আজাদ ভাইয়াকে ভোলা সম্ভব নয়


সঞ্জয় দেবনাথ :

ভাইয়া,

এক বছর হয়ে গেল আপনি চলে গেছেন। চলে গেছেন মানে চলেই গেছেন, ফিরবেন না আর কোনোদিন। মেসেজ লিখতে ইচ্ছে করে, কিন্তু জানি, কোনো উত্তর আসবে না। অথচ আগে লিখলেই কী অপূর্ব সাহস আর বিনয় নিয়ে উত্তর দিতেন! ফোন করলেই প্রথমেই স্পষ্ট উচ্চারণে বলতেন, ‘সঞ্জয়, কেমন আছো ভাই? তোমার মা কেমন আছেন?’

নিজে ক্যান্সারের কবলে পড়ার পরও আমার দুঃসময়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। এমন কোনো বিপদ কি আমার জীবনে এসেছে, যেটা আপনাকে বলেছি আর আপনি সাধ্যমতো সাহায্য করেননি? মনে করতে পারছি না।

আমার বাবার ক্যান্সারের কথা শুনে আপনি কী যে আফসোস করেছিলেন! আপনার সমবেদনায় কোনো ভণিতা ছিল না, ছিল শুধু সত্যিকারের দুঃখ। আপনার মাকে নিয়ে লেখাগুলোতে কত যে মমতা, কত যে ভালোবাসা! দুনিয়াতে মা-ভক্ত সন্তানরাই বোধহয় সবচেয়ে বেশি কষ্ট পায়, তাই না ভাইয়া?

সেই মাসিক একুশে পত্রিকার দিনগুলো থেকেই যেন শুরু! সাপ্তাহিক হওয়ার পর আমার কত লেখাই না আপনি জায়গা করে দিয়েছিলেন একুশে পত্রিকার পাতায়। কত উৎসাহ, কত অনুপ্রেরণা! আর সেই উৎসাহেই আমার সর্বনাশ করে দিলেন আপনি! লেখার নেশায় আমাকে বেঁধে ফেললেন। লেখার জন্য পড়ার নেশাও ধরিয়ে দিলেন। সেই নেশায় বুঁদ হয়ে লিখেছি, কত কত পত্রিকায় ছাপা হয়েছে আমার লেখা। আপনি মানুষের প্রশংসা করতে জানতেন, উৎসাহ দিতে জানতেন- এই পচনশীল সমাজে যে গুণ এখন বিরল! আপনার সম্মোহনী ব্যক্তিত্বের জাদুতে যে কাউকেই আপন করে নিতে পারতেন, যেটা সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে।

মনে পড়ে, বোনের বিয়ের কার্ড নিয়ে একুশে অফিসে গিয়েছিলাম। আপনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘আমি পুরো টিম নিয়ে আসবো। একা একা কোথাও যেতে পারি না।’ দাওয়াত রক্ষা করেছিলেন, ব্যস্ততার মাঝেও এসেছিলেন। যতক্ষণ ছিলেন, আড্ডায়, হাসিতে মাতিয়ে রেখেছিলেন সবাইকে। পত্রিকার পুরো টিমকেই আপনি আপনার পরিবার বলে মনে করতেন। চিফ রিপোর্টার রুকন ভাই বিয়েতে আসেননি দেখে আপনি বলেছিলেন, ‘রুকনকে ফোন দাও আসার জন্য,’ আর নিজের হাতে দিয়েছিলেন ফোন নম্বর। আহা, কী অপূর্ব সেই দিনগুলো!

সেই দেখাই যেন শেষ দেখা হয়ে গেল, ভাইয়া! হয়তো তখনই কাল মৃত্যু আপনাকে গ্রাস করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল ভিতরে ভিতরে।

কী নিষ্ঠুর এই বাস্তবতা! আমার বোনও আজ ক্যান্সারের কবলে। জীবন-মৃত্যুর দোলায় দুলছে তার অস্তিত্ব। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু চিকিৎসা শুরু হতেই দেরি হয়ে গেল। আপনি বেঁচে থাকলে, আমাদের অন্য সব দুঃসময়ের মতো এবারও এগিয়ে আসতেন, পাশে দাঁড়াতেন।

ক্যান্সার আপনাকে কেড়ে নিল আমাদের কাছ থেকে, আমার বাবাকেও কেড়ে নিয়েছিল। আমরা সবাই তো একদিন চলে যাব, শুধু সময়ের স্রোতে কিছু স্মৃতির ছাপ রেখে। আপনিও রেখে গেছেন সেই ছাপ, ভাইয়া। পরম করুণাময় আপনাকে ভালো রাখুন। আপনাকে ভোলা সম্ভব নয়, মানুষের জন্য যারা ভাবেন, তাঁদের ভোলা যায় না।

সঞ্জয় দেবনাথ, ফটিকছড়ি থেকে