সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

লোডশেডিং থামবে কবে?

প্রকাশিতঃ ২৮ এপ্রিল ২০২৪ | ১২:৫৬ অপরাহ্ন


নজরুল কবির দীপু : তীব্র দাবদাহে দেশজুড়ে বেড়েছে বিদ্যুতের চাহিদা। ক্রমবর্ধমান এই চাহিদা পূরণে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। সম্প্রতি বিদ্যুতের উৎপাদনে রেকর্ড করেছে। এরপরও বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। অভিযোগ আছে, সারা দেশে দৈনিক বিদ্যুতের প্রকৃত ঘাটতি দুই হাজার মেগাওয়াটের বেশি থাকলেও সরকারি তথ্যে দেখানো হচ্ছে প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট। ঘাটতি বিদ্যুতের পুরোটাই দেশের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে পূরণ করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাষ্ট্রীয় সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) ও ন্যাশনাল লোড ডিসপ্যাচ সেন্টারের (এনএলডিসি) দৈনিক প্রতিবেদনে লোডশেডিংয়ের সঠিক তথ্য তুলে ধরা হচ্ছে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে দিনের বেলা বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহে দুই হাজার মেগাওয়াটের বেশি ঘাটতি রয়েছে। কিন্তু সরকারি এই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের দৈনিক প্রতিবেদনে সর্বোচ্চ লোডশেডিং দেখাচ্ছে এক হাজার মেগাওয়াটের মতো।

গ্রামাঞ্চলের পাশাপাশি নগরীতেও বেড়েছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। বলার অপেক্ষা রাখে না, পানি ও বিদ্যুতের এ সংকট জনজীবনে দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি ব্যাহত হচ্ছে শিল্প খাতের উৎপাদন। গ্রামাঞ্চলে বিঘ্নিত হচ্ছে সেচকাজ।

এ বছর দেশে গরমের তীব্রতা অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি অনুভূত হচ্ছে। গত কয়েকদিন ধরে তীব্র দাবদাহে হিট স্ট্রোকে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। এ অবস্থায় সরকার কিছুদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা অসুস্থ ব্যক্তি, শিশু ও বেশি বয়স্কদের জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হওয়া থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু লোডশেডিংয়ের কারণে ঘরেও স্বস্তিতে নেই মানুষ।

লোডশেডিংয়ের কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রাথমিক জ্বালানির অনিশ্চিত সরবরাহ, গ্যাস–সংকট, তেল আমদানির বিশাল বকেয়া, অভ্যন্তরীণ গ্যাস উৎপাদনে বিশাল বকেয়া, বেসরকারি খাতে মিথ্যা ঘোষণার ত্রুটিপূর্ণ বিদ্যুৎকেন্দ্র, বিদ্যুৎকেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণ এবং ব্যাকআপ পরিকল্পনা জোড়াতালিনির্ভর। আরেকটি কারণ হচ্ছে, উৎপাদনের সঙ্গে সঞ্চালনের বিনিয়োগ সমন্বয় না থাকা। অন্যায্য পরিমাণে ক্যাপাসিটি চার্জ প্রদানের অস্বচ্ছ মডেলে অপ্রমাণিত সক্ষমতার হিসেবে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৪ হাজার মেগাওয়াট, কিন্তু নিয়মিত সঞ্চালন সক্ষমতা এর চেয়ে অনেক কম। এক দশকে বিদ্যুৎ খাতে শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ হলেও চাহিদার বিপরীতে সঠিক উৎপাদন, উৎপাদনের বিপরীতে সঞ্চালন এবং সঞ্চালনের বিপরীতে বিতরণ অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়নি।

বরং কিছু ব্যবসায়ী উৎপাদনের সহজ কাজে যুক্ত হয়ে নিজেরা আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন এবং এতে রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় হয়েছে। যার প্রমাণ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের রেকর্ড লোকসান। একদিকে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, ডলার–সংকট এবং অসম্ভব খরুচে চুক্তির কারণে দেড় বছরে গড় ব্যয় বেড়েছে ৮১ শতাংশ, অন্যদিকে রেন্টাল, আইপিপি (ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) এবং সরকারি বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বকেয়া পড়েছে প্রায় ২৮ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। সরকার নিজেই অর্থসংকটে থাকায় ২০২২ সালের শুরু থেকে বিদ্যুৎ খাতে নিয়মিত ভর্তুকি ছাড় করছে না অর্থ মন্ত্রণালয়। ২০২৩ সাল থেকে আদানির অন্যায্য ক্যাপাসিটি চার্জ এবং রূপপুরের রুশ ঋণের কিস্তি প্রদান শুরু হলে পিডিবির দেনার দায় সীমাহীন হবে।

ডলার–সংকট ছাড়াও লোডশেডিংয়ের অন্যান্য কাঠামোগত কারণ আছে। একটি হচ্ছে চাহিদার সঙ্গে সঞ্চালন ও বিতরণ অবকাঠামোর সক্ষমতা না থাকা। গ্রীষ্মের গরমে যখন চাহিদা বাড়ে, তখন সারা দেশে পল্লী বিদ্যুৎসহ বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রায় ৭০ হাজার ট্রান্সফরমার ঝুঁকিতে থাকে, ফলে লোডশেডিং না করা হলে পুড়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। অর্থাৎ চাহিদার সঙ্গে বিতরণব্যবস্থা অসমন্বিত।

সঞ্চালন লাইনে ত্রুটি ছাড়াও বিদ্যুৎ সরবরাহে চরম অব্যবস্থাপনারও অভিযোগ রয়েছে। এসব সমস্যা দূর করা গেলে বিদ্যুৎ সংকটের সমাধান হতে পারে। তাই এ দিকটিতে অবিলম্বে দৃষ্টি দেওয়া দরকার। নয়তো পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদিত হলেও এর সুফল পাবে না মানুষ ও শিল্প খাত।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।