সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

সেদিন আমাকে ফিরিয়ে দেননি তিনি

একুশে পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আজাদ তালুকদারের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০২৩ সালের ২ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তাঁর স্মরণে এই লেখা।

প্রকাশিতঃ ২ অগাস্ট ২০২৪ | ৯:৫৪ পূর্বাহ্ন


এম মোয়াজ্জেম হোসেন : ছোটবেলা থেকেই বুকের ভেতর একটা স্বপ্ন লালন করেছি, দেশের জন্য কিছু করবো। সেই স্বপ্ন থেকেই সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার ইচ্ছে নিয়ে জোর প্রস্তুতি শুরু করি। ২০১৩ সালে ৭৪ বিএমএ দীর্ঘ মেয়াদী কোর্সের পরীক্ষায়ও বসি। কিন্তু ভাগ্য বোধহয় আমার স্বপ্নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালো, কমিশন্ড অফিসার হওয়ার স্বপ্ন আমার অধরা রয়ে গেল।

এত পরিশ্রমের পরও ব্যর্থতার গ্লানি আমাকে ভীষণভাবে পেয়ে বসলো। কিন্তু থেমে থাকার মানুষ আমি নই। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হলাম। কিন্তু বড় হওয়ার সাথে সাথে জীবনের চাহিদাও বাড়তে লাগলো, অর্থের প্রয়োজনীয়তা চেপে বসলো। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছি, বড় ভাইয়ের কাঁধ ছাড়া আমার তো আর কোনো ভরসা ছিল না।

অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা শেষ হতেই অর্থের তাগিদে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি নিলাম। সব ঠিকঠাক চলছিল, কিন্তু হঠাৎ এক ঘটনা আমার জীবনকে তছনছ করে দিল। এক বিত্তশালী ব্যক্তি আমার বাবার কিছু জমি জোর করে নিজের নামে করে নিলেন। আমরা আইনি লড়াই শুরু করলাম, পাশাপাশি স্থানীয় দুজন সাংবাদিককে ঘটনা জানালাম, এমনকি কিছু সম্মানিও দিলাম। কিন্তু কোনো খবর প্রকাশ হলো না। হয়তো আইনি জটিলতা ছিল, নয়তো অন্য কোনো কারণ। কিন্তু সেই ঘটনা আমার মনে একটা ক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে দিল। ভাবলাম, এই সমাজে কি অন্যায়ের বিরুদ্ধে কেউ আওয়াজ তুলবে না? আমাদের সাথে যা হলো, আর কত মানুষের সাথে এমন হচ্ছে?

আমার বড় ভাই, এম আনোয়ার হোসেন (কলেজশিক্ষক, লেখক, কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী) আমার এই ক্ষোভ, এই আক্রোশ বুঝতে পেরে বললেন, ‘আজাদ তালুকদারের সাথে দেখা করো। উনি গুণী মানুষ, আমার সাথেও ভালো সম্পর্ক। হয়তো তুমি দেশ ও মানুষের জন্য কিছু করতে পারবে। অন্যরা তোমাকে সাহায্য করেনি, তুমি নিজেই অন্যের পাশে দাঁড়াও।’ ছোটবেলা থেকেই দেশের প্রতি যে ভালোবাসা ছিল আমার, সেই ভালোবাসার টানেই আমি আজাদ ভাইয়ার অফিসে গিয়ে হাজির হলাম। লেখালেখির কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না আমার, তাই একটু ভয়ও করছিলাম।

কিন্তু তিনি আমাকে ফিরিয়ে দেননি। বলেছিলেন, ‘লিখে পাঠাও, দেখব। তবে আগে তোমার বড় ভাইয়ের সাথে দেখা করো, উনি তোমাকে সাহায্য করবেন।’ সেই থেকে শুরু হলো আমার লেখালেখি। শুরুর দিকে অনেক ভুল হতো, কিন্তু তিনি নিজের হাতে সেগুলো শুধরে দিতেন। একজন শিক্ষক যেমন ছাত্রকে আদর করে শেখান, তেমনি করেই তিনি আমাকে সাংবাদিকতা শিখিয়েছিলেন। একজন সম্পাদক হয়েও তিনি ছিলেন আমাদের সহকর্মী, বন্ধু। মাঝে মাঝে বকুনি দিতেন ঠিকই, কিন্তু সেই বকুনিগুলোই ছিল আমার সাংবাদিকতা জীবনের সবচেয়ে বড় পাথেয়। তাঁর বকুনির জন্যই আজ আমি শূন্য থেকে এতদূর আসতে পেরেছি।

তিনি একবার বলেছিলেন, ‘মোয়াজ্জেম, তোমাকে কেউ পরিচিত করিয়ে দেবে না, তোমার কাজই তোমাকে পরিচিত করিয়ে দেবে।’ তাঁর এই কথা আমি আজও মনেপ্রাণে ধারণ করি। চেষ্টা করি অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে, সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে লিখতে, ভালো মানুষের ভালো কাজগুলো তুলে ধরতে। যাতে অন্যরাও অনুপ্রেরণা পায়।

আজাদ ভাইয়ার সাথে কাটানো অল্প সময়ের অসংখ্য স্মৃতি, যা কখনো লেখায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর স্মৃতি চিরকাল আমাদের অন্তরে জাগিয়ে রাখবে সত্য, ন্যায় এবং সাহসের আলো। তিনি বেঁচে আছেন তাঁর কর্মে, তাঁর আদর্শে।

আজ তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। আজ ভাইয়াকে ভীষণ মিস করছি। এই পচা সমাজের জন্য তাঁর মতো মানুষের আরও কিছুদিন থাকা দরকার ছিল। কিন্তু বিধাতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কারো কিছু করার নেই। তিনি যখন চাইলেন, তখনই তাঁকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিলেন। ভালো মানুষ বোধহয় পৃথিবীতে বেশিদিন থাকে না, ভাইয়ার চলে যাওয়াটা তারই প্রমাণ। হে আল্লাহ, তাঁকে আপনার রহমতের ছায়াতলে রাখুন, জান্নাতের উচ্চ মর্যাদায় ভূষিত করুন।

ভাইয়া, আপনি ভালো থাকুন পরপারে। আপনার সৈনিকরা হয়তো আপনাকে ছাড়া অসহায়, কিন্তু তাঁরা আপনার আদর্শকে হৃদয়ে ধারণ করে এগিয়ে চলেছে। তাঁরা থামবে না, কারণ তাঁরা আপনার হাতে গড়া, আপনার আদর্শের কলম সৈনিক।

লেখক : রাঙ্গুনিয়া প্রতিনিধি, একুশে পত্রিকা।