নজরুল কবির দীপু : আমরা জানি, শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ড ছাড়া যেমন মানুষ দাঁড়াতে পারে না, তেমনি শিক্ষা ছাড়াও একটি জাতি উন্নতি ও সমৃদ্ধির শিখরে পৌঁছাতে পারে না। বিশ্বের বুকে যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সে জাতি তত বেশি উন্নত ও সমৃদ্ধ। শিক্ষা ছাড়া একটি রাষ্ট্রের সুষম উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। একটি জাতিকে ধ্বংস করে দিতে চাইলে শুধু এর শিক্ষাব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিলেই চলে।
পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশ শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়েছে। সারা দেশে এখন ভাঙাচোরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়া কঠিন। সরকার অবকাঠামোগত দিক থেকে বিরাট সহযোগিতা দিয়েছে। ভর্তি বেড়েছে। ছাত্রীরা পড়াশোনায় এগিয়েছে। পাসের হার বেড়েছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহও বেড়েছে। অবকাঠামো খাতেও বিরাট অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু এখনো বেশ কিছু ঘাটতি রয়েছে। এই ঘাটতি হচ্ছে মানসম্মত শিক্ষার অভাব।
প্রতিবছর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ভালো ফল করেও ভালো মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে না পেরে বহু শিক্ষার্থী পড়ালেখায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। পছন্দের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে না পেরে অনেক শিক্ষার্থী হতাশ হয়ে পড়ে। এর প্রভাব পড়ে তাদের উচ্চমাধ্যমিকের ফলে, এমনকি উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও। যারা এবার এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ভালো ফল অর্জন করেছে, ভালো মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়াটা তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, দেশে ভালোমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কম।
জানা যায়, দেশে মানসম্মত হিসাবে বিবেচিত কলেজের সংখ্যা দুই শতাধিক। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসন আছে ১ লাখের কাছাকাছি। ভর্তির ক্ষেত্রে এসব কলেজেই শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বেশি। মেধাবী শিক্ষার্থীদের আগ্রহ থাকে নামিদামি কলেজের প্রতি। মূলত এ কলেজগুলোয়ই ভর্তিতে তীব্র প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে। এবারও একই প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে।
এবার এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ১৬ লাখ ৭২ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী পাশ করেছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৮২ হাজার ১৩২ শিক্ষার্থী পেয়েছে জিপিএ-৫। সারা দেশে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তিযোগ্য আসন ২৫ লাখের মতো। উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে অনুমোদিত আসনের বিপরীতে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ৫০ শতাংশের মতো শিক্ষার্থী পায়, সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সার্বিক কর্মকাণ্ড খতিয়ে দেখা দরকার।
আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে সব স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো সমস্যার সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় মানসম্মত গবেষণাগার, লাইব্রেরি, খেলার মাঠসহ পর্যাপ্ত শিক্ষা সরঞ্জামের সরবরাহ নিশ্চিত করা দরকার। পাশাপাশি সব স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ করা দরকার।
ক্লাসকে যদি খুব আকর্ষণীয় করে তুলতে না পারা যায়, স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় পাসের জন্য প্রাইভেট-কোচিংয়ের দিকে ঝুঁকবে। সেটাই হচ্ছে। কিছু শিক্ষক এই প্রাইভেট-কোচিংয়ের সঙ্গে জড়িত। তবে কোচিংয়ের জন্য ঢালাওভাবে সব শিক্ষককে দোষারোপ করা যাবে না। এখন তো কিছু কোচিং করপোরেট হাউসের মতো হয়ে গেছে। তাদের শাখা উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।
শিক্ষকের মান বাড়াতে হবে। শিক্ষকতা পেশাকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আকর্ষণীয় পেশা হিসেবে তুলে ধরতে হবে এবং সেই অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদা বাড়াতে হবে। না হয় ভালো ছেলেমেয়েরা এই পেশায় আসবে না। এরপর শিক্ষকদের জন্য প্রচুর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
যেভাবেই হোক, দেশে মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়াতে হবে। শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করতে হবে। শূন্য পাশ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কী করে প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার মান বাড়ানো যায়, তা খতিয়ে দেখতে হবে। আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যদি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পিছিয়ে থাকে, তাহলে এসব প্রতিষ্ঠানে যে মানের জনশক্তি তৈরি হবে, তা দিয়ে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা কঠিন হবে। এই কারণে শিক্ষা খাতের পুনর্গঠনে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।