রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম ইসলাম প্রচারক আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী

প্রকাশিতঃ ৪ অগাস্ট ২০২৪ | ১২:৫১ অপরাহ্ন


দিলশাদ আহমেদ : ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম সফল ইসলাম প্রচারক, বাদশাহী পরিত্যাগী সুফী গাউছুল আলম মাহবুবে ইয়াজদানী সৈয়দ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী (রাঃ) এর ৬৩৮ তম পবিত্র ওরশ উপলক্ষ্যে তাঁর জীবন ও সাধনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ উপস্থাপন করছি। এই মহান সুফী দরবেশের ১২০ বছরের জীবন আধ্যাত্মিকতা ও অলৌকিক ঘটনায় পরিপূর্ণ, যা সংক্ষেপে বর্ণনা করা কঠিন। তাঁর জন্মই ছিল পিতা-মাতার আরাধ্য সাধনা ও মোনাজাতের ফল, প্রভুর পক্ষ থেকে একটি নেয়ামত। জন্মের পূর্বেই দুই সন্তানের আগমনের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছিল, একজনের নাম হবে আশরাফ, যিনি আধ্যাত্মিক সাধনায় খ্যাতি অর্জন করবেন, এবং অপরজন আরাফ, যিনি মানবসেবায় বিখ্যাত হবেন।

চার বছর চার মাস চার দিন বয়সে শিক্ষার হাতেখড়ি, চৌদ্দ বছর বয়সে হাফেজে কুরআন, কুরআন, হাদিস, ফিকাহসহ অন্যান্য বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জন করেন তিনি। যুদ্ধবিদ্যায়ও পারদর্শী হয়ে পনেরো বছর বয়সে সিমনান রাজ্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তেইশ বছর বয়সে ছোট ভাইয়ের হাতে রাজ্যের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে আধ্যাত্মিক নির্দেশনায় সিমনান থেকে সুদূর বাংলায় পীর ও মুর্শিদের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেন। দীর্ঘ দুই বছরের সফরে অসংখ্য আউলিয়ায়ে কেরাম, পীর ও বুজুর্গদের সাক্ষাৎ করে নেয়ামত লাভ করেন।

জন্ম: ১২৮৫ সাল, ৭০৮ হিজরী, ১৩০৮ সালে সিমনান, ইরান।

ওফাত: ১৪০৫ সাল, ১৩৮৬ বঙ্গাব্দ, ৮০৮ হিজরী, ২৮ শে মহররম, কাছওয়াছা, আম্বেদকর নগর, ভারত।

পিতা: সুলতান ইব্রাহীম নুর বখসী কুতুবউদ্দীন, সিমনানের সুলতান (হযরত হোসেন ইবনে আলীর বংশ থেকে তার কন্যা ফাতিমার মাধ্যমে নবী করিম (সঃ) এর বংশধর)।

মাতা: বিবি খাদিজা (তুর্কি সুফি সাধক আহমদ ইয়াসাভির বংশধর)।

পূর্বসুরী: হযরত শায়েখ আলাউল হক ওয়াদ্দীন গঞ্জেনাবাত পান্ডুবী (রাঃ)।

উত্তরসূরী: হযরত আবদুর রাজ্জাক নুরুল আইন (রাঃ)।

উপাধি: গাউছুল আলম, মাহবুবে ইয়াজদানী, কুদওয়াতুল কুবরা, সুলতান, আশরাফ জাহাঙ্গীর, মখদুম-এ-সিমনানী।

শিক্ষা দীক্ষা: চার বছর চার মাস চার দিন বয়সে বিসমিল্লাহ শরীফের মাধ্যমে শিক্ষার হাতেখড়ি। পাঁচ বছর বয়সে পবিত্র কুরআনুল করীম সাত ক্বেরাত সহকারে হিফজ সম্পন্ন করেন। সাত বছর বয়সে আরবি ভাষায় বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি কোরআনের তাফসীর, হাদিস শরীফ, ইলমে ফিকাহ সহ প্রচলিত প্রায় সব বিষয়ের উপর গভীর পান্ডিত্য অর্জন করেন এবং অতি অল্প সময়ে যুদ্ধবিদ্যাতেও পারদর্শিতা অর্জন করেন।

সিমনানের সুলতানের দায়িত্ব গ্রহণ: আব্বাজানের ইন্তেকালের পর পনেরো বছর বয়সে সিমনান রাজ্যের সালতানাতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তেইশ বছর বয়সে সিংহাসন ত্যাগ করে ছোট ভাই মুহাম্মদ আরাফের হাতে ন্যস্ত করে আধ্যাত্মিকতার তীব্র আকর্ষণে মায়ের অনুমতিক্রমে হযরত আলাউল হক পান্ডবীর সাথে দেখা করার জন্য বাংলার উদ্দেশে এক সুদীর্ঘ সফর শুরু করেন।

ন্যায় বিচারের দক্ষতা: হযরত শেখ আলাউদ্দৌলা সিমনানী একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। একদা মাহবুবে ইয়াজদানী হযরত আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী আমীর ওমরাহ গণের উৎসাহে শিকারে বের হলেন। সেখানে অবস্থানকালে এক বৃদ্ধা এসে অভিযোগ করলেন যে, হযরতের সৈন্যবাহিনীর এক সদস্য জোরপূর্বক দই ছিনিয়ে নিয়েছে। হযরত বৃদ্ধাকে সনাক্ত করতে বললে জনৈক সৈন্যের দিকে ইঙ্গিত করলেন। হযরত অভিযোগ সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করলে সৈন্যটি অস্বীকার করল এবং বলল বৃদ্ধা মিথ্যা বলছে। এমতাবস্থায় সাক্ষী ছাড়া ঘটনা প্রমাণের জন্য হযরত কৌশল করে বললেন কিছু মাছি ধরে এনে খাওয়ানোর নির্দেশ দিলে সৈন্যটি বমি করে দিল এবং বমির সাথে দইয়ের কণা বের হলে সত্য প্রকাশিত এবং প্রমাণিত হয়ে গেল। হযরত উক্ত সৈন্যের ঘোড়া ও ঘোড়ার জিন, লাগাম জরিমানা হিসেবে বৃদ্ধাকে দিলেন এবং সৈন্যকে শাস্তি প্রদান করলেন।

সফর : হযরত আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী দুই বছরের সুদীর্ঘ সফরে বহু সুফি সাধকের সান্নিধ্যে আসেন এবং তাদের কাছ থেকে সুফিবাদের গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি সিমনান থেকে যাত্রা শুরু করে বুখারায় পৌঁছান। সেখানে একজন মজজুব দরবেশের সাথে সাক্ষাৎ হলে তিনি পূর্ব দিকে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ পান। এরপর তিনি সমরকন্দে গিয়ে শেখুল ইসলামের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং এক রাত অতিথি হিসেবে কাটানোর পর সঙ্গীদের ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে রওনা দেন। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সিন্ধু প্রদেশের উঝ শহরে পৌঁছান। সেখানে মখদুম জালাল উদ্দিন জাহানিয়া জাহাগঁশত (রঃ) এর সাথে সাক্ষাৎ করে তিন দিন অবস্থান করেন।

মখদুম জালাল উদ্দিনের নির্দেশে তিনি হযরত আলাউদ্দিন গঞ্জেনাবাত (রাঃ) এর সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে দিল্লির দিকে রওনা হন। দিল্লিতে পৌঁছালে সেখানকার একজন বেলায়েতধারী বুজুর্গ তাকে স্বাগত জানান এবং আলাউদ্দিন গঞ্জেনাবাতের জন্য অপেক্ষা না করে দ্রুত পূর্ব দিকে রওনা হওয়ার পরামর্শ দেন।

অতঃপর তিনি পূর্ব দিকে যাত্রা করে পান্ডুয়ায় হযরত সুলতানুল মুরশেদীন শেখ আলাউল হক ওয়াদ্দীন (রাঃ) এর খানকাহে পৌঁছান। হযরত আলাউল হক পূর্ব থেকেই তাঁর আগমন সম্পর্কে অবগত ছিলেন। হযরত খিজির (আঃ) সত্তর বার তাঁকে হযরত আশরাফের আগমন সম্পর্কে জানিয়েছিলেন। তাই তিনি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন।

হযরত আশরাফ যখন পান্ডুয়ার নিকটবর্তী হন, তখন হযরত আলাউল হক তাঁর কামরায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। কিন্তু আধ্যাত্মিকভাবে তিনি হযরত আশরাফের আগমন সম্পর্কে জানতে পারলেন। তিনি তাঁর শিষ্যদের আগেই বলে রেখেছিলেন যে, তাঁর আসার খবর পেলে তিনি তাঁকে বরণ করে আনবেন।

হযরত আলাউল হক খানকাহ থেকে বের হয়ে বললেন, “বুয়ে ইয়ার মী আয়দ” (বন্ধুর সুবাস ভেসে আসছে)। এরপর তিনি সঙ্গী, সহচর ও মুরিদদের নিয়ে বিশাল মিছিল নিয়ে হযরত আশরাফকে বরণ করতে গেলেন।

হযরত আশরাফ দূর থেকে হযরত আলাউল হককে দেখতে পেয়ে দৌড়ে এসে তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়লেন। হযরত আলাউল হক তাঁকে বুকে তুলে নিয়ে বললেন, “তোমার আসার পূর্বে হযরত খিজির (আঃ) সত্তর বার আমার কাছে এসেছেন এবং বলেছেন যেন তোমার যত্নের ব্যাপারে কোনো ঢिलामी না করা হয়। যেহেতু তুমি আল্লাহর এক আমানত স্বরূপ, যা আমার নিকট এসে উপনীত হবে।”

খানকাহে পৌঁছে হযরত আলাউল হক হযরত আশরাফকে আদর করে কাছে বসালেন এবং বললেন, “বৎস! আজ পার্থিব মোহ থেকে হাত ধুয়ে ফেল, নইলে মিলনের মধুরতা থেকে বঞ্চিত হবে।” হযরত আশরাফ বিনয়ের সাথে উত্তর দিলেন যে, তিনি ইতিমধ্যেই পার্থিব মোহ থেকে মুক্ত হয়েছেন।

হযরত আলাউল হক নিজ হাতে হযরত আশরাফকে খাবার খাইয়ে দিলেন, যা এর আগে কারো ভাগ্যে জোটেনি। এরপর তিনি সকলকে কামরা থেকে বের করে দিয়ে হযরত আশরাফকে একান্তে বাইয়াত দিলেন এবং তাঁকে নেয়ামত দান করলেন।

হযরত আলাউল হক হযরত আশরাফের হাত ধরে কামরা থেকে বেরিয়ে এলেন। তাঁর চেহারায় স্বর্গীয় নূরের আভা ছড়িয়ে পড়ছিল। তিনি বিভিন্ন পূণ্যময় স্মারক নিয়ে এসে বললেন, “হে আমার সঙ্গী সাথীরা জেনে রাখ, বুজুর্গানে কেরামের বিভিন্ন স্মৃতি স্মারক দীর্ঘদিন আমার কাছে গচ্ছিত ছিল। এখন এর প্রাপক উপস্থিত হয়েছেন, আমি তাকে এগুলি প্রদান করলাম।” এভাবে হযরত আলাউল হক তাঁকে দীক্ষিত করলেন এবং হযরত আশরাফও পীরের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করলেন।

জাহাঙ্গীর উপাধী লাভ : হযরত আলাউল হক পান্ডুবী তাঁর প্রিয় শিষ্যকে একটি উপাধি দিতে চাইলেন। উপযুক্ত উপাধি লাভের জন্য তিনি গায়বী নির্দেশনার অপেক্ষায় রইলেন। শবে বরাতের রাতে তিনি যখন তসবীহ ও জিকিরে মশগুল ছিলেন, তখন গায়ব থেকে ‘জাহাঙ্গীর’ ধ্বনি ভেসে এলো। তিনি আনন্দিত হয়ে তাঁর শিষ্যকে এই উপাধি দিলেন। এরপর থেকে হযরত আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী নামে পরিচিত হলেন।

রমজানের সাতাশ তারিখে হযরত আলাউল হক তাঁকে মারেফতের গভীর জ্ঞান দান করলেন। এরপর তিনি হযরত আশরাফকে বললেন, “এক বনে দুই বাঘ বা এক খাপে দুই তলোয়ার একসাথে থাকতে পারে না। তাই তোমার জন্য এমন এক স্থানের ব্যবস্থা করতে চাই, যেখানে তুমি তোমার কাজ শুরু করবে এবং আল্লাহর বান্দাদের হেদায়েতের পথ দেখাবে।”

হযরত আশরাফ এই কথা শুনে মর্মাহত হলেন। তিনি বললেন, “যাঁর সান্নিধ্যের জন্য আমি সবকিছু ত্যাগ করেছি, আজ তাঁর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কীভাবে বাঁচব?” তাঁর এই আকুতি দেখে হযরত আলাউল হক তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “এটা বিচ্ছেদ নয় বরং আল্লাহর ইচ্ছার প্রতিফলন।”

দুই বছর পর হযরত আলাউল হক তাঁকে বললেন, “তোমাকে বিদায় দেওয়ার সিদ্ধান্তের পেছনে কিছু রহস্য আছে, যা তুমি জানো না। তুমি এতে সম্মত হও।” হযরত আশরাফ মুর্শিদের কথার অবাধ্য হতে পারলেন না। তিনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও জৌনপুর যাওয়ার সিদ্ধান্ত মেনে নিলেন।

সাড়ে ছয় বছর পর ৭৪২ হিজরিতে ঈদের দিন তিনি জৌনপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। জৌনপুরে তখন বিখ্যাত সুফি সাধক শেখ হাজী সদরুদ্দীন চেরাগে হিন্দ সোহরাওয়ার্দী বাস করতেন। তাঁর ভয়ে হযরত আশরাফ কিছুটা শঙ্কিত হলেও হযরত আলাউল হক তাঁকে আশ্বস্ত করেন।

হযরত আশরাফ জৌনপুরের পথে আরল নামক স্থানে কিছুদিন অবস্থান করেন। এরপর আজমগড়ের মোহাম্মদাবাদে পৌঁছে একটি বাগানে তাঁবু খাটিয়ে অবস্থান করেন। এরপর তিনি জৌনপুরের নিকটবর্তী জাফরাবাদে কিছুদিন অবস্থান করেন। সেখানে তিনি স্থানীয় আলেম ও ওলামাদের সাথে শরীয়ত ও তরিকত নিয়ে আলোচনা করেন এবং বিভিন্ন মতভেদ নিরসন করেন। তাঁর প্রতি মানুষের ভক্তি, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা বাড়তে থাকে এবং বিভিন্ন কারামত প্রকাশ পেতে থাকে।

প্রিয় পাঠক, হযরত আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী (রাঃ) এর সফরের বর্ণনা অত্যন্ত বিস্তৃত। তিনি আরব ও আজমের পবিত্র ভূমি ভ্রমণ করে পুনরায় তাঁর পীরের দরবারে ফিরে আসেন এবং প্রায় তিন-চার বছর সেখানে অবস্থান করেন। অবশেষে বিদায় নেওয়ার সময়, তাঁর মুর্শিদ তাঁকে আধ্যাত্মিক দৃষ্টির মাধ্যমে তাঁর ভবিষ্যৎ কর্মস্থলের ইঙ্গিত দেন। হযরত আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী বলেন, তিনি একটি গোলাকার পুষ্করিনীর মাঝে একটি ক্ষুদ্র টিলার দর্শন পেয়েছিলেন। হযরত আলাউল হক পান্ডুবী তাঁকে জানান, এটিই হবে তাঁর গন্তব্যস্থল।

এরপর, হযরত আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী বেনারস থেকে জৌনপুর যান। জৌনপুর থেকে তিনি কিরমীনি নামক স্থানে পৌঁছান এবং সেখানে কিছুদিন অবস্থান করেন। এরপর, কিরমিনি থেকে ৪ মাইল দূরে অবস্থিত ভডবন্ড বা ভদড় নামক স্থানে (বর্তমানে কাছওয়াছা শরীফ) তিনি পৌঁছান। সেখানকার শাসক মাহমুদ এবং তার পুত্রসহ অনেকে তাঁর হাতে বায়’আত গ্রহণ করেন এবং তাঁর সহায় হন।

এই স্থানটি হযরত আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানীর অত্যন্ত পছন্দ হলো। এটি তাঁর মুর্শিদের নির্দেশিত স্থানের সাথে মিলে যাওয়ায় তিনি এখানেই থাকার সিদ্ধান্ত নেন। তবে, এখানকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান, একটি গোলাকৃতির পুষ্করিনীর পাড়, দরপণ নামের এক তান্ত্রিক সাধু দখল করে আছে বলে জানা যায়। হযরত আশরাফ মাহমুদকে সঙ্গে নিয়ে সেই স্থানটি দেখতে যান এবং নিশ্চিত হন যে, এটিই তাঁর মুর্শিদের নির্দেশিত স্থান। তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেন, “বেদ্বীনদের উচ্ছেদ করা কঠিন কিছু নয়।”

এরপর, তিনি একজন খাদেমের মাধ্যমে তান্ত্রিক সাধুকে সেই স্থান ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। কিন্তু সাধু জানায়, তার পক্ষে স্থান ত্যাগ করা সম্ভব নয়, কারণ তার সাথে পাঁচ শতাধিক তান্ত্রিক শিষ্য রয়েছে। সে আরও বলে, কেউ যদি তাকে পরাজিত করতে পারে, তবেই সে স্থান ত্যাগ করবে।

এই কথা শুনে হযরত সৈয়দ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী তাঁর সদ্য দীক্ষিত শিষ্য জামালউদ্দিনকে ডেকে বললেন, “যাও, তান্ত্রিক যতই যাদু প্রদর্শন করুক না কেন, সব প্রতিহত করো। প্রয়োজনে যেকোনো কারামত দেখানোর ক্ষমতা আমি তোমাকে দিলাম।”

হযরতের কাছ থেকে এই ক্ষমতা ও সাহস নিয়ে জামালউদ্দিন দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে গেলেন। তান্ত্রিক তার সব শক্তি প্রয়োগ করলো, কিন্তু সবই ব্যর্থ হলো। প্রথমে পিঁপড়ার দল, তারপর বাঘের পাল – কোনো কিছুই জামালউদ্দিনের কাছে টিকলো না। অবশেষে তান্ত্রিক যখন তার বল্লম দিয়ে আক্রমণ করতে উদ্যত হলো, জামালউদ্দিন হযরতের লাঠি দিয়ে তা প্রতিহত করলেন।

তান্ত্রিকের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে দেখে সে হযরতের কারামতের কাছে নতি স্বীকার করলো। সে ইসলাম গ্রহণ করলো এবং হযরতের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলো। তার পাঁচশত শিষ্যও তওবা করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলো।

এই স্থানের নামকরণ করা হলো “রূহ আবাদ”। এখানে একটি খানকাহ ও হুজরা নির্মিত হলো। পরবর্তীতে হযরত আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী এবং তাঁর উত্তরসূরি হযরত আব্দুর রাজ্জাক নুরুল আইন (রাঃ) এই স্থানেই বসবাস করেন এবং তাঁদের মাজার শরীফ এখানেই অবস্থিত।

বর্তমানে এই স্থানটি ভারতের উত্তর প্রদেশের ফয়েজাবাদ জেলায় অবস্থিত। আকবরপুর রেল স্টেশনের নিকটবর্তী বিশাখারী ও কাছওয়াছার মধ্যবর্তী এই পুরো এলাকাটি হেদায়েতের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।

চিশতীয়া তরিকায় আউহাদুদ্দীন মীর সৈয়দ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী (রাঃ) এর আধ্যাত্মিক ধারা:

রহমতুল্লিল আলামিন হযরত মোহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)
ইমামুল আউলিয়া হযরত আলী মুশকিল কুশা (কররামাল্লাহু ওয়াজহাহু)
হযরত শায়েখ হাসান বসরী (রাঃ)
হযরত শায়েখ আব্দুল ওয়াহিদ বিন জায়েদ (রাঃ)
হযরত শায়েখ সুলতান ইব্রাহিম আদহাম বলখী (রাঃ)
হযরত শায়েখ সৈয়দ ইয়াহিয়া হুজাইফা আল মারাশী (রাঃ)
হযরত শায়েখ আমিনুদ্দীন আবু হুবাইরা বসরী (রাঃ)
হযরত শায়েখ মুমশাদ দিনাওয়ারী (রাঃ)
হযরত শায়েখ খাজা আবু ইসহাক শামী (রাঃ)
হযরত শায়েখ আবু আহমদ আবদাল চিশতী (রাঃ)
হযরত শায়েখ আবু মোহাম্মদ চিশতী (রাঃ)
হযরত শায়েখ নাসির উদ্দীন আবু ইউসুফ বিন সামান (রাঃ)
হযরত শায়েখ কুতুবউদ্দীন মওদুদ চিশতী (রাঃ)
হযরত শায়েখ খাজা শরীফ জিন্দানী (রাঃ)
হযরত শায়েখ উসমান হারুনী চিশতী (রাঃ)
হযরত সুলতানুল মশায়েখ সুলতানুল হিন্দ খাজা মঈনুদ্দীন হাসান সিজজী চিশতী (রাঃ)
হযরত শায়েখ খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী (রাঃ)
হযরত শায়েখ খাজা বাবা ফরিদ উদ্দীন গঞ্জেশকার (রাঃ)
হযরত শায়েখ খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়া (মাহবুব-ই-ইলাহী) (রাঃ)
হযরত শায়েখ আখি সিরাজ আল-হক ওয়াদ্দীন উসমান (আইনায়ে হিন্দ) (রাঃ)
হযরত শায়েখ আলাউল হক ওয়াদ্দীন গঞ্জেনাবাত পান্ডুবী (রাঃ)
তারেকুচ্ছালতানাত, কুদওয়াতুল কুবরা, মাহবুবে ইয়াজদানী, গাউছুল আলম, মখদুম সোলতান আউহাদুদ্দীন মীর সৈয়দ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী (রাঃ)

প্রিয় পাঠক, বর্তমান মুসলিম বিশ্বে আলে রাসুল (সাঃ) ও আওলাদে গাউছিয়া পাকের আদর্শ অনুসরণ করে মুসলিম মিল্লাতকে সঠিক পথে পরিচালনায় এই দরবারের মাশায়েখগণের ভূমিকা অপরিসীম। আশরাফীয়া সিলসিলার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক জ্ঞান, লিখনী ও আলোচনার মাধ্যমে ঈমান-আকীদাকে পরিশুদ্ধ রাখার কাজ অব্যাহত রয়েছে।

গাউছুল আলম মাহবুবে ইয়াজদানী সৈয়দ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী (রাঃ) এর মিশন ও ভিশনকে বাস্তবায়নে কাছওয়াছা দরবার শরীফের বর্তমান সাজ্জাদানশীন, আশরাফুল মাশায়েখ আবুল মোখতার সৈয়দ মাহমুদ আশরাফ আল আশরাফী আল জিলানী (মাঃ জিঃ আঃ), তরিকতের খেদমত করে যাচ্ছেন। আশরাফীয়া সিলসিলার অন্যান্য সদস্যগণও নিরলস সাধনা ও ত্যাগের মাধ্যমে এই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশে বিভ্রান্তি দূর করে মুসলিম মিল্লাতকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মতাদর্শে পরিচালিত করতে আঞ্জুমানে আশরাফিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই সংগঠন আমল ও খেদমতের মাধ্যমে মুসলিম মিল্লাতকে ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির পথে আসার আহ্বান জানায়।

আশরাফীয়া সিলসিলার অনুসারীদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশের অসংখ্য নবী ও ওলী প্রেমিকের সম্মিলিত প্রয়াসে সুন্নিয়তের সোনালী যুগ আসবে ইনশাআল্লাহ।

লেখক : স্বতন্ত্র পরিচালক, পিপলস্ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড; প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও, আহমেদ এন্টারপ্রাইজ।