নজরুল কবির দীপু : কোন দেশে দুর্নীতির মাত্রা কেমন, সে সম্পর্কে ধারণা দিতে প্রতিবছর প্রতিবেদন প্রকাশ করে জার্মানির বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল। বিদায়ী ২০২৩ সালের জন্য দুর্নীতির ধারণাসূচক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল তারা। সেই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দুর্নীতির মাত্রা বিশ্বের যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি, তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। এর আগে ২০২২ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২তম।
এমন প্রেক্ষাপটে আমরা দেখছি, দেশের একশ্রেণির মানুষ অবৈধ উপায়ে সম্পদের পাহাড় গড়ছে। আরও ভয়াবহ ব্যাপার-তাদের অনেকেই আবার নিজেকে সন্দেহের বাইরে রাখতে অসাধু উপায়ে অর্জিত সম্পদ স্ত্রী-সন্তানের নামে রাখছে অথবা বিনিয়োগ করছে। ফলে স্ত্রী-সন্তানের আয়ের উৎস না থাকলেও তারা বনে যাচ্ছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক। তবে অনেক ক্ষেত্রেই শেষ রক্ষা হচ্ছে না। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে দুর্নীতিবাজের পাশাপাশি তাদের স্ত্রী-সন্তানরাও আইনের আওতায় আসছেন। এমন একাধিক ঘটনা আলোচিত হওয়ায় এ ধরনের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে।
দুদকের অনুসন্ধান ও মামলায় বিভিন্ন শ্রেণির সরকারি চাকরিজীবী, পেশাজীবী ও রাজনীতিকের সম্পদের তথ্য বেরিয়ে আসছে। ফলে অন্যের নামে সম্পদ করেও সেসব দুর্নীতিবাজ তো পার পাচ্ছেনই না, সঙ্গে ফাঁসছেন তাদের স্ত্রী-সন্তানও। এমনকি স্বামীর অপরাধলব্ধ সম্পদ অর্জনে সহযোগিতা করতে গিয়ে স্ত্রীর কারাবাসের নজিরও রয়েছে।
গত বছর বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতিবিষয়ক প্রতিবেদন বলেছিল, দুর্নীতি একটি মৌলিক উন্নয়ন সমস্যা। একদিকে দুর্নীতি দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে, অন্যদিকে তা দরিদ্র ও দুর্বলতমদের ওপর অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রভাব ফেলে- আয় হ্রাস পাওয়া, ব্যয় বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও ন্যায়বিচারসহ পরিষেবা থেকে বঞ্চনা ঘটে থাকে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়ন প্রত্যাশী গরিব দেশে দুর্নীতির এই ব্যাপকতায় চড়া আর্থিক বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে, অন্যদিকে রাষ্ট্রের কাছে প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়ার মতো সম্পদের অভাব দেখা দিচ্ছে।
আমরা দেখেছি, দুর্নীতিবাজদের কঠোর শাস্তি না হওয়ার কারণেই তারা বহুমাত্রিক অপরাধে জড়াচ্ছেন। এটাও সত্য, অনেক সময় স্ত্রী-সন্তানরা সচেতনতার অভাবে না জেনে এই দায় বহন করেন। আবার কেউ কেউ পরিবারের কর্তাকে দুর্নীতি করতে প্ররোচিতও করেন। সেক্ষেত্রে প্রথমেই দুর্নীতিবাজের শাস্তি হলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। তাই সমাজ থেকে দুর্নীতির শেকড় উপড়ে ফেলার বিকল্প নেই।
আমরা মনে করি, একজন দুর্নীতিবাজের পরিচয় কেবলই দুর্নীতিবাজ। দুর্নীতিবাজদের কোনো দল নেই, নীতি-আদর্শ নেই। তাই দুর্নীতি বন্ধে পরিবার থেকেই প্রতিবাদ শুরু হওয়া উচিত। পরিবারের যিনি উপার্জনক্ষম ব্যক্তি, তার বৈধ আয় অনুযায়ী অন্য সদস্যরা জীবনমান সাজালে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেটা না করে উপার্জনক্ষম ব্যক্তির ওপর বাড়তি চাপ দেওয়ায় তিনি দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ উপার্জনের পথে পা বাড়ান। একপর্যায়ে তা ব্যাপক আকার ধারণ করলে দুর্নীতিলব্ধ আয় বৈধ করতে তা দিয়ে স্ত্রী-সন্তানের নামে সম্পত্তি কেনেন। স্ত্রী-সন্তানরাও এর বিরোধিতা না করে ভোগ করেন। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
আশার কথা হচ্ছে, গত শুক্রবার (৩১ মে) ধানমন্ডিতে এক ব্রিফিংয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘যারা দুর্নীতি করেছে তাদের সবার তথ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আছে। দুর্নীতিবাজরা বিচারের আওতায় আসছে।’
আমরা আশা করি, দুর্নীতি হ্রাসে দুর্নীতিবাজদের অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদ অনুসন্ধানে দুদক আরও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। পাশাপাশি দুদককে জনগণের নির্ভরতা ও আস্থার জায়গায় পরিণত করতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে দেশপ্রেম, সততা, নিরপেক্ষতা ও পেশাদারির সঙ্গে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানাই আমরা।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।