এম কে মনির : কি-বোর্ডের সাদা স্ক্রিনে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থেকেও কিছু লিখতে পারছিলাম না। আপনাকে নিয়ে অনেক স্মৃতি মনে পড়ছে, যা লিখতে গেলে কলমের কালি ফুরিয়ে যাবে কিন্তু লেখা শেষ হবে না। বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। দু’চোখের পাতা কিছুতেই এক করতে পারছিলাম না। গত বছরের ২ আগস্ট রাত আর এ বছরের ১ আগস্ট রাত যেন এক হয়ে গেল। দিনভর আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরেছে। ঠিক যেমন বৃষ্টি হয়েছিল সেদিন, যেদিন আপনাকে রাঙ্গুনিয়ার উত্তর পদুয়া গ্রামের মসজিদের পাশে মাটির নিচে শুইয়ে দিয়েছিলাম। বারবার ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিলাম, ভাবছিলাম কি করে থাকবেন আপনি একলা ওই অন্ধকার ঘরে? আমার কাছে মনে হচ্ছে আকাশ সেদিনের মতো আজও কাঁদছে আপনার বিয়োগে। আপনার শূণ্যতায় সে তার দুঃখগুলো ঝরাচ্ছে। আপনার কথা ভাবতেই মনের অজান্তেই চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
২০২৩ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি একদিন অফিসের বাইরে থাকা অবস্থায় দুপুরে হঠাৎ করে একুশে পত্রিকার সম্পাদক আজাদ তালুকদার স্যারের তলব পেয়ে দ্রুত অফিসে ফিরলাম। অফিসের সামনে গিয়ে দেখি সম্পাদক মহোদয় তাঁর গাড়িতে বসে আছেন। তাঁর সঙ্গে পরিবারের সদস্যরাও ছিলেন। কিছুটা ভয় নিয়ে সামনে গিয়ে সালাম দিলাম। তিনি আমার সালামের উত্তর দিয়ে কাজের প্রতি মনোযোগ বাড়াতে, ভালো করে কাজ করতে এবং পত্রিকা প্রকাশে সহকর্মীদের সঙ্গে সমন্বয় বাড়াতে বললেন। আমি সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ালাম।
অফিস সূত্রে জানতে পারলাম লিভার ক্যান্সারের চিকিৎসার ফলোআপ করাতে ওই রাতেই তিনি ভারতে যাচ্ছেন। তিনি দেশের বাইরে থাকলে সাধারণত আমার সঙ্গে কথা হতো না, কারণ তিনি অসুস্থ ছিলেন। পেশাগত প্রয়োজনে যত বড় কাজই হোক না কেন, আমি নিজে কিংবা চীফ রিপোর্টার শরীফুল রুকন ভাইয়ার মাধ্যমে সমাধান করতাম। আমি ভাবতাম, তিনি অসুস্থ, তাঁকে বিরক্ত না করাই ভালো। তাঁকে নিয়ে আমাদের সময়গুলো ছিল উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় ভরা। হঠাৎ ২০ জুলাই শুনলাম তিনি ভারত থেকে দেশে ফিরেছেন এবং তৎকালীন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ডা. হাছান মাহমুদের পরামর্শে তাঁকে রাজধানীর পান্থপথের বিআরবি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
দেশে আসার পরপরই একুশে পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক নজরুল কবির দীপু মহোদয়, চীফ রিপোর্টার শরীফুল রুকন ভাইয়া এবং সহকর্মী আবছার রাফি ভাইয়া সম্পাদককে দেখে এসেছেন। তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া খবরে বুঝলাম সম্পাদকের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। খবর শুনে আমিও ব্যাকুল হয়ে উঠলাম সম্পাদককে দেখার জন্য। মুহূর্তেই ঢাকায় যাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছিল। জীবনে এর আগে কাউকে দেখতে এতটা আগ্রহী হইনি। প্রতি মুহূর্তে অস্থিরতা কাজ করছিল। এর আগে কখনো ঢাকায় যাইনি, তাই কীভাবে যাব, কার সঙ্গে যাব, এসব নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেলাম।
২৩ জুলাই দিনের বেলা কয়েকজন সহকর্মীর সাথে একসঙ্গে ঢাকা যাওয়ার চেষ্টা করেও সফল হলাম না। শেষ পর্যন্ত সেদিন রাতেই একাই অচেনা ঢাকা শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ছোটবেলা থেকেই বাসে ঘুমানোর অভ্যাস নেই, তাই যাত্রীরা সকলে ঘুমালেও আমি রাতভর জেগে ঢাকার পথের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ভোর হতেই ঢাকায় পৌঁছে পথচারীদের জিজ্ঞেস করে বিআরবি হাসপাতাল খুঁজে পেলাম। লিফটে করে এগারো তলায় উঠে ১১১৪ নম্বর কক্ষটি অনেক খুঁজে পেলাম। রোগীর নাম আজাদ হোসেন। নামটি দেখেই মনে এক ধরনের ভালো লাগা কাজ করল। একা একা দূর ঢাকা শহরে সম্পাদকের কাছে পৌঁছে যাওয়াটা আমার কাছে ভিন্ন রকম অনুভূতির ছিল। মনে হলো বহুদিন পর প্রিয় সম্পাদকের দেখা পেতে যাচ্ছি। ফেসবুকে দেখা সেই রুগ্ন ছবির মানুষটি কি আসলেই তেমন হয়েছে? এমন প্রশ্ন মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল।
ঘড়ির কাঁটায় সময় ভোর ছয়টা। এত ভোরে তিনি জেগে আছেন কিনা, সে ভেবে কলিং বেল দিইনি। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার নিচে নেমে গেলাম। সম্পাদকের ভাগ্নে তারেক সোহেল ভাইকে ফোন করে পরামর্শ নিলাম ভেতরে যেতে পারব কিনা। তাঁর সম্মতিতে আবার ওপরে উঠে দরজায় কড়া নাড়লাম। ভেতর থেকে স্যারের আওয়াজ শুনতে পেলাম। সম্পাদকের আরেক ভাগ্নে পাইলট এসে দরজা খুলে দিলেন। ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখলাম আমাদের সাহসী, তেজস্বী, বলিষ্ঠ-কর্মঠ সম্পাদক আজাদ তালুকদার স্যার বিছানায় একাকার হয়ে শান্ত হয়ে শুয়ে আছেন। দেখে মনে হলো জীবন সায়াহ্নের শেষ সময়গুলো পার করছেন তিনি। মুহূর্তেই গা ছমছম করে উঠল। আমি ভুল দেখছি না তো? এ কী করে হয়? কী করে সম্ভব? মাত্র কয়েকদিন আগেও যে মানুষটিকে সুস্থ সবল দেখেছিলাম, তিনি কী করে এত শুকিয়ে গেলেন? মাথায় কোনো চুল নেই, অপেক্ষাকৃত দুর্বল হয়ে পড়েছেন তিনি। কথা বলার শক্তি পাচ্ছেন না। হাতে ক্যানোলা লাগানো। গায়ে হাসপাতাল থেকে দেওয়া আকাশি রঙের বিশেষ পোশাক।
আমাকে দেখে তিনি অবাক হননি। তিনি জানতেন আমি ছুটে যাব। মৃদু স্বরে বললেন, ‘মনির, এত সকালে আমাকে দেখতে এসেছ?’ এরপর কাছে ডাকলেন। পাশে বসতে চাইলেও আমি রাজি হইনি। বস্তুত, তাঁর পাশে বসার যোগ্যতা আমার নেই। ‘কীভাবে এলে চট্টগ্রাম থেকে? চিনলে কী করে? তুমি তো কখনো ঢাকায় আসিনি। আসার পথে কোনো অসুবিধা হয়েছে? নাস্তা করেছ?’ শান্ত গলায় এসব প্রশ্ন করলেন। একপর্যায়ে নিজ থেকে টাকা দিতে চাইলেন আমাকে। এরপর বললেন, ‘খাতা-কলম নাও, লিখো।’ তারপর একটি নিউজের অংশ হিসেবে কয়েকটি নাম ও পদবি আমাকে বললেন। আমি হুবহু লিখলাম। এরপর বললেন মোবাইলে টাইপ করে চিফ রিপোর্টারকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাতে। আমি তাই করলাম। একুশে পত্রিকার সম্পাদকের মেধা খুব প্রখর ছিল। তিনি ইতিহাস, মানুষের নাম, পদবি খুব ভালো করে মুখস্থ রাখতে পারতেন, যা আমরা পারতাম না। তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন আর কে কে এসেছে। আমি বললাম একুশে পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার জোবায়েদ ইবনে শাহাদাত (বর্তমানে যমুনা টেলিভিশনের স্টাফ রিপোর্টার) ও আনোয়ারা উপজেলা প্রতিনিধি জিন্নাত আয়ুবও এসেছেন। তাঁরা আমার চেয়ে কিছুটা দেরিতে ঢাকায় পৌঁছেছে। তাঁদেরকে খবর দেওয়া হলো। একটু পরে তাঁরাও ছুটে এলেন সম্পাদকের কাছে।
সেদিন সম্পাদককে বিশেষ কিছু বলা হয়নি। আমি একপ্রকার বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম তাঁকে সেই অবস্থায় দেখে। সারাদিন তাঁর শয্যাপাশে, সান্নিধ্যে, কাছাকাছি ছিলাম। পুরো দিনের কথায় বুঝতে পারলাম আমাদের ছেড়ে তিনি চলে যাবেন, হয়তো বুঝে গেছেন। ভেতরে জেনে গেছেন। এরপরও বিশ্বাস হচ্ছিল না। মাথা থেকে মুহূর্তেই ঝেড়ে ফেললাম আর ভাবলাম, না, এ হতে পারে না। আমি সম্পাদককে দেখে সেদিন খুব বেশি অবাক হয়েছিলাম। একজন মানুষ কতটা কাজ পাগল! মৃত্যুপথযাত্রী হয়েও সংবাদের ক্ষুধা তার মিটেনি। পেশাগত দায়িত্ব থেকে তিনি অতটুকু সরে যাননি। মানুষকে খবর জানানোর তাঁর ভেতরে থাকা এক প্রবল তৃষ্ণা আমাকে অবাক করেছে। এ যেন শেষ নিঃশ্বাস অবধি মানুষের জন্য তাঁর সাংবাদিকতা।
২৩ জুলাই বিকালেও ঢাকা ছাড়তে মন চাইছিল না আমার। সম্পাদক বারবার আমাকে চলে যেতে তাগাদা দিচ্ছিলেন। কিন্তু কিছুতেই আমার মন সায় দিচ্ছিল না তাঁকে ছেড়ে আসতে। রাতে তাঁর সঙ্গে হাসপাতালে থাকার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তাই বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় এক বন্ধুর বাসায় ওঠলাম। কিন্তু মন পড়ে রইল বিআরবি হাসপাতালের সেই কক্ষে, যেখানে শুয়ে ছিলেন আমার সম্পাদক। রাতটা কোনোমতে কাটিয়ে সকাল হতেই আবার চলে গেলাম সম্পাদকের কাছে। আরও একটি বেলা কাটালাম। নানা ব্যক্তিত্ব ওনাকে দেখতে আসছেন। তাঁদের সঙ্গে আলাপ হচ্ছে। আমাকেও পরিচয় করিয়ে দিলেন কয়েকজনের সঙ্গে।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার সিনিয়র সাংবাদিক ফারজানা জেসমিন আপার কথা আমার এখনও মনে পড়ে। তিনি হাসপাতালে সম্পাদককে দেখতে আসেন। হাতে হাত মিলিয়ে অনেক স্মৃতিচারণ করলেন দুজনে। সম্পাদক স্যারও আবেগতাড়িত হয়ে পড়লেন। তাঁর চোখে চোখ রেখে কী যেন বললেন। সম্পাদকের চোখের কোণে নোনা জল দেখতে পেলাম। বুঝতে বাকি রইল না ভদ্রমহিলা সম্পাদকের স্বজন। কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, একুশে পত্রিকাকে তিল তিল করে আজকের এই জায়গায় এনেছেন, অনেক পরিশ্রম, অনেক কষ্ট, অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। কতদিন নাওয়া-খাওয়া ছেড়েছেন তার হিসাব নেই। পত্রিকাকে ঘিরে তাঁর স্বপ্ন কতটা বড়, তা বুঝালেন চোখের জল মুছতে মুছতেই।
আমাকে উপদেশ দিলেন, ‘মনির, কাজের প্রতি মনোযোগ বাড়াও, কাজ না থাকলে তুমি হারিয়ে যাবে। আর আমার স্মৃতিটা ধরে রেখো, বাঁচিয়ে রেখো। যেন আমি না থাকলেও একুশে পত্রিকা থেমে না থাকে। যেন অনন্তকাল মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে থাকে এই পত্রিকা।’ সেদিন সম্পাদককে কথা দিয়েছিলাম আপনার স্মৃতিটা ধরে রাখব।
২৪ জুলাই বিকালে সম্পাদকের কাছ থেকে আমার বিদায় নেওয়ার সময় হয়। সম্পাদকের ভাগ্নে দিদারুল আলম পাইলট আমার কাছে বার্তা আনলেন যে, আমি কেন চট্টগ্রামে যাচ্ছি না, নিউজ কেন করছি না, অফিসের কাজ কে করবে? পত্রিকা কীভাবে বের হবে? সম্পাদক সেই প্রশ্ন তুলেছেন। ভয়ে তটস্থ হয়ে তড়িঘড়ি করেই দূর থেকে শেষবারের মতো মুখখানা দেখে বেরিয়ে গেলাম বাইরে। বাইরে এসে বিআরবি হাসপাতাল ভবনের দিকে তাকিয়ে আছি বহুক্ষণ ধরে। বিশাল অট্টালিকা। ভাবছি এই বহুতলে শুয়ে আছেন আমার প্রিয় সম্পাদক। যিনি ছাড়া আমরা এতিম শিশুর মতো। মনে মনে শুধু দোয়া করছিলাম যেন মহান আল্লাহ তাঁকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দেন। ফিরিয়ে দেন সাংবাদিকতায়।
ওই দিন বিকালেই ফেরার মুহূর্তে ফোন করলেন মহেশখালী উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা আমার প্রিয়জন ছৈয়দুল হক। তিনি সম্পাদককে দেখার আগ্রহ প্রকাশ করলেন আমার কাছে। আমি তাঁকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে হাসপাতালের লিফটে তুলে দেওয়ার পর নিচে অপেক্ষা করতে লাগলাম। আর ভাবতে লাগলাম মৃত্যু ও মৃত্যু-পরবর্তী জীবন নিয়ে অনেক কিছু। সেদিন চট্টগ্রামে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হলো। সম্পাদককে দেখে এসে মনে হলো নিজের এক আত্মীয়, পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মানুষকে ফেলে এসেছি স্বার্থপর এক শহরে।
নগরে এসে আবারও কাজে নেমে পড়লাম। সত্যি বলতে, সেই পরিস্থিতিতে কাজ করার কোনো মানসিকতা ছিল না। এক ধরনের অস্থিরতায় ছিলাম। কিন্তু সম্পাদকের কথাগুলো কানে লাগলে মনে হতো, তিনি তো কাজ ভালোবাসেন, তাই তাঁকে ভালোবাসলেও কাজ করতে হবে। আর তা শুধুই নিজের জন্য। এরপর থেকে কাজের পাশাপাশি প্রতি রাতে ও দিনে সম্পাদকের শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিয়েই সময় কাটত।
২ আগস্ট ভোররাতে ঘুম ভাঙল কয়েকজন সহকর্মীর ফোনে। ওপাশ থেকে চাপা কণ্ঠের আওয়াজ আসল, ‘একুশে পত্রিকার সম্পাদক, আমাদের সমস্ত সাহসের বাতিঘর আজাদ তালুকদার স্যার আর বেঁচে নেই।’ মুহূর্তেই কলিজাটা মোচড় দিয়ে উঠল। আকাশ ভেঙে পড়ল মাথায়। নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সপ্তাহখানেক আগে দেখে আসা মানুষটা এত তাড়াতাড়ি কফিনবন্দী হয়ে চলে আসবেন, ভাবতেই পারছিলাম না। মনের আয়নায় তাঁর ছবি ভাসতে ভাসতেই চোখের সামনে ভেসে উঠল একুশে পত্রিকার লিংক। অনলাইনে লিড রয়েছে, ‘একুশে পত্রিকা সম্পাদকের জীবনাবসান।’ কিছুক্ষণের জন্য আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।
এবার চোখে কোনো পানি নয়, পাথর হয়ে গেলাম একেবারে। একের পর এক সহকর্মীদের ফোন আসছে। বুঝে গেলাম প্রিয় মানুষটিকে আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে চিরবিদায় জানাতে হবে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ফেসবুক টাইমলাইন সম্পাদকের মৃত্যুর খবরের পোস্টে ছেয়ে গেল। স্ক্রল করতেই শুধু তাঁর ছবি ভেসে উঠছে। সাংবাদিকসহ নানা শ্রেণির পেশাজীবী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা শোক জানাচ্ছেন। স্মৃতিগুলো উগরে দিচ্ছেন। বিভিন্ন মহল থেকে শোক বিবৃতিও দেওয়া হচ্ছে।
এরপর জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ প্রাঙ্গণে প্রিয় মুখগুলো জড়ো হতে শুরু করল। অনেকের মতো আমিও লাইন ধরে সম্পাদককে দেখলাম। চেহারায় নূরানী আবেশ। সম্পাদক আমার আরও বেশি উজ্জ্বল, আরও বেশি আলোকিত হয়ে গেলেন। মৃত্যুর পর জান্নাতের মেহমানদের চেহারা হয়তো এমনই হয়। সেখানে যোহরের নামাজের পর প্রথম নামাজে জানাজা শেষে সম্পাদকের কফিনবাহী গাড়ি নেওয়া হলো চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে। সেখানে পুরো চট্টগ্রামের সাংবাদিক সমাজ তাঁকে শ্রদ্ধা জানাল। শেষবারের মতো দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন অনেক সহকর্মী। আমরা লাশবাহী গাড়িকে অনুসরণ করে ছুটে চললাম রাঙ্গুনিয়ার উত্তর পদুয়া গ্রামের উদ্দেশ্যে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ গ্রামের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ তাঁকে শেষ বিদায় জানাতে এসেছেন। শোক ব্যানারে ছেয়ে গেছে পুরো গ্রাম।
তৃতীয় নামাজের জানাজা শেষে সম্পাদককে কবরস্থ করার পালা এবার। অনেক আত্মীয়-স্বজন, নিকটজন। সবাই সম্পাদককে মাটির ঘরে শোয়াতে ব্যস্ত। কাছে যাওয়ার ইচ্ছে নিয়েও যেন দূরে দূরে থাকছিলাম। বৃষ্টির মতোই বারবার অশ্রুধারা নেমে আসছিল। সাহস করে কবরে উঠলাম। সম্পাদকের নিথর দেহ তখন শুইয়ে দেওয়া হয়েছে মাটির ঘরে। উপরে বিছানো হলো বাঁশের বেড়া। এরপর মাটি ঢালা শুরু হলো। বিপরীত দিকে তাকিয়ে আমিও এক খণ্ড মাটির দলা হাতে নিয়ে গুঁড়ো করলাম আর আলতো করে কবরে রেখে দিলাম যেন আমার সম্পাদক ব্যথা না পায়। গুমরে গুমরে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়লাম। জীবনে এত বেশি কোনো দিন কাঁদিনি আমি। কেবল আমি নই, অনেকেই হয়তো কাঁদেননি।
একুশে পত্রিকা সম্পাদক আজাদ তালুকদার স্যার ছিলেন অনন্য অসাধারণ গুণের অধিকারী, একজন মানবিক সাংবাদিক। তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের লড়াকু সাহসী মানুষ। সাংবাদিকতা জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। যিনি মৃত্যু পর্যন্ত সততা, নিষ্ঠা, আর বস্তুনিষ্ঠতার সাথে সাংবাদিকতা করে গেছেন। তাঁর আলো ছড়িয়ে গেছে সমাজে। আলোকিত করে দিয়েছেন আমার মতো অনেককেই। জীবনের শেষ সময়ে এসেও গ্রামের মানুষের জন্য চিকিৎসা সেবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। খুলেছিলেন নতুন একটি সংগঠনও। সেই সংগঠনের ব্যানারে করেছেন বেশ কিছু সেবামূলক কার্যক্রম। তিনি কতটা দায়িত্বশীল মানুষ তা বোঝা যায় অসুস্থ অবস্থায় জীবনের শেষ সময়গুলো পার করছেন হাসপাতালের বেডে শুয়ে অথচ আমার মতো যারা তাঁকে দেখতে আসছেন তাদের সবার ভালো-মন্দের খোঁজ নিচ্ছেন তা দেখে।
তিনি সবসময় বলতেন, একুশে পত্রিকা শেষ ঠিকানা নয়। তোমার কাজই একদিন তোমাকে অনেক বড় জায়গায় নিয়ে যাবে। সেই থেকে কাজকেই ব্রত হিসেবে নিয়েছি। সম্পাদকের মৃত্যুর ৪ মাস পর গত বছরের নভেম্বরে আমি জাতীয় দৈনিক খবরের কাগজ-এর চট্টগ্রাম ব্যুরোর স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে যোগ দিই। তখন থেকে একুশে পত্রিকার সাথে আমার কোনো পেশাগত সম্পর্ক নেই, কিন্তু অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা সম্পর্ক সে যে রক্তের সম্পর্কের চেয়েও ঢের বেশি। সে সম্পর্ক যে কোনো দিন ছিন্ন হওয়ার নয়। ভুলে যাওয়ার নয়। এখনও চেরাগীর দিকে গেলে অফিসে একুশের অফিসে উঁকি মারি, মাঝেমধ্যে একুশে পত্রিকার সাইটে ঢুঁ মারি। দেখি আমার সাবেক সহকর্মীদের লেখাগুলো। আর সম্পাদকের কথাগুলো ভেবে ভেবে মনে সাহস যোগাই। দৃপ্ত পদে শপথ নিয়ে এগিয়ে চলি। মাঝরাতে স্মৃতি খুঁজে ফিরি। আর গুমরে কেঁদে ওঠি।
ভালো থাকুক আমার প্রিয় সাবেক কর্মস্থল, নিপীড়িত মানুষের বজ্রকণ্ঠ হয়ে থাকুক, ওপারে ভালো থাকুন আমাকে এম কে মনির বানানোর কারিগর প্রিয় সম্পাদক আজাদ হোসেন তালুকদার। আপনি আপনার কর্মে-গুণেই আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন, রইবেন বেঁচে অনন্তকাল। আল্লাহ আপনাকে বেহেশতের উচ্চ মাকাম দান করুন। আমিন।
লেখক : প্রাক্তন স্টাফ রিপোর্টার, একুশে পত্রিকা।