বুধবার, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১

সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা ও সমমর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে

| প্রকাশিতঃ ১৫ অগাস্ট ২০২৪ | ৯:৩৭ পূর্বাহ্ন


নজরুল কবির দীপু : অস্বীকার করার উপায় নেই, ৫ আগস্টের ক্ষমতা হস্তান্তরের পর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং উপাসনালয়গুলোতে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। সেনাপ্রধান নিজেই স্বীকার করেছেন যে ২০টি জেলায় ৩২টি স্থানে সংখ্যালঘুদের লক্ষ্য করে কিছু বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটেছে।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, ৫০টিরও বেশি জেলায় শত শত হামলার ঘটনা ঘটেছে। এই হামলার নেপথ্যে কারা জড়িত, কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এসব ঘটনার পেছনে কাজ করেছে, তা নিয়ে বিতর্কের চেয়েও বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

রাজনৈতিক পরিবর্তন বা সংকটের সময়ে, ধর্মীয় বা জাতিগত সংখ্যালঘুরা প্রায়শই আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। আগে এমন পরিস্থিতিতে তারা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতেন, অনেকে দেশ ছেড়ে চলে যেতেন। কিন্তু এবার তারা ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছেন।

শুরু থেকেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ সবাই প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন। তাদের নেতারা আট দফা দাবি তুলে ধরে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, হামলা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত তাদের প্রতিবাদ অব্যাহত থাকবে। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে তারা আপাতত তাদের কর্মসূচি স্থগিত রেখেছেন।

প্রধান উপদেষ্টা শুধু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, তিনি ঢাকেশ্বরী মন্দিরও পরিদর্শন করেছেন এবং সেখানে সকলের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেছেন। তিনি সকল ধর্ম ও গোত্রের মধ্যকার পার্থক্য ভুলে গিয়ে বাংলাদেশের সকল নাগরিককে একই পরিবারের সদস্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

অন্য দেশে সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্য বা নির্যাতনের ঘটনা বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের প্রতি যেকোনো ধরনের হামলার ন্যায্যতা দিতে পারে না। আমরা যেমন বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার, তেমনি আমাদের দেশেও যেন এমন ঘটনা না ঘটে সে ব্যাপারে সচেতন থাকা আমাদের কর্তব্য।

অনেকে মনে করছেন যে সংখ্যালঘুদের ওপর সাম্প্রতিক হামলার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। তবে আমাদের দৃষ্টিতে, আওয়ামী লীগ সরকার তাদের বিরোধীদের যেভাবে দমন করেছে, তার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ক্ষমতা পরিবর্তনের সময় সংখ্যালঘু বা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, কারও ওপরই হামলা চালানোর কোনো অধিকার কারও নেই।

যদি কেউ অন্যায় করে, তাহলে আইনের মাধ্যমেই তার প্রতিকার পাওয়া উচিত। আমরা আশা করি, সরকার এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইনি সহায়তা প্রদান করবে। কারোরই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার নেই।

সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার মতো দুঃখজনক ঘটনার মধ্যেও এবার একটি ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে – সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় আর নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকায় সীমাবদ্ধ নেই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, সবাই সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর এবং উপাসনালয় রক্ষায় এগিয়ে এসেছে। হিন্দু প্রতিবেশীদের খোঁজখবর নিয়েছে।

এমনকি ইসলামী রাজনৈতিক দলের সদস্যরাও এই প্রচেষ্টায় অংশ নিয়েছে, রাত জেগে মন্দির পাহারা এবং হিন্দুপাড়াগুলোতে টহল দিচ্ছে, যা অবশ্যই আশাব্যঞ্জক। কোনো দেশেই কেবল আইন দিয়ে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়; সামাজিক সম্প্রীতি এবং নাগরিক সুরক্ষার জন্য সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের এগিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরি।

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অভিযোগ, তাদের উপর অতীতে যে সব হামলা ও নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে, কোনো সরকারই তার বিচার বা প্রতিকার করেনি। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রীয় সংস্কারের প্রতিশ্রুতি নিয়ে এসেছে।

আমরা আশাবাদী যে, তিনি ধর্ম, জাতি বা সম্প্রদায়ের সকল প্রকার ভেদাভেদ দূরীকরণের প্রচেষ্টা চালাবেন এবং সমাজের প্রতিটি মানুষকে একই পরিবারের সদস্য হিসেবে দেখার মানসিকতা প্রতিষ্ঠা করবেন। প্রতিটি ঘটনার নিরপেক্ষ ও ন্যায়সঙ্গত তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করার ব্যাপারেও তিনি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।

এছাড়াও, রাষ্ট্রের দায়িত্ব হবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আইনগত সুরক্ষা এবং সমাজের সর্বস্তরে তাদের সমমর্যাদা নিশ্চিত করা।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।