আব্দুল আলী : আগস্ট এলেই যেন আমাদের জাতীয় শোকের ঘনঘটা নেমে আসে। আহা, এই আগস্ট, কত যে শোকের আগস্ট! এই মাসের দ্বিতীয় দিনেই চলে গিয়েছিলেন আমাদের প্রিয় আজাদ ভাই, একুশে পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। শুধু এই দিন নয়, প্রায়ই তাঁর কথা মনে পড়ে, বুকটা হাহাকার করে ওঠে।
আমার তো প্রায়ই জমিয়তুল ফালাহর পাশ দিয়ে যাওয়া-আসা হয়। কত যে আড্ডা হয়েছে ওই মসজিদের সিঁড়িতে! বৃষ্টি নামলেই মনে পড়ে যায় সেই করুণ দৃশ্য– আজাদ ভাইয়ের লাশ নিয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা, তাঁর নিথর দেহ ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছে… বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যেন শোকের অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়ে। গত বছর এই দিনেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। কী নির্মম স্মৃতি! মনে পড়লেই বুকটা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
ওই দিন জমিয়তুল ফালাহ মসজিদে অপেক্ষার প্রহরগুলো যেন শেষ হতে চাইছিল না। শ্রাবণের বৃষ্টি যেন কাঁদছিল আকাশ ফুঁড়ে। একদিন আগেও প্রচণ্ড গরমে জনজীবন বেহাল, আর আজ বৃষ্টির শোকে সিক্ত সারা নগরী। যেন প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা করার ব্যাকুলতা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে এই মুষলধারে। সেই প্রিয়জন, আমাদের আজাদ ভাইয়া, সেদিন নিজের শহরে এসেছিলেন লাশ হয়ে।
এক বছর হয়ে গেল, আজাদ ভাই আর নেই। তবু তাঁর স্মৃতি, তাঁর কাজের ছাপ যেন পত্রিকার পাতায় পাতায়, অফিসের প্রতিটি কোণায় ধ্বনিত হচ্ছে। প্রতি রোববার কাজের সূত্রে অফিসে যেতে হয়, সারাদিন কাজের ব্যস্ততায় কাটে। মাঝেমধ্যেই খুকি মাসির চোখের পানি দেখি, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন তিনি। আমাকে সম্পাদকের কথা বলতে বলতে আবেগে ভেসে যান। তবে আজাদ ভাই কখনো খুকি মাসিকে শুধু কাজের লোক ভাবেননি, ভেবেছেন একজন মায়ের মতো। মাসির পরিবারের সব খোঁজখবর রাখতেন, কোনো সমস্যা হলে সবার আগে এগিয়ে আসতেন সমাধান করতে। শুধু মাসির ক্ষেত্রেই নয়, অফিসের সবার প্রতিই তাঁর এই মমতাময় আচরণ ছিল, যেন নিজের পরিবারের সদস্য।
২০১৯ সালের শেষের দিকের কথা। আমি তখন সুপ্রভাত ছেড়ে বাংলাধারায় কাজ করছি। একুশে পত্রিকার অফিসে এক মিটিংয়ে আজাদ ভাইয়ের সাথে অনেক কথা হলো। সেদিন তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আলী, চাকরি ছেড়ে দিয়েছো কেন?’ আমি বলেছিলাম, ‘চার মাস বেতন বাকি, এভাবে কি চলে ভাইয়া?’ তিনি তখন বলেছিলেন, ‘বাংলাধারা যেহেতু সকাল থেকে করছো, আমার এখানে সন্ধ্যা থেকে সময় দাও।’ সেই থেকেই আমি একুশে পত্রিকার সাথে যুক্ত হয়েছিলাম। মাঝখানে করোনার কারণে কিছুদিন কাজ বন্ধ ছিল। পরে ২০২২ সালে আবার একুশেতে ফিরে আসি। সেই থেকে আজ অব্দি একুশেতেই আছি। আজও একুশে পত্রিকা আছে, নিয়মিত প্রকাশিত হয়, কাজ চলছে। কিন্তু গত এক বছর ধরে আজাদ ভাইয়ের পদধ্বনি নেই, বিচরণ নেই, সেই গান-আড্ডার আসর নেই- সবকিছুই মিস করছি। মাঝে মাঝে স্মৃতিগুলো এসে মনকে নাড়া দিলে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ি।
ভাইয়া বেড়াতে ভীষণ ভালোবাসতেন, মাছ ধরা তো তাঁর নেশার মতোই ছিল। এমনকি মাছ ধরার জন্য জালও কিনেছিলেন। কোথাও বেড়াতে গেলে সেখানকার কোনো পরিচিতজনের পুকুরে জাল নিয়ে মাছ ধরতে নেমে পড়তেন। একবার পারকিতে বেড়াতে গিয়ে তাঁর এই মাছ ধরার নেশা আমি নিজের চোখেই দেখেছি। আড্ডা আর গানে যে কোনো আসরকে জমিয়ে তুলতে পারতেন তিনি। সহকর্মীদের সাথে এভাবে আড্ডা দিতে খুব কম মানুষকেই দেখা যায়। ঘুরতে গেলেও নানা সংবাদের আইডিয়া নিয়ে ভাবতেন। এমনকি অনেক সময় বসে বসেই সংবাদ লিখে ফেলতেন।
প্রায়ই দর্শনীয় জায়গায় ট্যুর দিতেন। যাওয়ার সময় গাড়িতে আঞ্চলিক গান, শ্রীকান্ত আচার্য, মান্না দের গানে মাতোয়ারা হয়ে যেতেন। পথে কোনো সংবাদের আইডিয়া মাথায় এলেই সাথে সাথে কাউকে না কাউকে সেই দায়িত্ব দিয়ে দিতেন। বলতেন, ‘ভ্রমণে গিয়ে সবাই একটি করে সংবাদ তৈরি করতে পারলে ভালো হয়।’ এতে সহকর্মীরাও উৎসাহ নিয়ে নিজেদের মতো করে সংবাদ খুঁজে বের করার চেষ্টা করতেন।
প্রত্যেক মানুষেরই কিছু স্বতন্ত্র গুণ থাকে, যা তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করে। আজাদ ভাইয়েরও ছিল কিছু অনন্য গুণ, যার কারণে তিনি মিডিয়া পাড়া ও সমাজে আলাদা মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। সবাইকে সমান চোখে দেখা, সময়ের কাজ সময়ে ও সঠিকভাবে সম্পন্ন করা, কাউকে ছোট করে না দেখা, নিজের ওপর আস্থা রাখা- এই গুণগুলো তাঁকে অনন্য করে তুলেছিল। সাহসিকতা ছিল তাঁর অন্যতম প্রধান গুণ।
একটি পত্রিকার নিরপেক্ষতা ও সাহসিকতা নির্ভর করে সম্পাদকের ওপর। আজাদ ভাইয়ের সাহসিকতার কারণেই একুশে পত্রিকা মানুষের আস্থা অর্জন করেছিল। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে একুশে পত্রিকা অর্জন করেছিল বিপুল পাঠকপ্রিয়তা। এটি সম্ভব হয়েছিল তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম ও সাহসিকতার ফলে।
আজাদ ভাইয়ের লেখন শৈলী ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। লেখার প্রতি তাঁর আগ্রহ ও দক্ষতা ছিল প্রবল। তাঁর সংবাদ, ফিচার, ভ্রমণ কাহিনী, গল্প সবকিছুতেই ফুটে উঠত তাঁর লেখার প্রতিভা। ‘নিগৃহীত সুন্দর’ ও ‘রিপোর্টারের ডায়েরি’ হলো তাঁর অনন্য সৃষ্টি। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর লেখা ও বইগুলো আজও মানুষ পড়ে, তাঁর সৃষ্টিকে স্পর্শ করে। এই সৃষ্টিগুলো আজও কথা বলে, যদিও স্রষ্টা আজ অদৃশ্য, পরপারে। একুশে পত্রিকা ও তাঁর লেখা বইগুলো তাঁর সন্তানের মতো, তারা আজও বেঁচে আছে, কথা বলে।
লেখক : সহ-সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।