সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

একজন সম্পাদকের ছোঁয়ায় সাংবাদিক হওয়ার গল্প

একুশে পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আজাদ তালুকদারের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০২৩ সালের ২ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তাঁর স্মরণে এই লেখা।

প্রকাশিতঃ ২ অগাস্ট ২০২৪ | ৯:৩৫ পূর্বাহ্ন


মোহাম্মদ বেলাল উদ্দিন : সেই সময়টা ছিল ২০১৬ সাল, চারিদিকে যেন একুশে পত্রিকার ঝড় বইছে! সাহসী সাংবাদিকতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিল পত্রিকাটি। আমি তখন একজন নিবেদিত পাঠক, একুশে পত্রিকার প্রতিটি খবর যেন আমার হৃদয় ছুঁয়ে যেত। অন্যান্য পত্রিকা থেকে এতটাই আলাদা ছিল একুশে, তার প্রতিটি নিউজ আমাকে মুগ্ধ করত, অবাক করত।

এই মুগ্ধতা থেকেই আমার মনে জেগেছিল এক আশা, এক ইচ্ছে – আমিও কি একুশেতে লিখতে পারব? কিন্তু এই আশা, এই আকুতি কাকে জানাবো? অবশেষে ২০২০ সালের ৩ জানুয়ারি, আমার উত্তেজনা যেন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। ফেসবুকে খুঁজে পেয়ে সম্পাদক আজাদ তালুকদার ভাইয়াকে মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করি। আমার আনন্দ যেন তখন দ্বিগুণ হয়ে যায়, যখন স্যার কিছুক্ষণের মধ্যেই উত্তর দেন। একুশেতে কাজ করার আমার আকুল আবেদন শুনে তিনি আমার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চান। আমার অভিজ্ঞতার কথা শুনে তিনি আমাকে অনুসন্ধানমূলক নিউজ পাঠাতে বলেন। আমার বুকের ভেতর তখন আশার আলো জ্বলে ওঠে, স্বপ্ন যেন হাতছানি দেয়।

যাই হোক, আমার উত্তেজনা কমেনি। প্রথম নিউজ হিসেবে আমি লিখে পাঠালাম আমার শৈশবের স্মৃতিময় ছনুয়া কাদেরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ফলাফলের করুণ দশা নিয়ে। স্কুলের কয়েক বছরের ফলাফল বিশ্লেষণ করে আমি লিখেছিলাম সেই প্রতিবেদন। ২০২০ সালের ৫ জানুয়ারি, আমার পাঠানো সেই নিউজটি বাইনেমে প্রকাশিত হয়! এ যেন স্বপ্নের মতো, অবিশ্বাস্য! একুশে পত্রিকায় আমার নিউজ, তাও আবার বাইনেমে! আমার চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। সেদিন আমার বুকের ভেতর এক অন্যরকম অনুভূতি জেগেছিল, এক অনাবিল আনন্দ। যে পত্রিকার আমি একসময় একজন নিয়মিত পাঠক ছিলাম, আজ আমি সেই পত্রিকারই লেখক! এই ভাবনা আমাকে অপার্থিব আনন্দে ভরিয়ে দিয়েছিল।

এরপর থেকে প্রতিদিন নিউজ পাঠাতে লাগলাম। মানসম্মত নিউজ দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই সম্পাদক মহোদয়ের মনে জায়গা করে নিলাম। আমার লেখা প্রতিটি নিউজ যেন আমার হৃদয়ের কথা বলে দিত।

একুশে পত্রিকায় প্রকাশিত নিউজ নিয়ে বাঁশখালীতে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। আমি যোগ দেওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই একুশের নিউজগুলো বাঁশখালীর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। এই সাফল্য আমাকে উজ্জীবিত করেছিল, অনুপ্রাণিত করেছিল আরও ভালো কিছু করার জন্য।

করোনার সেই ভয়ংকর দিনগুলোতে, ২০২০ সালের শুরুর দিকে, একদিন হঠাৎই আমার ফোনে বেজে উঠল বাঁশখালীর চার বারের সাবেক সংসদ সদস্য জাফরুল ইসলাম চৌধুরী সাহেবের গলার আওয়াজ। তিনি অনুরোধ করলেন, তাঁর একটি প্রোগ্রামের খবর একুশে পত্রিকায় প্রকাশ করার জন্য। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা থেকে আমি সেই খবর পাঠিয়েও দিলাম।

কিন্তু পরক্ষণেই সম্পাদক মহোদয়ের ফোন! তাঁর কণ্ঠে ছিল এক ধমকের সুর, ‘বেলাল, এ কী পাঠিয়েছো তুমি? একুশে পত্রিকায় কী ধরনের খবর প্রকাশিত হয়, তা কি তোমার জানা নেই? চাল বিতরণ, ডাল বিতরণ, এগুলো কোনো খবর হয় না। চাল নিতে গিয়ে যদি কোনো মারামারি হয়, সেটাই খবর। মনে রেখো, আজ থেকে আর এ ধরনের খবর পাঠাবে না।’ আমার মনটা তখন কেমন যেন ভয়ে ভয়ে কাঁপছিল।

কিন্তু কিছুক্ষণ পরই একুশে পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে দেখি, শিরোনাম হয়েছে, ‘বিকাশে টাকা নয়, ভালোবাসা পাঠাচ্ছেন বিএনপি নেতা জাফরুল!’ এই খবর দেখে জাফর সাহেবের আনন্দের সীমা ছিল না। তিনি আমাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললেন, ‘বেলাল, তুমি আমার মনের মতো একটি খবর লিখেছ। তোমাকে সবসময় আমার পাশে চাই।’

সেই দিন থেকে আমি আর কখনো চাল-ডাল বিতরণের মতো খবর পাঠাইনি। বুঝতে শিখেছিলাম কোনটা খবর, আর কোনটা নয়। আমার প্রিয় গুরু আজাদ তালুকদারের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত শিখেছি, নিজেকে তৈরি করেছি একজন সত্যিকার সাংবাদিক হিসেবে।

মানুষ তো চিরদিন থাকে না, এটাই নিয়ম। কিন্তু কেউ যদি অকালে চলে যায়, সেই শোক যেন বুকের ভেতর চিরকালের জন্য বাসা বাঁধে। আমাদের প্রিয় আজাদ ভাই, একুশে পত্রিকার সম্পাদক, তিনিও চলে গেলেন না ফেরার দেশে। মাত্র ৪৫ বছর বয়সে মরণব্যাধি ক্যান্সারের কাছে হার মানলেন। তাঁর এই অল্প জীবনে তিনি লিখে গেছেন তিনটি অমূল্য বই – স্বপ্নফেরি, নিগৃহীত সুন্দর, রিপোর্টারের ডায়েরি। এছাড়াও সম্পাদনা করেছেন একুশে পত্রিকা ও দৈনিক আজকের সকাল-সন্ধ্যা। কত অল্প সময়ে কত কিছুই না করে গেলেন তিনি!

যখনই কোথাও নিউজ কাভার করতে যাই, অনেকেই জিজ্ঞেস করে, ‘ভাই, কোন পত্রিকায় কাজ করেন?’ আমি গর্বভরে বলি, ‘একুশে পত্রিকার বাঁশখালী প্রতিনিধি।’ তখনই তাদের চোখে-মুখে একটা আলাদা সম্মান ফুটে ওঠে। ‘একুশে পত্রিকা মানে, আজাদ ভাইয়ের পত্রিকা?’ ‘হ্যাঁ, সেই একুশে।’ এই কথোপকথনের পর আমার প্রতি তাদের শ্রদ্ধা যেন আরও বেড়ে যায়। আজাদ ভাইয়ের নাম, একুশে পত্রিকার নাম, এ দুটোই যেন আমার কাজের মর্যাদাকে দ্বিগুণ করে তোলে।

সত্য আর সাহসের প্রতীক ছিল একুশে পত্রিকা, আর তাঁর হৃদয় ছিলেন আজাদ তালুকদার স্যার। সব দল, সব শ্রেণি, সব পেশার মানুষের কাছে তিনি ছিলেন সমান প্রিয়। তাঁর অনুপ্রেরণায় আমার বুক ভরে যেত সাহসে, যেকোনো সংবাদ করতে পারতাম নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে। আমার প্রিয় সম্পাদক আজাদ তালুকদার সবসময় বলতেন, ‘কারো ভয়ে ভীত হবে না। মনে রাখবে, তুমি আজাদ তালুকদারের সৈনিক।’ এই কথাগুলো আমাকে দিত অসীম সাহস।

কিন্তু ২০২০ সালের ২ আগস্ট, সেই ভয়াল সন্ধ্যা। ছনুয়া আবাখালী থেকে একটি অনুষ্ঠান শেষে ফেরার পথে, হঠাৎই আমার চোখ-মুখ বেঁধে ফেলে একদল নরপিশাচ। ছনুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম. হারুনুর রশীদের সন্ত্রাসীরা আমাকে তুলে নিয়ে যায় এক নির্জন স্থানে। চেয়ারম্যানের কুকীর্তি নিয়ে সংবাদ প্রকাশের প্রতিশোধ নিতে তারা আমাকে অপহরণ করে। সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল, আমার জীবনের শেষ সময় এসে গেছে। কালেমা পড়ে ফেলেছিলাম, মনে হচ্ছিল আর বেঁচে ফিরব না।

কিন্তু আমার প্রিয় সম্পাদক, আমার অভিভাবক আজাদ ভাইয়ের কানে যখন এই খবর পৌঁছায়, তখনই শুরু হয় তুমুল আন্দোলন।

সেদিন তিনি (আজাদ তালুকদার) তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ মহোদয়ের সাথে একটি অনুষ্ঠানে ছিলেন। হঠাৎ সম্পাদক মহোদয়ের বিমর্ষ চেহারা দেখে মন্ত্রী মহোদয় জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কি রে আজাদ কি হলো? তোমার চেহারায় টেনশন টেনশন ভাব দেখাচ্ছে।’ সম্পাদক মহোদয় বললেন, ‘আমার বাঁশখালী প্রতিনিধিকে এইমাত্র অমুক চেয়ারম্যানের লোকজন অপহরণ করে নিয়ে গেছে।’

এরপর মন্ত্রী মহোদয় চট্টগ্রামের তৎকালীন পুলিশ সুপার রশিদুল হককে নির্দেশ দিলেন আমাকে দ্রুত সময়ের মধ্যে জীবিত উদ্ধার করার জন্য। মাত্র এক ঘন্টার মধ্যে র‌্যাব ও পুলিশের সহায়তায় আমাকে উদ্ধার করা হয়েছিল। একজন আজাদ তালুকদার; যিনি তাঁর কর্মীর বিপদে নির্ঘুম রাতযাপন করেছিলেন। রাগের বশে বলে ফেলে ছিলেন, ‘আমার প্রতিনিধির গায়ে হাত দেওয়া এই চেয়ারম্যানকে আমি ছাড়বো না।’

আমার অপহরণের ঘটনার আগে ও পরে এক সপ্তাহ চট্টগ্রামের স্থানীয় পত্রিকাগুলোর প্রকাশনা বন্ধ ছিল। দৈনিক আজাদীর এক সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের সাংবাদিকরা পত্রিকাটির মালিকের বাসভবন ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেন। এরপর একযোগে চট্টগ্রামের চারটি পত্রিকার প্রকাশনা এক সপ্তাহ বন্ধ রাখে মালিকপক্ষ। সময়টিতে শুধু চট্টগ্রামের দৈনিক সাঙ্গু পত্রিকার প্রকাশনা চালু ছিল। আমাকে অপহরণের ঘটনাটি চট্টগ্রামের পত্রিকা সাঙ্গু ছাড়াও প্রথম সারির বিভিন্ন নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত হয়। এছাড়াও জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক আমাদের সময়, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক কালের কন্ঠে গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ হয়। ফলে চারিদিকে নিন্দার ঝড় উঠে। তোপের মুখে পড়েন ছনুয়া ইউপি চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ।

গেল বছরের ২ আগস্ট আমার মনে হয় মাথায় ভেঙে পড়েছিল পাহাড়। আমার আশা ছিল সম্পাদক মহোদয় সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরবেন। ২০২০ সালের ২ আগস্টে আমাকে অপহরণের ঘটনা নিয়ে ওনার কাছে স্মৃতিচারণ করবো। কিন্তু না। আমার ওপর ঘটে গেল আরেক ট্রাজেডি। ঘড়ির কাঁটায় তখন ভোর ৫টা বেজে ৫ মিনিট। বার্তা সংস্থা ইউএনবির চট্টগ্রাম প্রতিনিধি, সিনিয়র সাংবাদিক সাইফুল ইসলাম শিল্পী ভাই ফোন করে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললেন, ‘বেলাল আজাদ তো আর নেই। কিছুক্ষণ আগে আমার বন্ধু শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে।’ মনকে বুঝাতে পারছিলাম না। কেমনে কী হলো! মনে হচ্ছিল মাথায় পাহাড় ধসে পড়েছে।

আমাদের জাতির জন্য, আজাদ স্যারের আরও কিছুদিন বেঁচে থাকাটা ছিল অপরিহার্য। চট্টগ্রামের সাংবাদিকতার মুকুটে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে উজ্জ্বল রত্ন, একুশে পত্রিকার আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার পেছনে ছিল তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম।

আমাকে বলতেন, ‘বেলাল, বাঁশখালীর আনাচে-কানাচে কত খবর লুকিয়ে আছে! তোমার লেখার হাত তো অসাধারণ, তুমি পারো বাঁশখালীকে নাড়িয়ে দিতে। শুধু একটু আলসেমি ঝেড়ে ফেলো। তোমার কিছু হলে আমি আছি তো, যেমন তোমাকে অপহরণের সময় বাঁচিয়েছিলাম।’

কিন্তু সেই আশ্বাস, সেই উৎসাহ আর কখনো শুনতে পাব না। তিনি আর ফিরবেন না আমাদের মাঝে, আর বকাঝকাও করবেন না। প্রিয় মানুষটির চলে যাওয়ার শূন্যতা আমাকে প্রতি মুহূর্তে কাঁদায়। তবুও, মানুষ আজও তাঁকে ভোলেনি। তিনি যেন মৃত্যুকে হারিয়ে অমর হয়ে আছেন। যেখানেই যাই, মানুষ বলে, ‘তোমার সম্পাদক আজাদ তালুকদার, তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের সাহসী মানুষ। চট্টগ্রামের সাংবাদিকতায় আর কত জনই না আসবে, কিন্তু আজাদ তালুকদারের মতো কেউ আসবে না। এখন কে দেখে একুশে পত্রিকা?’ চট্টগ্রামের সাংবাদিকতার এই বটবৃক্ষের শূন্যতা কি আর কখনো পূরণ হবে?

সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে আমার একটাই প্রার্থনা, আমার প্রিয় গুরু আজাদ তালুকদারকে তিনি যেন জান্নাতুল ফেরদৌসে শান্তিতে রাখেন। আমিন।

লেখক : বাঁশখালী (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি, একুশে পত্রিকা।