্তৃক লাঞ্ছনা বন্ধে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। শিক্ষককে সর্বোচ্চ সম্মান দিন। শিক্ষকেরা সম্মান পেলে দিনশেষে সম্মানিত হয় গোটা জাতি।

যে শিক্ষার্থী, যেকোনো অজুহাতেই হোক, তাকে জ্ঞানের আলো বিতরণকারী নিজের শিক্ষাগুরুর গায়ে হাত তোলার মানসিকতা ধারণ করে, আবার অন্যদের নিকট সেটার অনুপঙ্খ বর্ণনা দিয়ে ফেটে পড়ে বিকৃত উল্লাসে, সে পড়ালেখা করে ডিগ্রির বহরের মালিক হতে পারলেও একজন ‘মানুষ’ হতে পেরেছে কি? বাচ্চাদের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। শুধু চাই, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, জজ, ব্যারিস্টার হওয়ার আগে আমাদের আত্মজেরা যেন মানুষ হয়। গুণী নির্মাতা খান আতাউর রহমানের বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘আবার তোরা মানুষ হ’ এর সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে চাই যেন প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।

শিক্ষায়তনের ভেতর-বাইরে নিশ্চিত হোক শিক্ষকের সম্মান।

লেখক : মো. আনোয়ার হোসেন (শামীম আনোয়ার)
স্কোয়াড কমান্ডার, বান্দরবান র‍্যাব ক্যাম্প।