ঢাকা : গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারীদের লভ্যাংশের ২৫ কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাতের মামলায় নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি পিছিয়ে গেছে।
বৃহস্পতিবার আসামিপক্ষের সময়ের আবেদন মঞ্জুর করে ঢাকার ৪ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক সৈয়দ আরাফাত হোসেন এ মামলায় অভিযোগ গঠনের শুনানির জন্য ২ জুন নতুন তারিখ রেখেছেন।
অর্থ আত্মসাতের এ মামলায় অভিযোগ গঠনের শুনানি পেছানোর জন্য সময়ের আবেদন করেছিলেন ইউনূসের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন।
বিচারক তখন বলেন, “আপনারা অব্যাহতির আবেদন দিতে পারেননি বলে সময় চেয়েছেন, সেটা যৌক্তিক কারণ নয়। আপনাদের শুনানিতে প্রস্তুতি নেই বলে সময় চাইলে সেটা মঞ্জুর করা যেতে পারে।”
ইউনূসসহ এ মামলার আসামিরা জামিনে ছিলেন। তাদের জামিনের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদনও মঞ্জুর করেন বিচারক।
বৃহস্পতিবার অভিযোগ গঠনের শুনানিতে অংশ নিতে বেলা ১১টা ২০ মিনিটে বিশেষ জজ আদালত-৪ এ হাজির হন ইউনূস। আদালতে প্রবেশের আগে আদালত পারার উল্টোদিকে জংশন রোডে স্টার কাবাব রেস্তোরাঁয় চা পান করেন তিনি। সেসময় তার সঙ্গে ছিলেন ব্যারিস্টার আব্দুল আল মামুন।
ইউনূস ছাড়া এ মামলার অপর আসামিরা হলেন– গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নাজমুল ইসলাম, পরিচালক ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশরাফুল হাসান, পরিচালক পারভীন মাহমুদ, নাজনীন সুলতানা, মো. শাহজাহান, নূরজাহান বেগম, এস এম হাজ্জাতুল ইসলাম লতিফী, অ্যাডভোকেট মো. ইউসুফ আলী, অ্যাডভোকেট জাফরুল হাসান শরীফ, গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি মো. কামরুজ্জামান, সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ মাহমুদ হাসান, প্রতিনিধি মো. মাইনুল ইসলাম এবং গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের দপ্তর সম্পাদক কামরুল হাসান।
শুনানিতে আসামি গ্রামীণ টেলিকমের পরিচালক পারভীন মাহমুদের পাসপোর্ট সাময়িক কিছুদিনের জন্য ফেরত চান তার আইনজীবী শাহীনুর ইসলাম অনি।
তিনি বলেন, “উনি (পারভীন মাহমুদ) অস্ট্রেলিয়া যাবেন বলে ভিসা করা জরুরি। এ কারণে পাসপোর্ট যেটা জমা ছিল আদালতে, সেটা সাময়িক কিছুদিনের জন্য ফেরত চাই।”
সেসময় রাষ্ট্রপক্ষে দুদকের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, “উনি ভিসা পেতে পারেন। পাসপোর্ট ফেরত পেতে পারেন। আমাদের কোনো আপত্তি নেই।”
গত ২ এপ্রিল এ মামলার অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে শুনানির জন্য বিশেষ জজ আদালত-৪ এ পাঠিয়ে দেন ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন।
গ্রামীণ টেলিকমের কর্মীদের লভ্যাংশের ২৫ কোটি ২২ লাখ ৬ হাজার ৭৮০ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গত ১ ফেব্রুয়ারি অভিযোগপত্র জমা দেয় দুদক।
দুর্নীতি বিরোধী সংস্থাটির উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান বাদী হয়ে ২০২৩ সালের ৩০ মে এই মামলা দায়ের করেন। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, আসামিরা অর্থ আত্মসাৎ ও অবৈধভাবে স্থানান্তর করছেন, যা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অপরাধ।
এজাহারে বলা হয়, ইউনূস ও নাজমুল ইসলামসহ গ্রামীণ টেলিকম বোর্ড সদস্যদের উপস্থিতিতে ২০২২ সালের ৯ মে অনুষ্ঠিত ১০৮তম বোর্ডের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ঢাকা ব্যাংকের গুলশান শাখায় হিসাব খোলা হয়। তবে ব্যাংকে হিসাব খোলা হয় এক দিন আগেই।
গ্রামীণ টেলিকমের কর্মচারীদের পাওনা লভ্যাংশ বিতরণের জন্য গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন এবং গ্রামীণ টেলিকমের সঙ্গে সেটেলমেন্ট চুক্তি হয় ওই বছরের ২৭ এপ্রিল। সেটেলমেন্ট চুক্তিতেও ৮ মে ব্যাংক হিসাব দেখানো আছে, যা বাস্তবে অসম্ভব। ‘ভুয়া’ সেটেলমেন্ট চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ও ১০৮তম বোর্ডের সিদ্ধান্ত মোতাবেক গ্রামীণ টেলিকমের ৪৩৭ কোটি ১ লাখ ১২ হাজার ৬২১ টাকা ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের মিরপুর শাখা থেকে ঢাকা ব্যাংকের গুলশান শাখায় স্থানান্তর করা হয় ২০২২ সালের ১০ মে।
পরে ২২ জুন অনুষ্ঠিত ১০৯তম বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অ্যাডভোকেট ফি হিসাবে অতিরিক্ত ১ কোটি ৬৩ লাখ ৯১ হাজার ৩৮৯ টাকা প্রদানের বিষয়টি অনুমোদন দেওয়া হয়।
অন্যদিকে ঢাকা ব্যাংকের গুলশান শাখার হিসাব থেকে গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন নামীয় ডাচ বাংলা ব্যাংকের লোকাল অফিসের হিসাব থেকে তিন দফায় মোট ২৬ কোটি ২২ লাখ ৬ হাজার ৭৮০ টাকা স্থানান্তর করা হয়।
কিন্তু কর্মচারীদের লভ্যাংশ বিতরণের পূর্বেই তাদের প্রাপ্য অর্থ তাদের না জানিয়েই ‘অসৎ উদ্দেশ্যে’ ২০২২ সালের মে ও জুন মাসের বিভিন্ন সময়ে সিবিএ নেতা মো. কামরুজ্জামান, মাইনুল ইসলাম ও ফিরোজ মাহমুদ হাসানের ডাচ বাংলা ব্যাংকের মিরপুর শাখার হিসাবে ৩ কোটি টাকা করে স্থানান্তর করা হয়।
একইভাবে আইনজীবী মো. ইউসুফ আলীর কমার্শিয়াল ব্যাংক অফ সিলনের ধানমন্ডি শাখার হিসাবে ৪ কোটি টাকা ও দি সিটি ব্যাংকের গুলশান শাখার হিসাবে ৫ কোটি টাকা এবং আইনজীবী জাফরুল হাসান শরীফ ও আইনজীবী মো. ইউসুফ আলীর স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের গুলশান নর্থ শাখায় যৌথ হিসাবে ৬ কোটি স্থানান্তর করা হয়, যা তাদের প্রাপ্য ছিল না।
দুদকের রেকর্ডপত্র অনুযায়ী, অ্যাডভোকেট ফি হিসেবে প্রকৃতপক্ষে হস্তান্তরিত হয়েছে মাত্র ১ কোটি টাকা। বাকি ২৫ কোটি ২২ লাখ ৬ হাজার ৭৮০ টাকা গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বোর্ড সদস্যদের সহায়তায় গ্রামীণ টেলিকমের সিবিএ নেতা এবং আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সেটেলমেন্ট চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে ‘অসৎ উদ্দেশে জালিয়াতির আশ্রয়ে গ্রামীণ টেলিকম থেকে উক্ত অর্থ আত্মসাৎ করেছেন‘।
এটি দণ্ডবিধি ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় ‘শাস্তিযোগ্য অপরাধ’ উল্লেখ করে এজাহারে বলা হয়, “যে কারণে আসামি ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯/৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/১০৯ ধারা এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২)(৩) ধারায় মামলাটি দায়ের করা হয়েছে।”