স্থানীয় সরকার: সংকট থেকে উত্তরণের পথ


নজরুল কবির দীপু : দেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা বর্তমানে যে গুরুতর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য একটি গভীর উদ্বেগের বিষয়। দেশের বিভিন্ন স্তরের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা পলাতক অথবা আত্মগোপনে থাকায় স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। এই অবস্থা সামাল দিতে সরকার যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তা কিছুটা জরুরি ব্যবস্থা হলেও দীর্ঘমেয়াদী সমাধান নয়।

যেমন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রশাসক নিয়োগের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এটি সরকারি কর্মকর্তাদের কার্যক্ষমতা হ্রাস করতে পারে। সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রে প্রশাসক নিয়োগের জন্য আইনের বিভিন্ন ধারার ব্যাখ্যা নিয়ে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে।

এই অবস্থায় পলাতক বা অনুপস্থিত স্থানীয় সরকার নেতাদের উপস্থিত হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করে নোটিশ জারি করা যেতে পারে। সময়সীমার মধ্যে উপস্থিত না হলে তাদের পদ শূন্য ঘোষণা করা যেতে পারে। প্রয়োজনে উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও নেওয়া যেতে পারে। এছাড়া উপস্থিত জনপ্রতিনিধিরা তাদের মধ্য থেকে একজনকে অস্থায়ীভাবে মেয়র বা সভাপতি নির্বাচিত করে কাজ চালাতে পারেন। সরকারি কর্মকর্তারা তাদের সহযোগিতা করবেন।

আবার শূন্য পদে উপনির্বাচন এবং মেয়াদ পূর্ণ হলে নতুন নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী ও দায়িত্বশীল করার জন্য একটি বিস্তৃত সংস্কার কর্মসূচি হাতে নেওয়া উচিত। স্থানীয় সরকার সংস্কারের জন্য একটি নতুন আইন প্রণয়ন করাও জরুরি।

স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা বর্তমানে যে সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য সুনির্দিষ্ট ও দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। এই সংকট সমাধানে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।

প্রথমত, নাগরিক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি। স্থানীয় সরকারের গুরুত্ব ও বর্তমান সংকটের প্রভাব সম্পর্কে নাগরিকদের সচেতন করা, সুশাসন, দুর্নীতি দমন এবং স্থানীয় উন্নয়নে জনসাধারণের অংশগ্রহণের জন্য জনমত গঠন করা এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর সাথে সহযোগিতা করা এই প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ।

দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে স্থানীয় সরকারের কাজকে আরও স্বচ্ছ ও দক্ষ করা যেতে পারে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে স্থানীয় সরকারের সিদ্ধান্ত ও কার্যকলাপ জনসাধারণের কাছে প্রকাশ করা এবং ই-পারদর্শিতা নিশ্চিত করে দুর্নীতি দমন করা যেতে পারে।

তৃতীয়ত, অন্যান্য দেশের সফল স্থানীয় সরকার মডেলগুলো অধ্যয়ন করে এবং বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনা করে সেরা অনুশীলনগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাথে সহযোগিতা করে প্রয়োজনীয় সহায়তা গ্রহণ করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।

চতুর্থত, স্থানীয় সরকার সংকটের স্থায়ী সমাধানের জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় সংস্কার করা এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী করা এই পরিকল্পনার মূল উপাদান হতে পারে।

পঞ্চমত, নাগরিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি। স্থানীয় সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে নাগরিকদের সরাসরি ভোটাধিকার দেওয়া, বাজেট প্রণয়নে নাগরিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং জন শুনানির মাধ্যমে নাগরিকদের মতামত গ্রহণ করা এই প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ।

ষষ্ঠত, দুর্নীতি দমন করা জরুরি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার নীতি গ্রহণ করা, দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত করা এবং দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা এই প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ।

সর্বশেষ, স্থানীয় সরকারের সকল তথ্য জনসাধারণের কাছে প্রকাশ করা এবং স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। নাগরিকদের অভিযোগের বিষয়ে দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করাও গুরুত্বপূর্ণ।

দেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার সংকট সমাধানের জন্য একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। উপরোক্ত পরামর্শগুলোকে বিবেচনা করে একটি সুষম ও কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে।

বর্তমানে দেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা যে সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য সরকারকে সুনির্দিষ্ট ও দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে এবং স্থানীয় সরকারকে আরও শক্তিশালী ও দায়িত্বশীল করতে হবে।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।