নজরুল কবির দীপু : করোনাভাইরাস মহামারির সময় ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যৌথভাবে টিকা উৎপাদন করেছে অ্যাস্ট্রাজেনেকা। কোভিশিল্ড নামে তাদের এই টিকা বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে গেছে। এর কার্যকারিতা সারা পৃথিবীতেই প্রশংসিত হয়েছে। এবার সেই টিকা নিয়ে মানবদেহে বিভিন্ন ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার অভিযোগ উঠেছে।
আমরা দেখেছি, বিশ্বকে লকডাউন থেকে বের করে আনার লড়াইয়ে রেকর্ড সময়ের মধ্যে কোভিড ভ্যাকসিন তৈরি করেছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা। অনেক দেশেই ব্যবহৃত প্রথম করোনা ভ্যাকসিন ছিল এই অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা। বিশ্বব্যাপী মহামারি মোকাবিলায় এই কোভিশিল্ড টিকা জীবনদায়ী ছিল বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
কিন্তু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার অভিযোগ ওঠায় বিশ্বজুড়ে তিনশ কোটির বেশি ডোজ দেওয়ার পর এ টিকা প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর, চলতি বছরের মার্চ মাসে অ্যাস্ট্রাজেনেকা এই টিকা বাজার থেকে তুলে নেওয়ার আবেদন করে। ৭ মে তা কার্যকর হয়। প্রশ্ন উঠেছে, বাজার থেকে উদ্বৃত্ত টিকা না-হয় প্রত্যাহার করে নেওয়া হলো, কিন্তু এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের কী হবে? স্বভাবতই এ নিয়ে মানুষ উদ্বিগ্ন।
টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মৃত্যু ও শারীরিক জটিলতার অভিযোগে যুক্তরাজ্যে ১০০ মিলিয়ন পাউন্ড ক্ষতিপূরণের দাবিতে অ্যাস্ট্রাজেনেকার বিরুদ্ধে মামলা চলছে। গত ফেব্রুয়ারিতে সেখানকার একটি আদালতে অ্যাস্ট্রাজেনেকা কর্তৃপক্ষ স্বীকার করে, ‘খুবই বিরল ক্ষেত্রে’ কোভিশিল্ডের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে, যার ফলে ‘টিটিএস’ বা ‘থ্রম্বোসিস উইথ থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া সিনড্রোম’ হতে পারে।
এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এ টিকা গ্রহণের ফলে মানবদেহে ‘থ্রম্বোসিস উইথ থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া সিনড্রোম’ (টিটিএস) নামে পরিচিত বিরল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। টিটিএস হলো এমন একটি অবস্থা, যার ফলে শরীরের অস্বাভাবিক কোনো জায়গায় রক্ত জমাট বাঁধে এবং রক্তে প্লাটিলেটের সংখ্যা কমে যায়। টিটিএসের উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে গুরুতর মাথাব্যথা, পেটে ব্যথা, পায়ে ফোলা ভাব, শ্বাসকষ্ট ও খিঁচুনি। উদ্বেগের কারণ এটাই।
ভারতের করুনিয়া নামের এক তরুণী কোভিশিল্ড টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মারা গেছেন—অভিযোগ করেছেন তাঁর বাবা বেণুগোপাল গোবিন্দ। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, সেরাম ইনস্টিটিউট, ভারত সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা—সবাই তাঁর মেয়েসহ আরও অনেক মৃত্যুর জন্য দায়ী।
বেণুগোপাল গোবিন্দের অভিযোগ, এই টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় যে এমন হতে পারে, তার পূর্বলক্ষণ থাকলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তখন ব্যবস্থা নেওয়া হলে এ রকম দুঃখজনক ঘটনা এড়ানো যেত। তিনি মেয়ের মৃত্যুর বিচার চান; প্রয়োজন হলে উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথাও বলেছেন তিনি। এ রকম আটটি পরিবার একত্র হয়েছে বলে জানিয়েছেন বেণুগোপাল গোবিন্দ। তারা সবাই প্রিয়জনের মৃত্যুর বিচার চায়। যারা এসব কাজের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিচারের আওতায় আনতে এই পরিবারগুলো বদ্ধপরিকর।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণার অংশীদার নিউজিল্যান্ডভিত্তিক গবেষণা সংস্থা জিভিটিভি জানিয়েছে, করোনার অন্যান্য ব্র্যান্ডের টিকাগুলো হৃৎপিণ্ড, মস্তিষ্ক ও রক্তে নানা ধরনের জটিলতা বাড়ায়। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসাবে এ পর্যন্ত ১৩ ধরনের শারীরিক জটিলতার রেকর্ড করেছেন গবেষকরা। গ্লোবাল ভ্যাকসিন ডাটা নেওয়ার্কের একদল গবেষক এই গবেষণা করেছেন। মার্চের প্রথম সপ্তাহে গবেষণা প্রবন্ধটি প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী ‘ভ্যাকসিন’।
গবেষণায় বিশ্বের ১৩টি দেশে ৯ কোটি ৯০ লাখ মানুষের তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে যারা এমআরএন টিকা ফাইজার, এন-বায়োটেক কিংবা মর্ডানা টিকার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ডোজ নিয়েছেন তাদের একাংশ মায়োকার্ডিটি নামক হৃৎপিণ্ডের সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছেন। এছাড়া যারা অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৃতীয় ডোজ সম্পন্ন করেছেন তাদের একাংশ পেরি-কার্ডিটিতে আক্রান্ত হয়েছেন। যারা এই সমস্যায় আক্রান্ত হয় তাদের হৃৎপিণ্ডের কার্ডিয়াক মাংসপেশিতে সমস্যা হয়। এছাড়া ফাইজার মর্ডানার টিকার ডোজে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়া জিবিএস এবং মায়োলিটিসির মতো শারীরিক সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায় ২ দশমিক ৫ গুণ। মায়োলিটিসে আক্রান্তরা মস্তিষ্ক এবং মেরুদণ্ডের প্রদাহে ভোগেন। তবে টিকা নেওয়া বেশির ভাগ মানুষই যে এসব সমস্যায় ভোগে বিষয়টা এমনো নয়- বলেছেন গবেষকরা।
অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার, মর্ডানা-সব ব্র্যান্ডের টিকাই আমাদের দেশে ব্যবহৃত হয়েছে। দেশে শুধু অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকাই দেওয়া হয়েছে ৫ কোটির বেশি ডোজ। অনেকেই এ টিকা একাধিক ডোজ নিয়েছেন। কাজেই পরীক্ষা করে দেখা দরকার দেশে কারা এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় আক্রান্ত। তাদের চিকিৎসাই বা কী। এ বিষয়ে হেলাফেলার সুযোগ নেই। কিন্তু এখনই নাকি সুনিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় কার কোন স্বাস্থ্য সমস্যাটি টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াজনিত।
অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা গ্রহণকারীদের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে কি না, তা খুঁজে দেখতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে ইতিমধ্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন। তিনি বলেছেন, ওই টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিষয়ে তিনি শুনেছেন, কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কোনো প্রমাণ পেলে ওই সব টিকা দেওয়া হবে না।
দেশে করোনার বিভিন্ন ব্র্যান্ডের টিকা গ্রহণ পরবর্তী শারীরিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে এমন একাধিক ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে অনেকের মনে রাখার ক্ষমতা কমে গেছে। অর্থাৎ ভুলে যাওয়া প্রবণতা বাড়ছে। অনেকের সামান্য পরিশ্রমে হাঁপিয়ে ওঠা, শারীরিক দুর্বলতা, ঘুম কমে যাওয়া, অবসাদগ্রস্ততা, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের সমস্যা দেখা দিয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভোগা ব্যক্তিদের টিকা নিয়ে পুরোনো ও বিরল রোগব্যাধি ফের মাথাচাড়া দিয়েছে। যদি কেউ টিকা নেওয়ার পর এই লক্ষণগুলো দেখতে পান তবে দ্রুত একজন চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করা উচিত।
আমরা মনে করি, বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বেই এ নিয়ে দ্রুত গবেষণা হওয়া উচিত, যাতে করোনা টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়। করোনা টিকা তৈরিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে এ ব্যাপারে ক্ষতিপূরণ আদায় করা যায় কিনা, তা-ও খতিয়ে দেখা উচিত।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।