অতিরিক্ত ভ্যাট-ট্যাক্সে ধ্বংস হচ্ছে জুয়েলারি ব্যবসা!

শরীফুল রুকন : ভারতে স্বর্ণের দর নির্ধারণ করা ইন্ডিয়া বুলিয়ন অ্যান্ড জুয়েলার্স এসোসিয়েশনের ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, ২২ জুন দেশটিতে ২২ ক্যারেটের এক গ্রাম স্বর্ণ কিনতে লেগেছে ৬ হাজার ৬৬৪ রুপি (৯ হাজার ৩৫০ টাকা)। অন্যদিকে একইদিন দেশের স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ জুয়েলার্স এসোসিয়েশনের (বাজুস) তথ্যমতে, দেশে ২২ ক্যারেটের এক গ্রাম স্বর্ণ কিনতে লেগেছে ১০ হাজার ২৭ টাকা। দামের পার্থক্য ৬৭৭ টাকা।

এক ভরি সমান ১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম। উপরোক্ত হিসাবে ভারতে এক ভরি স্বর্ণের দাম পড়েছে ১ লাখ ৯ হাজার ৫৮ টাকা। আর বাংলাদেশে এক ভরি সোনার দাম ১ লাখ ১৬ হাজার ৯৫৫ টাকা। এক ভরিতে দামের পার্থক্য ৭ হাজার ৮৯৭ টাকা। অর্থাৎ প্রতি ভরিতে বাংলাদেশে প্রায় ৮ হাজার টাকা বেশি।

আবার দেশে স্বর্ণের বিক্রয় মূল্যের সঙ্গে আবশ্যিকভাবে সরকার নির্ধারিত ৫ শতাংশ ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) এবং বাজুস নির্ধারিত গহনার নূন্যতম মজুরি ৬ শতাংশ যুক্ত হয়। দেশে এক ভরি স্বর্ণের সাথে বাজুস নির্ধারিত নূন্যতম মজুরি লাগছে ৭ হাজার ১৭ টাকা। একই পরিমাণ স্বর্ণ কিনতে ভ্যাট দিতে হয় ৫ হাজার ৮৪৭ টাকা। সবমিলে এক ভরি স্বর্ণের অলংকার কিনতে বাংলাদেশে মোট ১ লাখ ২৯ হাজার ৮১৯ টাকা লাগছে।

অন্যদিকে ভারতে এক ভরি স্বর্ণের ক্ষেত্রে ৩ শতাংশ হারে ভ্যাট (জিএসটি) দিতে হয় ৩ হাজার ২৭১ রুপি বা ৪ হাজার ৫৮৯ টাকা। ভারতে দোকান ভেদে মজুরি আলাদা হয়; এক ভরি স্বর্ণের ক্ষেত্রে নেওয়া হয় ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার রুপি (৫ হাজার ৬১২ টাকা থেকে ৭ হাজার ১৫ টাকা।) সবমিলে এক ভরি স্বর্ণের অলংকার কিনতে ভারতে লাগে প্রায় ১ লাখ ১৯ হাজার ২৫৯ টাকা।

অর্থ্যাৎ কাগজে-কলমে বাংলাদেশে প্রতি ভরি স্বর্ণের অলংকার কিনতে প্রায় ১০ হাজার ৫৬০ টাকা বেশি লাগছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বর্ণ খাতের কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশ আমদানিতেও দেশে তুলনামূলক উচ্চ শুল্ক ও ভ্যাট আছে। যার কারণে স্বর্ণের অলংকারের দাম বেশি পড়ছে। অন্যদিকে তুলনামূলক ভ্যাট কম ও নীতি সুবিধার কারণে বাংলাদেশের তুলনায় ভারতে স্বর্ণের অলংকারের দাম কম। ফলে দেশে স্বর্ণের অলংকার বেচা-কেনা হচ্ছে কম।

অনেকে ভারত ও অন্যান্য দেশ থেকে স্বর্ণের অলংকার কিনে আনছেন। এর ফলে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। এতে দেশের ব্যবসায়ীরা হারাচ্ছেন তাঁদের বিনিয়োগকৃত পুঁজি আর দেশ হারাচ্ছে রাজস্ব।

বাজুসের স্ট্যান্ডিং কমিটি অন ট্যারিফ অ্যান্ড ট্যাক্সেশনের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘দেশে অলংকার শিল্পের অপার সম্ভাবনা আছে। ভ্যাট আহরণে আগামী দিনে সরকারের একটি বড় খাত হতে পারে জুয়েলারি শিল্প। কিন্তু অতিরিক্ত ভ্যাট-ট্যাক্সের কারণে স্বর্ণের ব্যবসায় মন্দা চলছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ক্রেতাদের কাছে সহনীয় আকারে ভ্যাট নির্ধারণ করা জরুরি। স্বর্ণ, স্বর্ণের অলংকার, রূপা বা রূপার অলংকার বিক্রির ক্ষেত্রে আরোপিত ভ্যাট হার ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করা উচিত। তাহলে স্বর্ণ খাত থেকে সরকার প্রতি বছর প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ করতে পারবে।’

গালফ নিউজের ওয়েবসাইট থেকেও দুবাইয়ের সোনার দাম ও টাকার বিনিময় মূল্য জানা যায়। ২২ জুনের হিসাবে দুবাইতে ২২ ক্যারেটের এক গ্রাম স্বর্ণের দাম ২৬০ দশমিক ২৫ দিরহাম (৮ হাজার ৩০৭ টাকা)। সে হিসেবে দুবাইতে এক ভরি স্বর্ণের দাম পড়ছে ৩ হাজার ৩৫ দশমিক ৫৫৬ দিরহাম (৯৬ হাজার ৯০২ টাকা)।

চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার স্থায়ী বাসিন্দা দুবাই প্রবাসী শাহজাহান চৌধুরী বলেন, ‘দুবাইয়ে স্বর্ণের দাম অনেক কম। এ কারণে প্রতিবারই দেশে যাওয়ার সময় স্বর্ণ নিয়ে যাই। আত্মীয়-স্বজনরাও দেশ থেকে হুন্ডিতে টাকা পাঠায় সোনা কিনে নিয়ে যেতে। শুধু আমি না, দুবাই প্রবাসী অনেকের ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটছে। এছাড়া বেড়াতে এসেও প্রায় সবাই স্বর্ণ নিয়ে যাচ্ছেন। আবার চোরাচালানিদের স্বর্ণের বার বহন করছেন কেউ কেউ, এক্ষেত্রে অন্তত ২০ হাজার টাকা পাওয়া যায়।’

শুধু দুবাই নয়, বাংলাদেশি ক্রেতারা স্বর্ণের অলংকার কেনার জন্য ভারতেও যাচ্ছেন। সেখান থেকে নতুন নতুন ডিজাইনের পাশাপাশি সাশ্রয়ী দামে গয়না কিনে আনছেন। চট্টগ্রামের চকবাজারের বাসিন্দা শামসুন নাহার নিজের ছেলের বিয়ের বাজার করতে সম্প্রতি কলকাতায় গিয়েছিলেন; তিনি বলেন, ‘কলকাতায় কাপড় যেমন অনেক সস্তা, তেমনি সোনার অলংকারও। ৩ ভরি সোনার অলংকার কিনেছি বাংলাদেশের তুলনায় প্রায় ৪০ হাজার টাকা কমে।’

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে চট্টগ্রামের একজন স্বর্ণ ব্যবসায়ী বলেন, ‘ভ্যাট ও দাম বেশি হওয়ার কারণে এখন স্বর্ণের বেচাকেনা নেই বললেই চলে। গ্রামে এমন অনেক দোকান পাওয়া যাবে, যেখানে মাসে এক ভরি স্বর্ণ বিক্রি হয় না। ব্যবসার আড়ালে অনেকেই এখন সুদের কারবার করে টিকে আছেন। উচ্চ সুদের কারণে মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে, সমাজে অস্থিরতা বাড়ছে। স্বর্ণের দাম ও ভ্যাট না কমলে মানুষ দেশ থেকে সোনা কিনবে না।’

ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ ভ্যাট-ট্যাক্স উল্লেখ করে বাজুসের স্ট্যান্ডিং কমিটি অন ট্যারিফ অ্যান্ড ট্যাক্সেশনের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ভারতে জুয়েলারি খাতের জন্য বিভিন্ন সহায়তা দেওয়া হয়। ফলে উৎপাদন ব্যয় কম। স্বর্ণের জন্য সহজ শর্তে ঋণসহায়তা দেওয়া হয়। যে কারণে ভারতে জুয়েলারি শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে গোল্ড রিফাইনারি শিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছে। শুধু দেশের চাহিদা পূরণ নয়, বিদেশেও রপ্তানি করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে জুয়েলারি খাতের জন্য অপরিশোধিত স্বর্ণের আকরিক আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে এক শতাংশ নির্ধারণ করা উচিত। জুয়েলারি খাতের জন্য আংশিক পরিশোধিত স্বর্ণের আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশের পরিবর্তে ৫ শতাংশ করা উচিত। তাহলে স্বর্ণ চোরাচালান বন্ধ হবে। আমদানিকারকরা পরিশোধন পরবর্তী আন্তর্জাতিক মূল্যে ব্যবসায়ীদের কাছে খাঁটি স্বর্ণ পৌঁছে দিতে পারবেন। ফলে সরকার অনেক বেশি রাজস্ব আহরণ করতে পারবে।’

‘দেশে স্বর্ণের মূল্য বাইরের দেশ থেকে পদ্ধতিগত কারণে বেশি হওয়াতে ক্রেতারা দেশের বাজার থেকে স্বর্ণের অলংকার কেনার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন, বিদেশ থেকে স্বর্ণের অলংকার কিনে আনছেন। এ কারণে যে পরিমাণ ডলার দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে তা দেশের অর্থনীতির জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে শুল্কনীতি পরিবর্তনের মাধ্যমে স্বর্ণের আকরিক আমদানির সুযোগ সৃষ্টি করা উচিত সরকারের।’ বলেন বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন ট্যারিফ অ্যান্ড ট্যাক্সেশনের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, স্বর্ণ পরিশোধনাগার শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে স্বর্ণের বর্জ্য ব্যবহারের জন্য আমদানি শুল্ক (সিডি) নেওয়া হচ্ছে ৫ শতাংশ, ভ্যাট (মূসক) নেওয়া হচ্ছে ১৫ শতাংশ, অগ্রিম কর (এটি) নেওয়া হচ্ছে ৫ শতাংশ, অগ্রিম আয়কর (এআইটি) নেওয়া হচ্ছে ৫ শতাংশ। তবে বাজুসের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আমদানি শুল্ক এক শতাংশ করা উচিত। আর ভ্যাট, এটি, এআইটি- সবকিছুতে শুল্কহার শুন্য করা উচিত। তাহলে এই শিল্পের কাঁচামালের যোগান নিরবিচ্ছিন্ন থাকবে। ফলে এই শিল্প ব্যাপকভাবে প্রসারিত হবে।

জানা গেছে, বর্তমানে জুয়েলারি খাতের জন্য রাফ ডায়মন্ডের আমদানি শুল্ক (সিডি) ২৫ শতাংশ, সম্পূরক শুল্ক (এসডি) ২০ শতাংশ, ভ্যাট ১৫ শতাংশ, অগ্রিম কর (এটি) ৫ শতাংশ, অগ্রিম আয়কর (এআইটি) ৫ শতাংশ, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) ৩ শতাংশ। বাজুসের নেতারা বলছেন, রাফ বা অমসৃণ ডায়মন্ডের ক্ষেত্রে সিডি ২ শতাংশ, এসডি শুন্য শতাংশ, ভ্যাট ৫ শতাংশ, এআইটি শুন্য শতাংশ, এটি ৩ শতাংশ করা উচিত। অমসৃণ ডায়মন্ড আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক কমানো হলে এদেশের ডায়মন্ড শিল্প বিকশিত হবে। যার ফলে হীরক খচিত অলংকার দেশীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে।

বর্তমানে ল্যাবে তৈরি ডায়মন্ডের সিডি ৫ শতাংশ, ভ্যাট ১৫ শতাংশ, এআইটি ৫ শতাংশ, এটি ৫ শতাংশ। বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন ট্যারিফ অ্যান্ড ট্যাক্সেশনের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ল্যাবে তৈরি ডায়মন্ড তৈরিতে প্রকৃতি প্রদত্ত ডায়মন্ডের বীজ প্রয়োজন হয়। তাই এই ডায়মন্ডের গাঠনিক বৈশিষ্ট্য পুরোপুরি প্রকৃতি প্রদত্ত ডায়মন্ডের মতো হয়ে থাকে। এটা মানুষের তৈরি হওয়ার কারণে প্রকৃতি প্রদত্ত ডায়মন্ড থেকে প্রায় ৫০-৭০ শতাংশ মূল্য কম হয়ে থাকে। বর্তমানে ভারতে ল্যাবে তৈরি ডায়মন্ডের বাজার প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার এবং দিন দিন এই অংক বেড়ে যাচ্ছে। এখনই সময় বাংলাদেশে ল্যাবে তৈরি ডায়মন্ডের আমদানির সুযোগসহ বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করা। যাতে পরবর্তীতে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ নিজেকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পাবে। ল্যাবে তৈরি ডায়মন্ডের ক্ষেত্রে সিডি ২ শতাংশ, ভ্যাট ১০ শতাংশ, এটি ৩ শতাংশ করা উচিত।’

বাজুস সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে মসৃণ ডায়মন্ডের সিডি ২৫ শতাংশ, আরডি ৩ শতাংশ, এসডি ৬০ শতাংশ, ভ্যাট ১৫ শতাংশ, এটি ৫ শতাংশ, এআইটি ৫ শতাংশ। বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন ট্যারিফ অ্যান্ড ট্যাক্সেশনের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমাদের দেশের চাহিদার শতভাগ হীরা বিদেশ থেকে আসে। যার ফলে প্রচুর ডলার বিদেশে চলে যাচ্ছে। বৈধ পথে মসৃণ হীরা আমদানিকে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্য সকল ধরণের শুল্ককর সহনীয় পর্যায়ে নির্ধারণ করা হলে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে। আবার ভবিষ্যতে হীরার অলংকার রপ্তানির সম্ভাবনাও তৈরি হবে। মসৃণ ডায়মন্ড আমদানি করার ক্ষেত্রে এসডি ২০ শতাংশ করা উচিত।’

বাজুস কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য আলী হোসেন বলেন, ‘জুয়েলারি খাতের উন্নয়নের জন্য অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ আছে। তার মধ্যে প্রধানমত চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কর কাঠামোটা। জুয়েলারি খাতের জন্য বিশেষ যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য কর রেয়াত বা নূন্যতম ট্যাক্স এরকম কোনো সুবিধা আমরা পাই না। আমাদের মিনিমাম ট্যাক্স দিতে হয় ১১ দশমিক ৫ শতাংশ। আবার কিছু যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ট্যাক্স ৬৪ শতাংশ পর্যন্ত আসে। এছাড়া মাল্টিপল ট্যাক্স পেমেন্ট করতে হয়। একই পণ্যের জন্য অন্তত তিনবার ট্যাক্স দিতে হয়, এমনও হচ্ছে। এটা আসলে একটা শিল্পের বিকাশের জন্য, একটা শিল্পের মধ্যে প্রযুক্তি সংযোজন করার জন্য কোনোভাবেই ভায়াবেল না।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শরীফ মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘দেশে তৈরি পোশাক শিল্পের উত্থান হয়েছিল শুল্কমুক্ত সুবিধার কারণে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর হলে পোশাক শিল্পে বড় ধাক্কা আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আমি মনে করি, স্বর্ণ পরিশোধনাগার সেক্টরের প্রচুর রপ্তানি সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ এই সেক্টরের উৎপাদিত পণ্যের বিপুল চাহিদা রয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে। এই সেক্টরে কাজ করার জন্য দক্ষ কর্মীর যোগান রয়েছে আমাদের দেশে। এই সেক্টরে বিনিয়োগের জন্য আগ্রহী উদ্যোক্তা রয়েছেন। কিন্তু এই সেক্টরে ব্যবহার করা কাঁচামাল বা অপরিশোধিত, অর্ধপরিশোধিত স্বর্ণ আকরিক সেটা আমাদেরকে আমদানি করতে হবে। কাজেই এই সেক্টরের উত্থানকে ত্বরান্বিত করতে হলে এবং এটাকে রপ্তানি প্রতিযোগিতামূলক খাত হিসেবে গড়ে তুলতে হলে অবশ্যই এর কাঁচামালের আমদানি প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘জুয়েলারি শিল্পে শুল্ক কমিয়ে আনলেই কেবল রপ্তানি কম্পিটিটিভনেস তৈরি হয়। স্বল্প শুল্কে আমদানি করার অনুমতি যদি দেওয়া হয়, এই শিল্পটা বিকশিত হবে। তাছাড়া জুয়েলারি শিল্প বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা, রপ্তানি সম্ভাবনা আমি দেখছি না। কিন্তু স্বল্প শুল্কে কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানির অনুমতি যদি প্রদান করা হয়, তাহলে এই শিল্পের বিপুল সম্ভাবনা দেখতে পাই।’

অধ্যাপক ড. শরীফ মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘এতদিন স্বর্ণ আমদানি থেকে সরকারের তেমন রাজস্ব সংগ্রহ হয়নি। কাজেই এই শিল্পে ব্যবহার করা কাঁচামাল, স্বর্ণ আকরিক বা অন্যান্য যন্ত্রপাতির উপর যদি স্বল্প শুল্কে এমনকি জিরো ট্যারিফও যদি আরোপ করা হয়, উত্থানের বিপুল সম্ভাবনা আমি দেখতে পাই। সেই সম্ভাবনা আমাদের দেশের রপ্তানি আয় বৃদ্ধি করবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি করবে। আমাদের দেশে কর্মসংস্থান তৈরি করবে। দারিদ্র্যতা কমাবে। এমনকি আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতিকে বেগবান করবে।’

পরিবর্তিত অর্থনীতির সাথে তাল মেলানোর জন্য বাংলাদেশকে হাই ভ্যালু এডেড ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশনের দিকে যেতে হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘পোশাক শিল্পের ভ্যালু এডিশন অতটা বেশি না। তাই গোল্ড রিফাইনারি ও জুয়েলারি শিল্পকে শক্তিশালী করতে হবে। জুয়েলারি শিল্পে ব্যবহার করা কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনতে হবে। তাহলে অদূর ভবিষ্যতে গোল্ড রিফাইনারি ও জুয়েলারি সেক্টরকে একটি উদীয়মান রপ্তানি সেক্টর হিসেবে আমরা দেখতে পাব।’

দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘আমাদের পাশের দেশে জুয়েলারি পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে ভ্যাট ৩ শতাংশ। আমাদের দেশেও ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা উচিত। এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে আমি সংশ্লিষ্টদের কাছে চিঠি পাঠাবো।’ নীতি সহায়তা পেলে জুয়েলারি শিল্প এগিয়ে যাবে ও রপ্তানির মাধ্যমে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দেশে আনতে পারবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, ‘জুয়েলারি শিল্পে নানাভাবে নীতিসহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করি আমরা। স্বর্ণ আমদানি বাড়ানোর জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ আমরা নিয়েছি। তারপরও ব্যবসায়ীরা বৈধ পথে স্বর্ণ আমদানি বাড়াচ্ছেন না। ফলে এটা ভ্যাট-ট্যাক্সের সমস্যা নাকি অন্য সমস্যা, তা দেখতে হবে।’

তবে জুয়েলারি শিল্পের জন্য সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন; তিনি বলেন, ‘সরকার জুয়েলারি শিল্পে নেতিবাচক নয়, ইতিবাচক। এটা একটা বিশাল শিল্প। এ জন্য যা যা করণীয় আমার সাধ্যমতো করবো। ভ্যাট-ট্যাক্সসহ যে জটিলতাগুলো আছে সেগুলো আমরা আলােচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ বের করব। অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সবই মিলে বসে আলোচনা করে দ্রুতই একটা নীতি নির্ধারণ করা হবে। যত দ্রুত সম্ভব করবো।’