জিন্নাত আয়ুব : ২০২৩ সালের ২ আগস্ট ভোররাত ৪টায় একাধিক ফোন কল আসতে শুরু করে আমার মোবাইলে। আকস্মিক এই পরিস্থিতিতে আমার মনে নানা প্রশ্ন জেগে উঠলো। কিছু একটা ঘটেছে? কোনো দুঃসংবাদ? অবশেষে রাফি ভাইয়ের ফোন রিসিভ করলাম। অপর প্রান্ত থেকে তিনি আমাদের অভিভাবকের মৃত্যু সংবাদ দিলেন। আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। তখন চারপাশের প্রকৃতিও যেন শোকের ছায়ায় নিমজ্জিত।
সেই দিন সারাদিন আমাদের প্রয়াত সম্পাদকের স্মৃতি মনে উঁকি দিতে থাকে। রাজনীতি থেকে শুরু করে সমাজের প্রান্তিক মানুষের জীবন – সবকিছুই তিনি নিজের লেখনীতে তুলে ধরতেন।
তাঁর মানবিক মূল্যবোধের একটা উদাহরণ হলো ২০২২ সালের ২০ মে-এর ঘটনা। আমি তাঁকে এক সিএনজি অটোরিকশা চালককে বিদ্যুতের ফাঁদ পেতে হত্যার খবর দিলে তিনি নির্দেশ দেন ঘটনাস্থলে গিয়ে সত্য উদঘাটন করতে। এই ঘটনার পর আমি হুমকি পেলেও তিনি আমাকে সাহস যোগান; বলেন, ‘আমরা সাংবাদিকতার পাশাপাশি মানবিক মূল্যবোধ থেকে নিউজটি করেছি। আমরা সমাজের নিপীড়িত মানুষের কথা লিখতে এসেছি, লিখে যাব।’ উল্লেখ্য, সংবাদ প্রকাশের সপ্তাহখানেকের মধ্যে ওই প্রভাবশালী সম্পাদকসহ আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন।
আমার প্রয়াত সম্পাদক নিজেই ছিলেন সত্যের পক্ষে অকুতোভয় একজন যোদ্ধা। অল্প সময়ের মধ্যেই একুশে পত্রিকাকে সাংবাদিকতার এক উজ্জ্বল নক্ষত্রে পরিণত করেন তিনি। তাঁর অনুপ্রেরণায় আমি ২০২২ সালে একুশে পত্রিকার সেরা প্রতিনিধির পুরস্কার পাই। আমার প্রয়াত সম্পাদকের কথা, সাংবাদিকতায় সত্য প্রকাশই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, বাধা আসবেই, কিন্তু সত্যের জয় অনিবার্য।
তিনি আরও বলেছিলেন, ‘কারও ব্যক্তিগত এজেন্ডা বাস্তবায়ন কিংবা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের কালো টাকাকে সাদা করতে হবে, তাদের লগ্নিকে জায়েজ করতে হবে- এ ধরনের কালো হাত নেই বলে আমরা ভালো সাংবাদিকতা করতে পারছি। সীমিত সাধ্য, সামর্থের মধ্যেও আমরা সাংবাদিকতার সেরা কাজটুকু করতে চাই। সেটি করতে আমরা বদ্ধপরিকর, যেকোনো পরিস্থিতিতে, যেকোনো মূল্যে।’
গত বছরের জুলাই মাসের ২৩ তারিখ বিআরবি হাসপাতালের শয্যায় শেষবারের মতো আমার সম্পাদকের সঙ্গে দেখা হয়। রুমে প্রবেশ করতেই বললেন- ‘জিন্নাত আসছো?’ আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। হাতটা ধরে স্যারের কপালে চুমু দিয়েছিলাম। অজান্তেই এমন দুঃসাহস দেখিয়ে ফেললাম। সত্যি বলতে তখন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি।
রুগ্ন শরীর নিয়ে আমার সম্পাদক কথা বললেন। অনেক কিছুই বললেন। তখনো তিনি আমাদের কাজ নিয়ে ভাবছিলেন, সাহসী সাংবাদিকতা চালিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করছিলেন।
এমন শারীরিক অবস্থায়ও তিনি বলছিলেন, ‘তোমরা সকালের নাস্তা করেছো? আমি তোমাদের সকালের নাস্তাটা করাই।’ সবার এতো খেয়াল রাখেন বলেই বোধহয় তিনি এতটা ব্যতিক্রম, অনন্য।
তাঁর সুস্থ হয়ে ফেরার আশা নিয়ে আমরা ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ফিরে এসেছিলাম। কিন্তু নিয়তির পরিহাস, তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তাঁর শূন্যতা কখনোই পূরণ হবে না। তবে তিনি যে আলো জ্বালিয়ে গেছেন, তা অনন্তকাল ধরে জ্বলতে থাকবে। তাঁর স্মৃতি শুভাশীষ হয়ে আমাদের অন্তরে থাকবে।
কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ভাষায়, চলে যাওয়া মানে বিচ্ছেদ নয়, বরং না থাকার মাঝেও এক অনন্য উপস্থিতি। প্রিয় সম্পাদক, আপনার প্রস্থানে আমরা শোকাহত, আপনার আদর্শ ধারণ করে আমরা চলার পথ আলোকিত করব।
লেখক: একুশে পত্রিকার আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলা প্রতিনিধি।