তাণ্ডবের ক্ষত চট্টগ্রামের থানায় থানায়


শরীফুল রুকন : সহায়তার শেষ আশ্রয়স্থল, আইনের প্রতীক, সেই থানাই যখন নিষ্ঠুর হামলার শিকার হয়, তখন নিরাপত্তার ভিত কেঁপে ওঠে! চট্টগ্রামের আটটি থানা, যেখানে মানুষ ন্যায়বিচারের আশায় ছুটে আসত, আজ সেগুলো ধ্বংসের করুণ সাক্ষী।

নির্মম অগ্নিসংযোগে পুলিশের গাড়িগুলো কঙ্কালসার হয়ে পড়ে আছে। থানার ভেতরটা যেন এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের চিত্র – আসবাবপত্র পুড়ে ছাই, জরুরি নথিপত্র ছাই হয়ে গেছে। চুরমার হয়ে যাওয়া কাঁচের টুকরো, ভাঙা কমোড-বেসিন সব মিলে যেন এক বিধ্বস্ত সভ্যতার চিহ্ন।

পোড়া গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে। হামলার তাণ্ডব থেকে কোনোমতে প্রাণ বাঁচিয়ে পুলিশ সদস্যরা আজ শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। শূন্য থানাগুলো যেন নীরবে কাঁদছে, আজ সেখানে কারো পায়ের শব্দ নেই, শুধু নিঃশব্দ কান্না।

শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর গতকাল সোমবার চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন এলাকায় খণ্ড খণ্ড মিছিল বের করেন মানুষ। সন্ধ্যার আঁধার নামার আগেই, নগরীর বুকে নেমে এলো অমানিশার কালো ছায়া। বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যেই, দুষ্কৃতকারীদের হাতে অগ্নিসংযোগ, হামলা, ভাঙচুর আর লুটপাটের তাণ্ডবে নগরীর আটটি থানা ভবন পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। সারারাত ধরে চলে এই তাণ্ডব, পুলিশ সদস্যদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র, এমনকি ল্যাপটপ পর্যন্ত লুটে নেয় তারা। কী পরিমাণ অস্ত্র ও সম্পদ লুট হয়েছে, তার হিসেব রাখা সম্ভব হচ্ছে না, কারণ ধ্বংসস্তূপে পরিণত থানায় ঢোকাও দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে পুলিশের জন্য।

নগরের প্রাণকেন্দ্র, কোতোয়ালী মোড়। সেই কোতোয়ালী থানা এখন কালো অন্ধকারের এক বিভীষিকাময় প্রতিচ্ছবি। রাস্তা থেকেই চোখে পড়ে থানার সামনে আগুনের লেলিহান শিখায় ভস্মীভূত সাঁজোয়া যান, তার পাশে চারটি পিকআপ যেন নির্বাক আর্তনাদ করছে। একটু দূরে ছয়টি কার, মাইক্রোবাস, চারটি মোটরসাইকেল— সবই আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে ছাই।

থানার ভেতরে পা রাখতেই হাতের বাঁ পাশে যেখানে এক সময় অভ্যর্থনা কক্ষ ছিল, সেখানে এখন শুধু ছাই আর ছাই। ছাদের পলেস্তারা যেন কালো অশ্রু ঝরিয়ে পড়ছে। সিলিং ফ্যানটাও যেন আগুনের যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেছে। ওসির কক্ষের কাঁচ ভেঙে চুরমার, চারদিকে ছড়িয়ে আছে নির্মমতার ছাপ। হাজতখানাও যেন আগুনের কবলে পড়ে আর্তনাদ করছে।

এসআই ও এএসআইদের বসার কক্ষ এখন এক ভয়াবহ দৃশ্যের নীরব সাক্ষী। ভাঙা কাচ আর চেয়ার-টেবিল যেন চিৎকার করে বলছে, এখানে কী নির্মমতা চলেছে। মামলার কাগজপত্র, নথি— সবই এখন তছনছ, ছিন্নভিন্ন।

তৃতীয় তলায় উঠতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে আরও এক করুণ দৃশ্য। এসআই ও পুলিশ সদস্যদের থাকার ঘর এখন লুট হয়েছে, জিনিসপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। তাদের ব্যক্তিগত জীবনের স্মৃতি— সবই যেন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

গতকালের ভয়াবহতা এখনো চোখে ভাসছে। থানায় হামলার পর যখন সবাই নিজেদের বাঁচানোর তাগিদে ছুটছিলেন, তখনও আটকে ছিলেন দশজন পুলিশ সদস্য। সেই মুহূর্তে যেন আশার আলো দেখা দিলেন নগর বিএনপির সাবেক সদস্যসচিব আবুল হাশেম বক্কর এবং যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল মান্নান। তাদের সাহসী পদক্ষেপে যেন নতুন প্রাণ ফিরে পেল থানা।

আবুল হাশেম বক্করের কণ্ঠে শোনা গেল সেই ভয়ংকর অভিজ্ঞতার বর্ণনা। তিনি বললেন, ‘সন্ধ্যার দিকে যখন খবর পেলাম, তখনই ছুটে গেলাম থানায়। দেখি, চারদিকে আগুন আর আগুন। ভেতরে আটকে পড়া পুলিশ সদস্যদের মুখ দেখে বুকটা কেঁপে উঠল। তাদের বাঁচানো ছাড়া আর কিছুই মাথায় আসছিল না। অবশেষে তাদের উদ্ধার করে আনতে পেরেছি।’

প্রচুর লোকজনের ভিড়ের কারণে ফায়ার সার্ভিসও আগুন নিয়ন্ত্রণে অপারগতা প্রকাশ করল। কিন্তু আবুল হাশেম বক্করের আশ্বাসে তারা এগিয়ে এলেন। অবশেষে রাত আটটায় ফায়ার সার্ভিস এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনল।

কোতোয়ালী থানার সামনে বিক্ষোভকারীদের ক্ষোভের কথা অনেককে ভাবাবে। গায়েবি মামলা, রিমান্ডে নির্যাতন, জামিনের পরও টাকা দাবি— এসব যেন তাদের জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিয়েছে। শান্তির ঘুম তাদের চোখে নেই, সবসময় একটা আতঙ্ক তাদের পিছু ছাড়ে না।

কোতোয়ালীর মতোই পাহাড়তলী থানাও এখন এক ভয়াবহ স্মৃতির প্রতীক। থানার সামনের গাড়িগুলো যেন আগুনের লেলিহান শিখায় নিজেদের আর্তনাদ জানাচ্ছে। চারতলা থানা ভবন যেন এক নিষ্প্রাণ দেহ। ওসি, পরিদর্শক (তদন্ত), ডিউটি অফিসারের কক্ষ— সবই এখন ভাঙাচোরার শিকার। আসবাবপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে চারদিকে, যেন কাঁদছে নিজের দুর্ভাগ্যের জন্য।

আকবর শাহ থানাও রেহাই পায়নি। পুলিশের গাড়ি, থানার ভেতর— সবই ভাঙচুরের শিকার। ইপিজেড থানাও একই পরিণতির সম্মুখীন। পতেঙ্গা থানার অবস্থাও একই। গাড়ি, ওসির কক্ষ— সবই আগুনের কবলে পড়েছে। হালিশহর থানাও রেহাই পায়নি। গাড়িতে আগুন, ভাঙচুর, তাণ্ডব— পুরো থানা যেন এক রক্তক্ষরণের সাক্ষী।

হালিশহর থানার একজন কর্মকর্তার কণ্ঠে শোনা গেল সেই ভয়াবহতার বর্ণনা। তিনি বললেন, ‘হামলাকারীদের ঢল দেখে আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলাম প্রতিরোধ করতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেদের প্রাণ বাঁচাতেই থানা ছেড়ে পালাতে হয়েছে। তারা পুরো থানায় আগুন লাগিয়ে, ভাঙচুর চালিয়ে সব শেষ করে দিয়েছে। অনেক কিছু লুট করে নিয়ে গেছে।’

সদরঘাট থানা, যেখানে একসময় ন্যায়বিচারের আশায় মানুষ ভিড় জমাত, সেখানে এখন শুধু বিশৃঙ্খলার চিহ্ন। প্রধান ফটকের সামনে স্তূপ হয়ে আছে মামলার আলামত। ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে চারটি পুলিশের গাড়ি, যেন নির্যাতনের শিকার নিষ্প্রাণ দেহ।

ডবলমুরিং থানার অবস্থাও শোচনীয়। পাঁচটি গাড়ি ভাঙচুরের শিকার, পুরো থানা ভবন যেন এক যুদ্ধক্ষেত্র। আজ দুপুর থেকে মূল ফটকে চেয়ার-টেবিল দিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছে, যেন কেউ আর ভেতরে যেতে না পারেন।

মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের কণ্ঠে শোনা যায় এক অসহায়ত্বের সুর। তারা বলছেন, তারা শুধু আদেশ পালন করেছেন। কিন্তু এখন তারাই হামলার শিকার। তাদের আকুতি, পুলিশকে যেন কোনো রাজনৈতিক দলের হাতিয়ার বানানো না হয়।

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের এক অতিরিক্ত উপকমিশনারের কণ্ঠেও শোনা যায় একটা গভীর উদ্বেগ। তিনি বললেন, কিছু বলার মতো অবস্থা নেই তার। এই কথাগুলো যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে, পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ।

চট্টগ্রামের থানায় থানায় সেনাবাহিনীর বীর সেনারা এখন প্রহরী! নিজের চোখে দেখে, সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে, হারানো অস্ত্র ও মালামাল উদ্ধারে তারা নিরলস। সরকারি ভবনগুলোতেও তাদের নিরাপত্তার ছায়া।

এদিকে এই নৃশংস ঘটনার পর চট্টগ্রাম শহর এখন শোকাহত, নির্বাক। রাস্তায় রাস্তায় আতঙ্ক, নিরাপত্তাহীনতার এক ভয়াবহ ছায়া। মানুষের মনে প্রশ্ন— কারা এই হামলার জন্য দায়ী?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে উঠে আসছে পুলিশি নির্যাতন, গায়েবি মামলা, ঘুষ দাবির অভিযোগ। ক্ষোভে ফুঁসছে সাধারণ মানুষ। তাদের কথা, ‘আমরা আর সহ্য করতে পারছি না। পুলিশ আমাদের রক্ষক নয়, ভক্ষক হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

এই পরিস্থিতির জন্য কে দায়ী? সরকার? পুলিশ? না কি রাজনৈতিক অস্থিরতা? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গিয়েই হয়তো বেরিয়ে আসবে চট্টগ্রামে এই ভয়াবহ ঘটনার আসল কারণ।

এখন সময় এসেছে সবাইকে একসঙ্গে দাঁড়ানোর। সরকার, পুলিশ, জনগণ— সবাইকে মিলে এই সংকটের মুখোমুখি হতে হবে। নইলে আইনশৃঙ্খলার এই ভয়াবহ অবনতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।

এই ঘটনার পর সবার মনে একটাই প্রশ্ন— কবে ফিরবে শান্তি?