সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

এক নির্ভীক সাংবাদিকের অম্লান স্মৃতি

একুশে পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আজাদ তালুকদারের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০২৩ সালের ২ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তাঁর স্মরণে এই লেখা।

প্রকাশিতঃ ২ অগাস্ট ২০২৪ | ১২:০২ পূর্বাহ্ন


নজরুল কবির দীপু : আজাদ তালুকদারের সাথে আমার বন্ধুত্বের সুতো সেই সোনালী স্কুল জীবনেই গাঁথা, ১৯৯০ সালের সেই মধুর সময়ে। আমাদের মধ্যে চিন্তা, আগ্রহ আর অনুভূতির এমন এক মিল ছিল যেন দু’টি মন একই সুরে বাজে! হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার সব রঙে আমরা ছিলাম একে অপরের প্রতিচ্ছবি।

আজাদ, সে তো ছিল এক উজ্জ্বল নক্ষত্র! তার ছোঁয়ায় ‘একুশে পত্রিকা’ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার এক মহীরুহ হয়ে সারা দেশে তার সুঘ্রাণ ছড়িয়ে দিয়েছে। হায়! তাঁর অকাল বিদায় যেন আমাদের বুকের ভেতর এক ক্ষত! সে আরও কিছু দিন বাঁচলে, সাংবাদিকতার আকাশে আরও কত রঙ লাগাতো!

আজাদ, সাতাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতার আকাশে নিজের আলো ছড়িয়ে শুধু দেশের সাংবাদিকতাকেই আলোকিত করেনি, সাংবাদিকতার বাইরেও নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছে।

কখনো প্রশাসনিক কমিটির দায়িত্বে তার নিষ্ঠা, কখনো বা চিকিৎসা সেবা ক্যাম্পের আয়োজনে তাঁর মমত্ব, সব মিলিয়ে সে ছিল এক নিঃস্বার্থ কর্মযোদ্ধা। দেশের প্রতি তাঁর ভালোবাসা তাঁকে করেছিল এক অকুতোভয় কলমযোদ্ধা। দলমত, বয়স নির্বিশেষে সবার প্রতি তাঁর যে সহমর্মিতা, তা আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়!

আজাদের কর্মের পরিধি ছিল অসীম। হায়! সে আজ আমাদের মাঝে নেই, তবু তাঁর কর্ম, তাঁর আদর্শ আমাদের বুকে নিয়ে আমরা এগিয়ে যাবো। তাঁর কর্মই হবে তাঁর অমরত্বের স্বাক্ষী!

গত বছর রাজধানীর বিআরবি হাসপাতালের সেই কেবিনে ঢুকেই আমার বুকটা হু হু করে উঠলো। আজাদ, আমার প্রাণের বন্ধু, ফ্যালফ্যাল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো, ‘নজরুল, তুই এসেছিস?’

আমার চোখের পানি যেন বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে এলো। দু’জনের কান্নায় যেন কেবিনটা ভেসে যাচ্ছে। কী যে কষ্ট, কী যে বেদনা! বাবাকে হারানোর সময়ও এতটা কান্না আসেনি। হয়তো বার্ধক্যজনিত কারণে বাবার মৃত্যু আমি মানতে পেরেছিলাম, কিন্তু আজাদেরটা না!

পাশে দেলোয়ারা আপা, তাঁর মেয়ের জামাইকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলাম। তিনিই আমাদেরকে সান্ত্বনা দিয়ে খাটের উপর বসালেন। কিন্তু আজাদকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনো শব্দ যেন আমার মুখে আসছিল না।

একমাত্র ছেলে অর্ঘ্যকে নিয়ে আজাদের কত স্বপ্ন! সে তো চেয়েছিল অর্ঘ্যকে সুশিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত করে তুলবে। কিন্তু নির্মম ক্যান্সার যেন তাঁর সব স্বপ্নগুলোকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে।

শেষ সময়ে আজাদ, আমার প্রিয় বন্ধু, বারবার তার প্রাণের টুকরো অর্ঘ্যের কথা বলতো, আর একুশে পত্রিকাকে বাঁচিয়ে রাখার আকুতি জানাতো। আমি কথা দিয়েছিলাম, যতদিন এই বুকে প্রাণ আছে, তাঁর শেষ ইচ্ছা পূরণের চেষ্টা করবো।

মৃত্যুর কয়েকদিন আগেও তাঁর সাথে কথা হয়েছিল। কথা বলতে বলতে তাঁর কণ্ঠ যেন কাঁপছিল, দুর্বল হয়ে আসছিল। তবুও সে বলেছিল, ‘নজরুল, তুই আমার পাশে থাক।’ আমি বুক চাপড়ে বলেছিলাম, ‘আমি সবসময় তোর পাশেই আছি।’ কিন্তু হায়! নিষ্ঠুর নিয়তি আমায় তাঁর কাছে আর যেতে দেয়নি।

আজাদের সাথে কত স্মৃতি, কত গল্প! মনের খাতায় সেসব সযত্নে রাখা আছে, সময় পেলে আপনাদের সামনে ঝেড়ে দেবো। এখন এটুকুই বলতে চাই, আজাদ আমাদের ছেড়ে যায়নি, সে বেঁচে আছে আমাদের হৃদয়ে, আমাদের প্রেরণায়। তাঁর সততা, সাহস, উদ্যম দেখে আরও কত কলম যোদ্ধা জন্মাবে, যারা এই সমাজের অন্ধকার দূর করে আলোর পথ দেখাবে।

আজাদ, সে তো ছিল এক নির্ভীক যোদ্ধা! সত্যের পতাকা হাতে নিয়ে সে লড়েছে সারাজীবন। বাধা, বিপত্তি, হুমকি, কিছুতেই তাঁর পায়ের গতি থামেনি। তাঁর এই অদম্য সাহস আমাদের বুকে সাহসের বীজ বুনে যাবে।

আমার আজাদ, আমার বন্ধু, সে ছিল এক স্বচ্ছ আয়না! তার অন্তরে ছিল শুধু সততা আর নিষ্ঠার আলো। অন্যায়ের সাথে তাঁর কখনোই আপস চলেনি। সমাজের কালিমা, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে তাঁর কণ্ঠ ছিল সবচেয়ে জোরালো। তাঁর এই সততা, এই নিষ্ঠা আমাদের বুকে সত্যের বীজ বুনে যাবে।

আজাদ, সে ছিল এক কোমল হৃদয়ের মানুষ! অসহায়ের পাশে তাঁর ছিল সবসময় ছায়ার মতো সঙ্গ। তাঁদের কষ্টে তাঁর চোখেও জল আসতো, তাঁদের সুখে তাঁর মুখেও হাসি ফুটতো। তাঁর এই মহানুভবতা আমাদের অন্তরে গেঁথে থাকবে চিরদিন।

আজাদ, সে চলে গেছে, কিন্তু তাঁর স্মৃতি আমরা বুকে লালন করব সবসময়। সে হবে আমাদের পথপ্রদর্শক, তাঁর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে আমরা এগিয়ে যাব।

আজ, আমাদের একটাই লক্ষ্য, একুশে পত্রিকাকে আকাশের চাঁদের মতো উজ্জ্বল করে তোলা। এ পত্রিকা তো তাঁরই সন্তান, তারই প্রাণ!

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা