শরীফুল রুকন : আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার, ড. মুহাম্মদ ইউনূস! তিনি শুধু একজন অর্থনীতিবিদ নন, তিনি একজন যোদ্ধা, যিনি দারিদ্রের বিরুদ্ধে লড়েছেন, স্বপ্ন দেখেছেন এক সমৃদ্ধ বাংলাদেশের। গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে তিনি ক্ষুদ্রঋণের আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন, যা আজ আলোকিত করেছে কোটি কোটি দরিদ্র মানুষের জীবন।
নোবেল শান্তি পুরস্কার জয় করে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য শুধু যুদ্ধ নয়, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতাও কত জরুরি। তিনি বিশ্বকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, দরিদ্র মানুষের হাতে সামান্য অর্থ তুলে দিলেই তারা কতটা অসাধ্য সাধন করতে পারেন।
এখন তিনি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হতে যাচ্ছেন। তাঁর এই নতুন ভূমিকায় আমরা আশা করি, তিনি আবারও দেশের জন্য কিছু একটা করে দেখাবেন, যা হবে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য এক অনন্য উপহার।
ড. ইউনুসের অর্জনের ঝুলি যেন শুধু বাড়তেই থাকে! বিশ্ব তাঁর মহান কাজকে শুধু স্বীকৃতিই দেয়নি, বরং বুকে জড়িয়ে নিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্বের পরাশক্তি, তাঁকে তাদের সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত করেছে। প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম, কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল- এই সম্মানগুলো কেবল তাঁর ব্যক্তিগত অর্জন নয়, এগুলো বাংলাদেশের জন্যও অপার গৌরব!
তিনি কিন্তু কখনোই থেমে থাকেননি! তাঁর সামাজিক ব্যবসার উদ্যোগ, যেন এক অন্যরকম বিপ্লব। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, ব্যবসা কেবল লাভের জন্য নয়, এটা হতে পারে সমাজের জন্য, মানুষের জন্য। তাঁর এই উদ্যোগ, দারিদ্র দূরীকরণের লড়াইয়ে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
একজন অধ্যাপক হিসেবেও তিনি ছিলেন অতুলনীয়। তাঁর বই, তাঁর লেখা, যেন আলোর পথ দেখায়। তিনি কেবল একজন অর্থনীতিবিদই নন, তিনি একজন দার্শনিক, একজন চিন্তাবিদ, যিনি আমাদের সমাজকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছেন। তাঁর এই অসাধারণ যাত্রা, আমাদের সকলের জন্য অনুপ্রেরণার এক অফুরন্ত উৎস!
ড. ইউনুসের জীবনের গল্পটা যেন একটা রূপকথার মতো! এক বাঙালি মুসলিম পরিবারের সন্তান, যার জন্ম হয়েছিল সবুজে ঘেরা এক গ্রামে। ছোট্ট মুহাম্মদ, যার শৈশব কেটেছে মাটির ঘ্রাণে, গ্রামের স্কুলের খোলা আকাশের নিচে। কে জানত, এই ছোট্ট ছেলেটি একদিন পৃথিবীকে বদলে দেবে!
পড়াশোনায় তিনি ছিলেন বড়ই মেধাবী। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষায় তিনি যে সাফল্য পেয়েছিলেন, তা ছিল সত্যিই অসাধারণ! তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে তিনি অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু তাঁর মনের কোণে সবসময় ছিল একটা স্বপ্ন, একটা অদম্য ইচ্ছা- কিছু একটা করে দেখাবেন, সমাজের জন্য, দেশের জন্য।
কিন্তু তাঁর জীবনে কেবল সাফল্যই ছিল না। ছোটবেলায় তাঁর মায়ের মানসিক অসুস্থতা, তাঁর পরিবারের জন্য ছিল এক কঠিন সময়। কিন্তু এই কষ্টই তাঁকে শিখিয়েছিল লড়তে, হার না মানতে। তাঁর জীবনের এই সব অভিজ্ঞতা, তাঁর মনকে করেছিল আরও দৃঢ়, আরও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আর এই প্রতিজ্ঞাই তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল সেই লক্ষ্যে, যেখানে তিনি সারা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছেন, অসাধ্য কিছুই নয়!
স্নাতক শেষ করেই যেন ড. ইউনুসের উড়ার পাখা গজিয়েছিল! অর্থনীতি ব্যুরোতে গবেষণা সহকারী হিসেবে যোগ দিয়ে তিনি যেন এক নতুন দিগন্তের সন্ধান পেয়েছিলেন। চট্টগ্রাম কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদান, তাঁর জীবনের এক অন্যরকম মোড়। কিন্তু তাঁর মনের ভিতর জ্বলছিল এক অদম্য আগুন, একটা স্বপ্ন যেন তাঁকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল আরও দূরে।
এবং সেই স্বপ্নের ডানা মেলে ধরল যখন তিনি ফুলব্রাইট স্কলারশিপ পেয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিলেন। ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে তিনি অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করলেন, তা ছিল তাঁর জীবনের এক অনন্য মাইলফলক। মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা, তাঁর জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।
এই সময়টাতে তিনি কেবল পড়াশোনাই করেননি, বরং জীবনকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর মনের ভিতর জমে থাকা স্বপ্নগুলোকে বাস্তবের রূপ দিতে তিনি কতটা ব্যাকুল ছিলেন, তা বোঝা যায় তাঁর প্রতিটি কাজে। এই অভিজ্ঞতাই তাঁকে তৈরি করেছিল সেই মহান মানুষ হিসেবে, যিনি পরবর্তীতে পৃথিবীকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন দারিদ্রতা দূরীকরণের এক নতুন পথ।
১৯৭১, বাংলাদেশের জন্য এক অগ্নিপরীক্ষার বছর। আর সেই বছর, মুক্তিযুদ্ধের আগুনে দেশ যখন জ্বলছে, তখন ড. ইউনূস দূর আমেরিকার মাটিতে বসে ছিলেন না। তাঁর হৃদয়েও জেগে উঠেছিল সেই একই আগুন, সেই একই স্বাধীনতার প্রত্যাশা। তিনি গড়ে তুললেন একটি নাগরিক কমিটি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য বিশ্বের দরবারে সোচ্চার হলেন। তাঁর ‘বাংলাদেশ নিউজলেটার’, যেন এক আলোর রশ্মি, যা অন্ধকারে আশার বাণী শোনাল।
যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে তিনি যোগ দিলেন সরকারের পরিকল্পনা কমিশনে। কিন্তু তাঁর মনের স্বপ্ন যেন আরও বড় কিছু চাইছিল। তাই তিনি ফিরে গেলেন শিক্ষকতার জগতে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তিনি শুধু একজন অধ্যাপকই ছিলেন না, ছিলেন একজন অনুপ্রেরণা, একজন পথপ্রদর্শক।
এই সময়টাতে তাঁর মনের ভেতর গড়ে উঠছিল এক নতুন স্বপ্ন, এক নতুন পরিকল্পনা। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, দেশের মানুষের আসল উন্নতির জন্য শুধু পরিকল্পনা নয়, প্রয়োজন বাস্তব কাজ। আর সেই বাস্তব কাজের সূচনা করতেই তিনি পরবর্তীতে গড়ে তুললেন গ্রামীণ ব্যাংক, যা বদলে দিল বাংলাদেশের অগণিত মানুষের জীবন।
১৯৭৪, বাংলাদেশের জন্য এক কঠিন সময়। দুর্ভিক্ষের কালো ছায়া যখন সারা দেশকে গ্রাস করেছিল, তখন ড. ইউনূসের মনে জেগে উঠল এক অদম্য লড়াইয়ের স্পৃহা। তিনি দেখলেন, দারিদ্র্যের কষাঘাতে মানুষ কতটা অসহায়। তাঁর মনের ভিতর তখন একটা প্রশ্ন জেগে উঠল- এই দুর্দশা থেকে মানুষকে মুক্ত করার উপায় কি?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই তিনি আবিষ্কার করলেন এক অভিনব সমাধান- ক্ষুদ্র ঋণ। তিনি বুঝলেন, ছোট্ট একটা ঋণ, একজন মানুষের জীবন পাল্টে দিতে পারে। তাঁর এই চিন্তাভাবনা থেকেই জন্ম নিল গ্রামীণ অর্থনৈতিক প্রকল্প, যা পরবর্তীতে গ্রামীণ ব্যাংকে রূপ নিল।
তবে তাঁর লড়াই শুধু দারিদ্র্যের বিরুদ্ধেই ছিল না। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নেও তিনি অবদান রেখেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে তিনি শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, পরিবেশ- সব ক্ষেত্রেই নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৭৬ সাল, বাংলাদেশের মাটিতে জন্ম নিল এক অনন্য স্বপ্নের নাম- গ্রামীণ ব্যাংক! ড. ইউনুসের হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা, সবটুকু আশা যেন ঢেলে দিয়েছিলেন এই ব্যাংকের ভিত গড়তে। তিনি জানতেন, দেশের দরিদ্র মানুষের হাতে যদি সামান্য কিছু টাকা তুলে দেওয়া যায়, তাহলেই তারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে। আর গ্রামীণ ব্যাংক সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিল!
লাখ লাখ মানুষের জীবন যেন আলোকিত হয়ে উঠল এই ব্যাংকের ছোঁয়ায়! ৫.৩ মিলিয়ন ঋণগ্রহীতা, ৫.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ- এই সংখ্যাগুলো কেবল পরিসংখ্যান নয়, এগুলো হলো অগণিত মানুষের স্বপ্ন, অগণিত পরিবারের আশা। গ্রামীণ ব্যাংকের ‘সংহতি দল’ পদ্ধতি, যেন এক সুন্দর বন্ধনের প্রতীক। একে অপরের হাত ধরে, একে অপরকে সাহায্য করে, মানুষ এগিয়ে গেল আত্ম-নির্ভরতার পথে।
গ্রামীণ ব্যাংকের সাফল্যের গল্প যেন এক অনুপ্রেরণার আলো ছড়িয়ে দিল সারা বিশ্বে। উন্নত দেশগুলোও তাকিয়ে রইল বিস্ময়ে, বাংলাদেশের এই অসাধারণ মডেলের দিকে। ড. ইউনুসের এই উদ্যোগ, কেবল বাংলাদেশকেই নয়, বরং সারা বিশ্বকে দেখিয়ে দিল দারিদ্র্য দূরীকরণের এক নতুন পথ।
২০০৬ সাল, এক অনন্য মুহূর্ত! গোটা বাংলাদেশ যেন থমকে গিয়েছিল, যখন ঘোষণা এলো- নোবেল শান্তি পুরস্কার, ড. মুহাম্মদ ইউনুস এবং তাঁর প্রাণের সন্তান গ্রামীণ ব্যাংকের জন্য! এ যেন এক স্বপ্নের মতো, এক অবিশ্বাস্য অর্জন! বাংলাদেশের মাটিতে জন্ম নেওয়া একজন মানুষ, যিনি সারা বিশ্বকে দেখিয়ে দিলেন দারিদ্র্যকে হারানোর এক নতুন পথ, তাঁকে বিশ্বের সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত করা হলো!
এই পুরস্কার, কেবল ড. ইউনুসের একার অর্জন নয়। এটা গোটা বাংলাদেশের গর্ব, গোটা জাতির জন্য এক অনন্য সম্মান। দেশের প্রতিটি মানুষের বুক যেন ফুলে উঠেছিল গর্বে, যখন তারা দেখলেন তাঁদের একজন ভাই, তাঁদের দেশের সন্তান, বিশ্বের সেরাদের মাঝে সেরা হয়ে উঠেছেন।
আর তাঁর অর্জনের ঝুলি যেন শুধু বাড়তেই থাকে! ৬২টি সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি, পৃথিবীর নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে! এ যেন এক অবিশ্বাস্য কীর্তি, এক অনন্য মাইলফলক! ড. ইউনুসের এই অসামান্য যাত্রা, তাঁর এই অক্লান্ত পরিশ্রম, আমাদের সকলের জন্য এক অনুপ্রেরণার অফুরন্ত উৎস!
কিন্তু, কী নির্মমতা! একজন মানুষ, যিনি সারা জীবন দেশের মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন, তাঁকে কিছুদিন আগে দোষী সাব্যস্ত করা হলো! শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ছয় মাসের কারাদণ্ড, আর ৩০ হাজার টাকা জরিমানা!
ড. ইউনুস, তিনি কী অপরাধ করেছিলেন? তিনি কি কাউকে ঠকিয়েছেন, কারও ক্ষতি করেছেন? না, তিনি তো শুধু মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁদের স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করেছিলেন। তবুও তাঁকে এই অপমান, এই অবিচার সহ্য করতে হয়েছে!
আদালতের রায় শুনে তাঁর চোখে যেন এক ফোঁটা পানিও ছিল না। তিনি শুধু বলেছেন, ‘যে দোষ আমরা করি নাই, সেই দোষের ওপরে শাস্তি পেলাম।’ তাঁর এই কথাগুলো যেন এক তীরের মতো বিঁধে গেল সবার হৃদয়ে।
কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। তাঁর আইনজীবীরা জামিন চেয়েছেন, আদালত তা মঞ্জুরও করেছে। এখন আশা আছে, একটা লড়াই বাকি আছে। ড. ইউনুসের এই লড়াই, কেবল তাঁর নিজের জন্য নয়, এটা গোটা জাতির লড়াই। তাঁর এই সংগ্রাম, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অবিচারের বিরুদ্ধে, আমাদের সকলকে অনুপ্রাণিত করুক, সাহস দিক!