সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

কেন সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না?

প্রকাশিতঃ ২৩ জুন ২০২৪ | ৯:০৩ পূর্বাহ্ন


নজরুল কবির দীপু : দেশের সড়ক-মহাসড়কে বিশৃঙ্খলা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ফলে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিনই ঝরছে প্রাণ। শুধু ঈদের ছুটিতেই সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ৪১ জন প্রাণ হারিয়েছেন। সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের জাতীয় জীবনে বড় ধরনের একটা নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে আছে। তৃণমূল থেকে উচ্চপর্যায় এ সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে সোচ্চার হলেও কোথায় যেন একটা গলদ থেকে যাচ্ছে।

ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ছোট ছোট যানবাহনগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন, সড়ক থেকে এ বাহনগুলোকে বাদ দেওয়ার উপায় নেই। এ বিষয়ে তিনি আরও জানান, এ বিষয়ক নীতিমালা প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে। আমরা আশা করব, এ বিষয়ক নীতিমালা প্রণয়নের পর তা বাস্তবায়নের জন্যও যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা জোরদার করার লক্ষ্যে এবং দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে কয়েক বছর আগে একটি বিশেষ প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল এ সংক্রান্ত কমিটি। সে প্রতিবেদনের সুপারিশগুলোর বাস্তবায়ন হবে কবে? দেশের সড়ক অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়ন হলেও সড়ক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণেই কমছে না দুর্ঘটনা।

দেশে বেশির ভাগ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই দেখা যায়, হয় চালকের লাইসেন্স নেই অথবা মোটরযানটির ফিটনেস নেই অথবা সড়কটি ত্রুটিপূর্ণ। অথচ সড়কপথে নিরাপদ যাতায়াত ও পরিবহনব্যবস্থার অপরিহার্য উপাদান হলো: ত্রুটিমুক্ত নকশার সড়ক–মহাসড়ক, ত্রুটিমুক্ত যানবাহন, লাইসেন্সধারী দক্ষ চালক, চালক ও তাঁদের সহকারীদের যথাযথ মজুরি ও কর্মপরিবেশ, পরিবহনমালিক ও পরিবহন কোম্পানিগুলোকে আইন মানতে বাধ্য করতে সক্ষম নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইত্যাদি। এর কোনো একটির অনুপস্থিতিতেই যাতায়াত ও পরিবহনব্যবস্থা অনিরাপদ হয়ে উঠতে বাধ্য।

বাংলাদেশের যোগাযোগ ও পরিবহনব্যবস্থায় নিরাপদ যাতায়াত ও পরিবহনব্যবস্থার এসব অপরিহার্য শর্তের কোনোটিই যথাযথভাবে মেনে চলা হয় না বলেই মহাসড়কে মৃত্যুর মহামারি থামছে না। এ দেশে ফিটনেস সনদ নেওয়া বাধ্যতামূলক এ রকম ১৬ লাখ যানবাহনের মধ্যে ৬ লাখ ১৮ হাজার অর্থাৎ প্রায় ৩৯ শতাংশ যানবাহন ফিটনেস সনদ ছাড়াই চলাচল করছে। আর সড়কে ২০ বছরের পুরাতন লক্কড়ঝক্কড় বাস চলছে ৩৫ হাজার ৭৮২টি এবং ২৫ বছরের পুরাতন ট্রাক চলছে ৩৭ হাজার ২৭৫টি।

সড়ক হচ্ছে জাতির লাইফলাইন। আর এ সড়কের মূল ব্যবহারকারী হচ্ছেন চালক। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, অধিকাংশ চালকেরই নেই উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং তাঁরা জানেন না কোন সড়ক কীভাবে ব্যবহার করতে হয়। এসব ক্ষেত্রে চালককে যদি সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত না করা যায়, তাহলে সে নিজের বোধ ও বুদ্ধিতে চলবে। সড়কের চরিত্র সম্পর্কে অনভিজ্ঞ সাইন, সিগন্যাল বা নির্দেশিকা না জানা এই চালকেরাই তখন দুর্ঘটনা ঘটাবেন এবং ঘটাচ্ছেন।

বিআরটিএর হিসাবে, দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের তুলনায় লাইসেন্সধারী দক্ষ চালকের সংখ্যা অন্তত ১৫ লাখ কম। দক্ষ চালকের সংকটের কারণে অনেক যানবাহনের মালিক লাইসেন্সবিহীন চালকের হাতে নিজের যান তুলে দেন।

সম্প্রতি টিআইবির এক জরিপে দেখা গেছে, জরিপে অংশগ্রহণকারী মালিকদের ১১ দশমিক ৯ শতাংশ বলেছেন, তাঁদের কোম্পানিতে এক বা একাধিক চালকের বৈধ পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই বা মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স আছে। অন্যদিকে জরিপে অংশগ্রহণকারী কর্মী/শ্রমিকদের ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ বলেছেন, নিয়োগ প্রদানের পূর্বে কোম্পানি তাঁদের লাইসেন্স যাচাই-বাছাই করেনি।

সড়কের নকশায় ত্রুটিও সড়ক দুর্ঘটনার একটি বড় কারণ। এ কারণে রোড সেফটি অডিটের মাধ্যমে পদ্ধতিগত, আনুষ্ঠানিক ও পুঙ্খানুপুঙ্খ মূল্যায়নের মাধ্যমে সড়ক নির্মাণের আগে ও পরে নিয়মিত সড়কের সম্ভাব্য ত্রুটি চিহ্নিত করে তার সমাধান করা জরুরি। কিন্তু বাংলাদেশের সড়কগুলোয় নিয়মিত এই কাজ করা হয় না। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর ২২ হাজার ৪৭৬ কিলোমিটার রাস্তার মধ্যে মাত্র ১ হাজার ৫৫ কিলোমিটার সড়কের সেফটি অডিট করেছে, যার অর্থ ৯৫ শতাংশের বেশি সড়কের কখনো অডিট করা হয়নি।

২০১২ সালের পর ১১ বছরে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সড়ক, সেতু, টানেল নির্মাণে ১ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় করেছে। কিন্তু অবকাঠামো উন্নয়নে বিপুল ব্যয় হলেও সড়ক নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন অত্যাবশ্যকীয় শর্ত যেমন: ত্রুটিমুক্ত নকশার সড়ক–মহাসড়ক, ত্রুটিমুক্ত যানবাহন, লাইসেন্সধারী দক্ষ চালক ও সহকারীদের যথাযথ মজুরি ও কর্মপরিবেশ, পরিবহনমালিক ও পরিবহন কোম্পানিগুলোকে আইন মানতে বাধ্য করতে সক্ষম নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইত্যাদি নিশ্চিত করা হয়নি। আর এ কারণেই হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে তৈরি উন্নয়নের মহাসড়কে মৃত্যুর মহামারি থামছে না।

কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সারা দেশে সড়কে আইন মানার প্রবণতা নেই বললেই চলে। পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলার মূল কারণ সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের অদক্ষতা। বস্তুত সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলো চিহ্নিত, কী করণীয় তাও বহুল আলোচিত। সড়ককে নিরাপদ করতে বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে নানা পরামর্শ ও সুপারিশ প্রদান করা হলেও তা যে অরণ্যে রোদনে পর্যবসিত হচ্ছে, দেশে প্রতিদিন ঘটা দুর্ঘটনাগুলোই এর প্রমাণ।

আমরা মনে করি, দুর্ঘটনা রোধে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা জরুরি। ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনাসহ সড়ক ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন ক্ষেত্রে লোকবল কম, এ তথ্য আমরা জানি। তবে দুর্নীতি রোধে কর্তৃপক্ষ কঠোর হলে কম লোকবল দিয়েও বিভিন্ন অভিযানে কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া সম্ভব। যেহেতু সারা দেশের সড়ক-মহাসড়কে নৈরাজ্য ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, সেহেতু সমস্যার সমাধানে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সড়ককে নিরাপদ করার লক্ষ্যে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও সরিষার ভেতর ভূত থাকার বিষয়টি বারবার আলোচনায় আসে। কাজেই সরিষার ভেতরের ভূত তাড়ানোর জন্যও জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে।

আমাদের যে সড়ক আইনটি আছে, তার বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরও কেন বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না, তা নিয়ে সরকারের সব অংশীজনের চিন্তা করতে হবে। আমরা আশা করব, সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এই বিষয়গুলোকে অনুধাবন করবে।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।