ইমরান এমি : আজাদ তালুকদার ছিলেন একজন প্রতিভাবান ও সাহসী সাংবাদিক। তাঁর খ্যাতি অনেক আগেই ছড়িয়ে পড়েছিল। আমি তাঁকে স্পষ্টবাদী ও সাহসী সাংবাদিক হিসেবেই চিনতাম। যদিও তখন তাঁর সঙ্গে আমার সরাসরি যোগাযোগ ছিল না, তবু তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক একুশে পত্রিকার নিয়মিত পাঠক ছিলাম।
একুশে পত্রিকা সে সময়কার রাজনীতি ও অন্যান্য সামাজিক ইস্যুতে নিজস্ব ধারা প্রবর্তন করে পাঠক মহলে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। একুশে পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায় তাঁর সাহসী ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার নিদর্শন স্পষ্ট হয়ে উঠত। বর্তমানের এই দলীয় মতবাদের যুগে তাঁর মতো সাহসী ও স্পষ্টবাদী সাংবাদিক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
চট্টগ্রাম শহরে সাংবাদিকতা করার সুবাদে আজাদ তালুকদারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। দূর থেকে যতটা সাহসী ও স্পষ্টবাদী ভেবেছিলাম কাছে থেকে তাঁকে আরও বেশি করে চিনেছি। সাহসী ও স্পষ্টবাদী হওয়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ মানবিক ব্যক্তিত্ব।
করোনাকালে যখন চাকরি হারিয়ে বেকার জীবনযাপন করছিলাম, তখন আজাদ ভাই নিজ উদ্যোগে আমাকে একুশে পত্রিকায় কাজ করার সুযোগ দিয়েছিলেন। সে সময়ও একুশে পত্রিকা অনলাইনে এবং সাপ্তাহিক সংস্করণে সমানতালে প্রভাব বিস্তার করে চলছিল। কাজের সুবাদে নানা বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হতো তাঁর সঙ্গে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি কখনোই আপস করতেন না, সে যেই হোক না কেন। স্পষ্ট কথায়, জোরালো যুক্তিতে যে কারও মনেই কাঁপন ধরিয়ে দিতে পারতেন এই সুদর্শন ও দীর্ঘদেহী মানুষটি।
একুশে পত্রিকায় কাজ করার সময় বা তার পরেও, আজাদ তালুকদার আমার কাছে কখনোই শুধু একজন সম্পাদক ছিলেন না, ছিলেন একজন বড় ভাইয়ের মতো। নানা সময়ে তিনি আমাকে পরামর্শ ও সাহস দিয়েছেন। সংবাদ পরিবেশনের নানা কৌশল শিখেছি তাঁর কাছ থেকে। বিশেষ করে সুপ্রভাত বাংলাদেশ পত্রিকায় কাজ করার সময় তৎকালীন চীফ রিপোর্টার ভূঁইয়া নজরুল ভাইয়ের কাছে যেমন শিখেছিলাম, একটি সংবাদকে কীভাবে বিভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করা যায়, পাঠককে কীভাবে আকৃষ্ট করা যায়, আজাদ ভাইয়ের কাছ থেকে সেই শিক্ষাকে আরও পাকাপোক্ত করেছি।
আজাদ ভাই সবসময় বলতেন, ‘সংবাদের উপাদান যদি নিজের রক্তের ভাইও হয়, তাকেও ছাড় দেওয়া যাবে না।’ অপরাধীর সামনে দাঁড়িয়ে সত্য বলার যে সাহস তাঁর মধ্যে দেখেছি, তা আমার ব্যক্তিগত জীবনেও গভীর প্রভাব ফেলেছে।
একুশে পত্রিকায় মাস ছয়েক কাজ করার পরেও আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। অসুস্থ হওয়ার আগে, করোনা মহামারীর সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। করোনা আক্রান্ত সহকর্মী সাংবাদিকদের উৎসাহ, অনুপ্রেরণা ও সাহস যুগিয়েছেন নিজের জীবনকে বিপন্ন করেও।
তিনি যখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তখন একুশে পত্রিকার রিপোর্টার আবছার রাফির মাধ্যমে নিয়মিত খোঁজখবর নিতাম। ভারতে চিকিৎসা শেষে ঢাকায় যখন চিকিৎসা নিচ্ছিলেন, নানা কাজের চাপে দেখা করতে যেতে পারিনি। যেদিন যাওয়ার সব ঠিকঠাক করে রাফিকে জানালাম, সেদিনই, দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তিনি না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন। এই খবর শুনতে মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। শেষ দেখাটুকুও আর হলো না। তাঁর কাছ থেকে শেখা কথাগুলো, ‘অপরাধীর সামনে দাঁড়িয়ে শির উঁচু করে সামনাসামনি সত্য বলতে হবে,’ সেগুলো আর বলার সুযোগ হলো না।
তাঁর মরদেহ যখন চট্টগ্রামের জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ ময়দানে জানাজার জন্য আনা হলো, সেদিন দেখেছি প্রতিকূল আবহাওয়াকে উপেক্ষা করে দলমত নির্বিশেষে সবাই এসেছিলেন এই সাহসী সাংবাদিককে শেষ বিদায় জানাতে। একজন সাংবাদিক কীভাবে সবার কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারেন, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ তিনি।
আজাদ তালুকদার আজ আমাদের মাঝে নেই, তবে তিনি বেঁচে আছেন সাহসী ও স্পষ্টবাদী তরুণ সাংবাদিকদের মাঝে। যারা নীতি ও আদর্শকে সমুন্নত রেখে সাংবাদিকতাকে লালন করেন, স্পষ্টতা ও সাহসিকতার সঙ্গে এগিয়ে যেতে চান, তাঁদের কাছে আজাদ তালুকদার অনুকরণীয়, উজ্জ্বল এক দৃষ্টান্ত।
লেখক : স্টাফ রিপোর্টার, বাংলাদেশ প্রতিদিন, চট্টগ্রাম ব্যুরো।