নজরুল কবির দীপু : ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত রোগ, যেটি ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে হয়। এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাসটি মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। ২০১৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে ১০টি বৈশ্বিক স্বাস্থ্যঝুঁকি চিহ্নিত করে, ডেঙ্গু সেগুলোর একটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ১২৫ দেশের প্রায় ৪০০ কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন, যাঁদের মধ্যে ৭০ শতাংশ মানুষ এশিয়া মহাদেশে বসবাস করেন।
প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৩৯ কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন, যাঁদের মধ্যে প্রায় ৫ লাখ মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছেন। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবছর বিশ্বে ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করছেন, যাদের অধিকাংশ শিশু। অপরিকল্পিত শহরায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ও আকাশপথে মানুষের অবাধ চলাচলের জন্য গত ৫০ বছরে ডেঙ্গুর প্রকোপ ৩০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০২৩ সালে ডেঙ্গু সংক্রমণ ও মৃত্যুর ভয়াবহ রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছিল দেশের মানুষ। ওই বছর ডেঙ্গুর সব রেকর্ড ভেঙে যায়। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ৩ লাখ ২১ হাজার ২৭ জন। এর মধ্যে মারা যান ১ হাজার ৭০৫ জন। মৃত্যুহার বেড়ে হয় শূন্য দশমিক ৫৩ শতাংশ। গত বছরের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে জনস্বাস্থ্যবিদ, কীটতত্ত্ববিদ ও সরকারি কর্মকর্তারা এ বছরের শুরু থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলে আসছেন যে এ বছরও ডেঙ্গু বড় আকারে দেখা দেবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর মৌসুমের শুরুতে ডেঙ্গু আক্রান্তের হার কিছুটা কম হলেও মৃত্যুর হার দ্বিগুণ। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তিন হাজারের বেশি রোগী; এদের মধ্যে মারা গেছেন ৪১ জন।
ডেঙ্গু যে এখন আর মৌসুমি রোগ নয়, এটি সবার কাছে স্পষ্ট হয়েছে। এখন বর্ষাকাল চলছে। কিছুক্ষণ পরপর বৃষ্টিপাত, পাশাপাশি গরম আবহাওয়ায় এডিস মশার উৎপাত বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। আগামী জুলাই-আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে এডিস মশার উৎপাত ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। এসব তথ্য বিবেচনায় নিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
যদিও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় তেমন কোনো কার্যক্রমই দৃশ্যমান নয়। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে এখনই সচেতন হতে হবে। তা না হলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। এদিকে চট্টগ্রামে মশা নিয়ন্ত্রণে এখনো সনাতনী পদ্ধতিতে চলছে কার্যক্রম। বিশেষজ্ঞদের মতে, কাঙ্ক্ষিত সুফল পেতে হলে মশা নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।
পবিত্র ঈদুল আজহায় চট্টগ্রাম শহর ছেড়েছিল লাখ লাখ মানুষ। এ সময় এডিস মশার বংশ বৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সিটি করপোরেশন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও মশক নিধন কার্যক্রমে যথেষ্ট মনোযোগী ছিল কিনা, এটাও এক প্রশ্ন। ছুটির পর শহরে ফিরেছেন যারা, তাদের সবাইকে এডিস প্রজননের উৎসগুলো ধ্বংস করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খোলার আগে মশক নিধনে কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।
আমরা জানি, প্লাস্টিকের নানা ধরনের পাত্র, কোমল পানীয়ের বোতল, কলাপসিবল গেটের নিচের অংশ, ফেলে দেওয়া টায়ারের অংশ, দইয়ের ফেলে দেওয়া পাত্র, ছাদবাগানের ফুলের টব, পানির মিটারের কাছের গর্ত, ডাবের খোসা, অব্যবহৃত কর্কশিট, সিরামিকের পাত্র, সিঁড়ির পাশের ভাঙা হাতল, যানবাহনের অংশ, গাড়ির গ্যারেজসহ অনেক কিছুতেই ডেঙ্গু মশার লার্ভা থাকে। এসব জায়গায় জমে থাকা পানি পরিষ্কার করা জরুরি।
ডেঙ্গুর নতুন উপসর্গগুলোর সঙ্গে বহু মানুষ পরিচিত নয়। গত বছর অসচেতনতার কারণে অনেক ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। কাজেই কারও জ্বর হলে দেরি না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে এডিসের উৎপাত বাড়বে। অপরিকল্পিত নগরায়ণসহ বিভিন্ন কারণেই বাড়ছে এডিসের উৎপাত। বস্তুত এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কী করণীয়, তা বহুল আলোচিত। কাজেই ডেঙ্গু থেকে সুরক্ষা পেতে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে।
সর্বোপরি ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি, সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা বাড়ানো, পরিস্থিতি মোকাবিলায় কৌশলগত অগ্রাধিকার ঠিক করা, স্বাস্থ্যব্যবস্থায় দক্ষতা বাড়ানো, হাসপাতালে রোগী ব্যবস্থাপনায় সৃজনশীল উদ্যোগ, মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা চালু, মশারি বিতরণ, মশার ওপর নিয়মিত নজরদারি এবং সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নিয়মিত ও জোরালো তদারকির মাধ্যমে ডেঙ্গুর প্রভাব কমানো সম্ভব বলে মনে করি আমরা।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।