পরকালে যেন তোর সাথে আমার দেখা হয়


নাসরিন সুলতানা মুন্নী : পরকালে যেন সবার আগে তোর সাথে আমার দেখা হয়, আমার পরম প্রিয় ছোট ভাই আজাদ! আমাদের আট ভাই-বোনের মধ্যে তুই ছিলি সবার ছোট, আমাদের ঘর আলো করে আসার সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আজও আমার চোখে ভাসে। ছোট্ট ভাইয়ের জন্মের খবরে আমার আনন্দ যেন আকাশ-পাতাল ছুঁয়েছিল। তোকে প্রথম দেখাতেই আমার মনে হয়েছিল, যেন তোর সাথে আমি এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা, হয়তো এটাই আল্লাহর অপার করুণা।

সম্পর্কে তোর বড় বোন হলেও, তোর সাথে আমার সম্পর্কটা ছিল বন্ধুত্বের চেয়েও গভীর। ছোট থেকে বড় হওয়ার পথে তুই সবকিছুতে আমাকেই খুঁজতিস, আমার প্রতি তোর টান আমার চেয়েও বেশি ছিল, তোর প্রতিটি কথায়, প্রতিটি আচরণে আমি তা অনুভব করতাম।

তোর সাংবাদিক হয়ে ওঠার পথের প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি বাঁক আমার চোখের সামনে ভাসে যেন এক স্বপ্নের মতো। খালপাড়ের আহসান মঞ্জিল থেকে টেক্সটাইলের সেই বাসা– এই দীর্ঘ পথচলায় তোর পরিশ্রম, তোর উদ্যম আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে। মনে হয় এই সেদিনই দেখেছি তোকে, পত্রিকায় নিউজ দেওয়ার জন্য রাতের পর রাত জেগে, হাজারো ক্লান্তি আর যন্ত্রণা সয়ে মধ্যরাতে বাসায় ফিরতে, আবার ভোর হতে না হতেই লাইভের জন্য ছুটতে।

টিভির পর্দায় তোকে দেখে আমার বুকটা গর্বে ভরে যেত, খুশিতে মনটা আনন্দে নেচে উঠত। তোর প্রতিটি লাইভের আগে আমাকে জানাতিস, আর আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকতাম। টিভির পর্দা থেকে চোখ সরাতে পারতাম না, মনে হতো যেন তোর সাথে সাথে আমিও সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। এগুলো কি আর ভোলা যায়, আমার প্রাণের ভাই? এসব স্মৃতি কি আর কখনো মুছে যাবে আমার মনের পর্দা থেকে?

বোন হিসেবে আমার যোগ্যতা কতটুকু, তা আমার নিজেরও অজানা। তবুও তুই, আমার পরম আদরের ভাই, মন্ত্রী, এমপি, মেয়র থেকে শুরু করে সকলের সামনে আমাকে গর্ব করে পরিচয় করিয়ে দিতিস। আমি তো তোর গর্ব করার মতো কিছুই করতে পারিনি, তবুও তুই আমাকে এত সম্মান, এত মর্যাদা দিয়েছিস! পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে বলতিস, ‘এ আমার বোন।’ তোর বোন হতে পারাটা আমার জীবনের পরম সৌভাগ্য, আমার পরম প্রাপ্তি!

সাংবাদিকতার জগতে তুই ছিলি এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যে নক্ষত্রের আলো কখনো ম্লান হবে না। তোর মতো সততা, ন্যায়পরায়ণতা, নিষ্ঠা, পক্ষপাতহীন সাংবাদিক কি এই পৃথিবীতে আর কেউ আছে? তোর তুলনা তুই নিজেই, আমার হৃদয়ে তুই ছিলি সবার সেরা, আছিস, এবং আজীবন থাকবি।

নানা প্রতিকূলতার ঝড়-ঝাপটায়ও তুই, আমার বীর ভাই, তুই লক্ষ্যের পথে অটল ছিলি। নিজের স্বার্থকে তুচ্ছ করে তুই হয়ে উঠেছিলি পরোপকারের প্রতীক, অসহায় মানুষের জন্য তুই ছিলি আশীর্বাদের ফেরেশতা। তোর কাছে কেউ এসে খালি হাতে ফিরেছে, এমনটা আমি কখনো দেখিনি। অন্যের জন্য এতটা নিঃস্বার্থ কেউ হতে পারে, এটা ভাবতেই আমার বুকটা গর্বে ভরে ওঠে।

কিন্তু অন্যের জন্য নিজেকে এভাবে বিলিয়ে দিতে গিয়ে তুই নিজের কথা ভাবতেই ভুলে গিয়েছিলি, আমার প্রাণের ভাই। ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলেছিলি নিজের শরীরকে। সবসময় তোকে তাগাদা দিতাম নিজের খেয়াল রাখতে, সময়মতো খেতে, কারণ শরীর তো আর পরোপকার বোঝে না। নিজের শরীরের জন্য একটু স্বার্থপর হলে কি খুব দোষের হতো, ভাই?

শেষবার তোকে সামনাসামনি দেখেছিলাম হজ্বে যাওয়ার আগে, আমার প্রিয় ভাই। ক্যান্সারের যন্ত্রণায় কাতর হয়েও তোর মুখে ফুটেছিল সেই চিরচেনা কোমল হাসি। তোর সাথে দেখা করে যাওয়ার পর থেকে আমার মনটা কেঁদে কেঁদে ফুলে উঠেছিল, ছটফট করছিল অস্থিরতায়। দেশের বাইরে থাকলেও আমার মনটা তোর কাছেই ছিল, দেশের মাটিতে। সেই সময় তোর সাথে ফোনে কথা হতো, কিন্তু যন্ত্রণার কথা তুই আমাকে বলতি না, আমি যেন কষ্ট না পাই।

আমার মেয়ে অন্তরার কাছেই শুনেছিলাম, হজ্বে থাকার সময় অন্তরা যখন তোকে আমার সাথে ভিডিও কলে কথা বলিয়ে দিতে চেয়েছিল, তখন তুই তাকে বলেছিলি, ‘অন্তরা, তুই কি তোর মাকে মেরে ফেলতে চাস? তোরা কি মা হারাতে চাস? আমাকে এভাবে দেখলে তোর মা সহ্য করতে পারবে না।’ মৃত্যুর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েও তুই আমাকে বাঁচাতে চেয়েছিলি, আমার কষ্টের কথা ভেবেছিলি। ভাই, কেন এত ভালোবাসতিস এই তোর বোনকে?

হজ্বের পবিত্রতা নিয়ে ২০২৩ সালের ১ আগস্ট রাত সাড়ে বারোটায় চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে পা রেখেই আমার মন ছুটে গিয়েছিল তোর কাছে, আমার প্রিয় ভাই। সারারাত প্রস্তুতি নিয়ে ফজরের নামাজের পরই তোকে দেখতে হাসপাতালে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই, আমার ছেলে সম্রাটের কাছে তোর মৃত্যুর সংবাদ শুনে আমার বুকটা যেন ফেটে চৌচির হয়ে গেল।

কারো মৃত্যুতে আমি কান্না আটকে রাখতে পারি না, কিন্তু তোর মৃত্যুসংবাদ শুনে আমি যেন পাথর হয়ে গেলাম। চোখের পানি তো দূরের কথা, চোখের পলক পর্যন্ত পড়ছিল না। আমার রক্তমাংসের শরীর যেন এক নিথর প্রস্তরখণ্ডে পরিণত হয়েছিল।

কিন্তু তোর মুখ দেখে আমার মনে হলো, জান্নাতি মানুষের চেহারা সত্যিই মৃত্যুর পর আরও সুন্দর হয়ে যায়। তোর মুখে ছিল এক মৃদু হাসি, চেহারায় এক অপার্থিব জ্যোতি। মনে হচ্ছিল যেন ২৩ বছরের তরুণ আজাদকে দেখছি, আমার সেই আদরের ছোট ভাইকে।

তুই চলে যাওয়ার পর, আমার প্রাণের ভাই, আমি যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি। মন বসে না কোনো কাজে, খেতে ইচ্ছে করে না, কারও সাথে কথা বলতেও মন চায় না। বেঁচে থাকার আশা যেন মুছে গেছে তোর চলে যাওয়ার পর থেকে। প্রতিটি মুহূর্তে তোর কথা মনে পড়ে, আর অঝোরে অশ্রুধারায় চোখ ভরে ওঠে। কোনো অলৌকিক শক্তি যদি তোকে ফিরিয়ে আনতে পারত, আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে দিতাম, এমনকি আমার জীবনও!

প্রতি ওয়াক্তের নামাজের দোয়ায় তুই থাকিস, আমার প্রাণের টুকরো। দোয়াটা কি জানিস, আজাদ? পরকালে যেন সবার আগে তোর সাথে আমার দেখা হয়। আল্লাহ চাইলে আমরা আবার একসাথে হবো, ইনশাআল্লাহ। কিন্তু আজ, তোর মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাকে এমন কিছু লিখতে হবে, তা কখনো ভাবিনি। যেখানেই থাকিস, ভালো থাকিস আমার ভাই। আল্লাহ তোকে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থান দান করুন। আমিন।

লেখক : একুশে পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আজাদ তালুকদারের বড় বোন।