স্মৃতির পাতায় আজাদ ভাইয়া


শরীফুল রুকন : প্রিয়জনের চলে যাওয়ার শোক যে কতটা অপরিসীম, তা বলে বোঝানো যায় না! আপনজন হারানোর পর যে শূন্যতা, সেই ক্ষত যেন কখনো শুকাবে না! আমার বুকের ভেতরও এখন সেই একই শূন্যতা, সেই একই ক্ষত! গত বছর, ২ আগস্টের সেই ভোর! ঠিক ৪টা ১১ মিনিট! আমার পরম শ্রদ্ধেয় আজাদ ভাইয়া, আমার প্রিয় সম্পাদক, যেন আমার বুকের ভেতর থেকে এক টুকরো ছিঁড়ে নিয়ে চলে গেলেন! তাঁর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে আমি তখন বাকরুদ্ধ!

একুশে পত্রিকার অনলাইনে তাঁর ‘শোক সংবাদ’ লেখার সময় বুকটা যেন ফেটে যাচ্ছিল! কম্পিউটারের কিবোর্ড যেন আর চলতে চাইছিল না, মনে হচ্ছিল যেন নিজের হাতেই কবর খুঁড়ছি! কী লিখছি এসব! কেন লিখছি এসব!

জানি, জন্মের পর থেকেই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা সবাই। সময় যেন কখনো থামে না, শুধু ফুরিয়েই যায়। কাল কী হবে, কেমন লাগবে, এই অনিশ্চয়তার সাগরে আমরা সবাই ভেসে চলেছি।

ভাইয়ার সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি স্মৃতি এখন যেন আমার বুকের ভেতর এক একটা কাঁটা! চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই সুখের দিনগুলো, আর বুকের ভেতরটা যেন ছিঁড়ে যায়! মনে হয়, এই তো সেদিন! সবকিছু ছিল এত সুন্দর! এত আনন্দে ভরা!

আজাদ ভাইয়ার সাথে প্রথম দেখা ২০১৩ সালের দিকে, অনেক আগের কথা! তবে ২০১৫ সালের একটা ঘটনার পর থেকে আমাদের যোগাযোগ অনেক বেড়ে যায়। সেই বছরের ৮ জুন চট্টগ্রাম বন্দরে সূর্যমুখী তেলের চালানের আড়ালে কোকেন আনার ঘটনা কাভার করতে আমি বন্দরে গিয়েছিলাম। একাত্তর টেলিভিশনের হয়ে সেই ঘটনা কাভার করতে আজাদ ভাইয়াও ছিলেন। তখন আমি বাংলামেইলে কাজ করি।

টিভি চ্যানেলের লাইভ আপডেট চলার মাঝে, হঠাৎ আমার চোখ আটকে গেলো এক চেনা মুখে। গোয়েন্দা কর্মকর্তা! তাঁর ইশারায় আমার বুকের ভেতর এক উত্তেজনা। কাছে যেতেই যেন এক গোপন বার্তা আমার কানে এসে লাগলো- কোকেন উদ্ধারের ঘটনায় এতজন আটক আছে, জিজ্ঞাসাবাদ চলছে! এই তথ্য, যেন আমাকে এক অন্য জগতে নিয়ে গেলো। সাংবাদিকদের মধ্যে আমি, শুধুই আমি, ওই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় খবরের একমাত্র ‘সোর্স’!

গোপন তথ্যটা যেন এক ঝলকে আজাদ ভাইয়ার কানে ফিসফিস করে বললাম। মুহূর্তের মধ্যেই তিনি একাত্তর টিভির লাইভে সেই খবর দিয়ে দিলেন, যেন একটা বোমা ফাটিয়ে দিলেন সংবাদমাধ্যমে। সব সাংবাদিক তাঁকে ঘিরে ধরলেন, তথ্যের উৎস জানতে উদগ্রীব হয়ে, কিন্তু তিনি যেন এক নির্বাক পাথরের মূর্তি। পরে যখন আমার কাছে তথ্যদাতার নাম জানতে চাইলেন, আমার বুকটা যেন কেঁপে উঠলো। আমি তো প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, সেই গোপন নায়কের নাম বলতে পারবো না। এক যন্ত্রণার ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে গেলাম, যদিও কিছুক্ষণ পর সরকারিভাবেই সেই আটকের খবর সামনে চলে এলো।

আমার বুকের ভেতরের একটা চাপা উত্তেজনা যেন ফুটে বেরিয়ে এলো, যখন আরেকটা চাঞ্চল্যকর তথ্য আজাদ ভাইয়ার সাথে ভাগ করে নিলাম। সেই তথ্যের আলোয়, একাত্তর টিভিতে তিনি যখন নিউজ আর টকশোতে আলোচনা করলেন, আমার বুকটা যেন গর্বে ফুলে উঠলো। কিন্তু সেই তথ্যের প্রভাবে এক বিশেষ বাহিনীর মধ্যে যে ঝড় বয়ে গেল, তা আমাদের আতঙ্কিত করে তুললো। তাদের ক্ষোভের আগুন যেন আমাদের দিকেও ধেয়ে আসছিল। তবুও, সেই ভয়ের মাঝেই, আজাদ ভাইয়ার সাথে আমার তথ্য আদান-প্রদানের সেই নিবিড় মুহূর্তগুলো, আমাদের সম্পর্ককে আরও গভীর করে তুললো।

২০১৫, সেই বছরের শেষ প্রান্তে, যখন আজাদ ভাইয়ার কণ্ঠে একুশে পত্রিকার অনলাইন সংস্করণের স্বপ্ন ভেসে এল, আমার বুকটাও ভরে গেলো উত্তেজনায়। তাঁর আস্থা, তাঁর বিশ্বাস, আমাকে যেন এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেল। এক নিমেষে ডোমেইন কেনা হয়ে গেলো, সাইট তৈরির কাজও শুরু হয়ে গেলো। আমার বন্ধুর ভাগিনা মুন্না, সে যেন এক পরম বন্ধুর মতো এগিয়ে এলো আমার পাশে। দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশের সেই ব্যস্ততম সময়েও, একুশে পত্রিকার স্বপ্ন যেন আমার নিজের স্বপ্ন হয়ে গিয়েছিল।

আজাদ ভাইয়ার সেই আহ্বানে, আমার মনটা যেন দু ভাগ হয়ে গেল। একদিকে আলোকিত বাংলাদেশের প্রতি দায়বদ্ধতা, অন্যদিকে একুশে পত্রিকার নতুন স্বপ্নের ডাক। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে, গোপনে যেন এক রোমাঞ্চকর অভিযানে নেমে পড়লাম। অফিস? সে তো ছিল না কোনো নির্দিষ্ট জায়গায়। আমাদের মন, আমাদের স্বপ্নই ছিল একুশে পত্রিকার ঠিকানা। যে যেখান থেকে পারতাম, সেখান থেকেই যেন এক নতুন ইতিহাস গড়ে তুলছিলাম। দৈনিক প্রতিদিনের সংবাদে যোগ দেওয়া, সেটা ছিল আমার জীবনের আরেক নতুন অধ্যায়। কিন্তু একুশে পত্রিকার সেই স্মৃতি, সেই উত্তেজনা, সেই রোমাঞ্চ, তা কখনো মন থেকে মুছে যায়নি।

প্রতিদিনের সংবাদে থাকলেও, একুশে পত্রিকার প্রতি আমার ভালোবাসা যেন এক মুহূর্তের জন্যও কমেনি। দুটি পত্রিকার মাঝে দোলাচল করতে করতে, ২০১৯ এর জানুয়ারিতে অবশেষে আমার মন যেখানে সবসময় ছিল, সেই একুশে পত্রিকার ডাকে সাড়া দিলাম। তখন থেকে আজাদ ভাইয়ার সাথে আমার সম্পর্ক, সে তো আর শুধু সহকর্মী বা বন্ধুর সম্পর্ক নয়, এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা এক গভীর ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক। তাঁর সাথে কত স্মৃতি, কত আবেগ, কত হাসি-কান্না! সেসব যেন এক জীবনে বলে শেষ করা যাবে না।

আজাদ ভাইয়ের কথাগুলো মনে পড়লে বুকটা ভরে যায়! বাধা? আসবেই! কিন্তু আমাদের পেরিয়ে যেতেই হবে! উনি বলে যেতেন, জীবন মানেই উত্থান-পতন, সুখ-দুঃখের খেলা। কিন্তু চলার পথে বাধা? সে তো স্রোতের সামনে বাঁধ! ভেঙে ফেলতেই হবে! সাহস হারালে চলবে কী করে? আদর্শের কাছে মাথা নত করলে বাঁচব কী করে?

সাংবাদিকতা কি আর আট-পাঁচটার চাকরি? এ তো জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক অদম্য আবেগ! আমরা যারা এই পথ বেছে নিয়েছি, তাদের কি আর অজানা যে এই পথ কাঁটাবিছানো? কখনো কি এই পেশাটা সহজ ছিল? কোন দেশে, কোন যুগে বাধা আসেনি?

আমরা যা লিখতাম, তিনি তাই ছাপতেন। খবর আটকে রাখা? তা কখনো হয়নি! কিন্তু বিপদ? সে তো আমাদের ওপর দিয়ে তাঁর ওপরই আছড়ে পড়ত! তবুও তিনি? অটল!

একুশে পত্রিকার, আমার সাফল্যে তাঁর চোখেমুখে ঝলমল করত আনন্দের আলো!

আর দেশপ্রেম? সে তো তাঁর রক্তে মিশে ছিল! ‘বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে!’ এই কথাটা যেন তাঁর প্রতিটি শ্বাসে প্রতিধ্বনিত হতো। তিনি বলতেন, ‘বাংলাদেশ এগিয়ে যাবেই! আর আমাদের তো এই অগ্রযাত্রার সহযাত্রী হতেই হবে!’

২০২৩ সালের ৩১ জুলাই! সেই সকালটা যেন একটা কালো স্বপ্ন! রাজধানীর বিআরবি হাসপাতালের আইসিইউতে প্রায় দশ মিনিট ছিলাম, শুধু এক নজর দেখার জন্য আমাদের প্রাণের আজাদ ভাইয়াকে! কিন্তু সেই দৃশ্য! যেন বুকের ভেতর একটা কাঁটা! আমাদের প্রিয় আজাদ ভাইয়া যেন বিছানার সঙ্গে একাকার হয়ে গেছেন, ক্লান্ত, অসুস্থ! চোখ বন্ধ, যেন চিরনিদ্রায়!

আমি যখন তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম, তখন তিনি যেন জীবনের এক চিলতে আলো দেখতে পেলেন! চোখ খুললেন, আমার সালাম নিলেন। তারপর তাঁর মনের কথা বললেন, একুশে পত্রিকা নিয়েও কথা বললেন।

হঠাৎ তিনি আমাকে কাছে ডাকলেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন, আর বলছিলেন, ‘আমাকে অনেক ভালোবাসেন, আমার জন্য দোয়া করছেন।’ এই কথাগুলো শুনে আমার চোখের পানি থামলো না। তাড়াতাড়ি তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করে বেরিয়ে এলাম সেই অন্ধকার ঘর থেকে। বুকের ভেতর একটা শূন্যতা নিয়ে!

এই দীর্ঘ দশ বছর! আজাদ তালুকদার ভাইয়ার সান্নিধ্যে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত যেন আমার জীবনের সোনালি অধ্যায়! নিজেকে ভীষণ ভাগ্যবান মনে হয়!

লেখক : প্রধান প্রতিবেদক, একুশে পত্রিকা।