সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

সড়কে আর কত মৃত্যু হলে কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে?

প্রকাশিতঃ ২১ এপ্রিল ২০২৪ | ৯:১২ পূর্বাহ্ন


নজরুল কবির দীপু : দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো যেন একেকটা ভয়ংকর মৃত্যুফাঁদ; কোন মুহূর্তে কার প্রাণ যাবে, কেউ বলতে পারেন না। এমনকি একটি পরিবারের সব সদস্যের মৃত্যুর ঘটনাও এই দেশে খুব বিরল নয়। সর্বশেষ গত মার্চে সারা দেশে সংঘটিত ৫৫২ সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৬৫ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ১ হাজার ২২৮ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে মোটরসাইকেলে। ১৮১ বাইক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ২০৩ জনের, যা মোট দুর্ঘটনার ৩২ দশমিক ৭৮ শতাংশ এবং মোট নিহতের ৩৫ দশমিক ৯২ শতাংশ।

দেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার অত্যন্ত বেশি—প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে ৮৫ দশমিক ৫। পশ্চিমা দেশগুলোতে এই হার প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে মাত্র ৩। এ দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর কত লোক নিহত হন, তা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত নেই। পুলিশের হিসাবে সংখ্যাটি তিন-চার হাজারের বেশি নয়, কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে তা ২০ থেকে ২১ হাজারের বেশি। আর বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি নামের এক বেসরকারি সংস্থা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে হিসাব করে যে পরিসংখ্যান দিয়ে থাকে, তাতে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ৬ হাজার থেকে সাড়ে ৮ হাজার পর্যন্ত মানুষ।

এ দেশে সড়ক দুর্ঘটনার অতি উচ্চ হারের কারণগুলো বিশেষজ্ঞরা মোটা দাগে চিহ্নিত করেছেন। একটি প্রধান কারণ নির্ধারিত গতিসীমার চেয়ে অনেক বেশি গতিতে যান চালানোর প্রবণতা। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলেন, সড়কের সংকীর্ণতা, বিপজ্জনক বাঁক ইত্যাদি সমস্যাকে ছাপিয়ে যায় বেপরোয়া যান চালানোর প্রবণতা। অনেক চালক রাস্তা ফাঁকা পেলেই যানবাহনের গতি বিপজ্জনক মাত্রায় বাড়িয়ে দেন, ফলে দুর্ঘটনা বেশি হয়, হতাহত মানুষের সংখ্যাও অনেক বাড়ে। বেপরোয়া যান চালিয়ে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে প্রাণহানির দায়ে চালকের বিচার ও শাস্তি হয় না। এমনকি শাস্তির দাবি উঠলে, কিংবা মামলা হলে মোটরযান শ্রমিকেরা আন্দোলন শুরু করেন, মন্ত্রী পর্যায়ের নেতারাও সেই অন্যায় আন্দোলনে ইন্ধন জোগান। এভাবে চালকদের দোষে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনাগুলো প্রতিকারহীন থেকে যায়।

এসব কারণে দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো যেন ভয়ংকর মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। গত কয়েক দশকে দেশে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও সড়কে চলাচলের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়নি। সড়কে চলছে লাখ লাখ অবৈধ যানবাহন। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে শৃঙ্খলা ফেরানোর উদ্যোগ মোটেই দৃশ্যমান নয়। ফলে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে।

২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করলে সড়ককে নিরাপদ করতে কর্তৃপক্ষ নানা আশ্বাস দিয়েছিল; কিন্তু বাস্তবতা হলো সড়ককে এখনো নিরাপদ করা যায়নি। দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো ছাড়াও অনেকে পঙ্গু হচ্ছেন। প্রাণ হারানো বা পঙ্গু হওয়া ব্যক্তিটি যদি পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি হন, তাহলে সেই পরিবারটির অবস্থা কী হয়, তা সহজেই অনুমেয়।

সড়ক দুর্ঘটনার নানা কারণের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো-গাড়ির বেপরোয়া গতি, চালকের অদক্ষতা, চালকের ক্লান্তি, অতিরিক্ত যাত্রী বহন, সড়কের ত্রুটি, সড়কের পাশে হাটবাজার, ত্রুটিযুক্ত যানবাহন ইত্যাদি। সড়ক-মহাসড়কে যান চলাচলের সর্বোচ্চ গতি বেঁধে দিয়ে এবং গতি পরিমাপক যন্ত্র ব্যবহার করে চালকদের ওই নির্দিষ্ট গতি মেনে চলতে বাধ্য করা হলে আশা করা যায়, দুর্ঘটনা অনেক কমে আসবে। কম গতির নিষিদ্ধ যানবাহনের কারণেও মহাসড়কে ঝুঁকি বাড়ছে।

সড়ক-মহাসড়কের অন্যান্য ঝুঁকি এড়াতেও নিতে হবে পদক্ষেপ। সড়ক দুর্ঘটনার কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে নানা পরামর্শ ও সুপারিশ প্রদান করা হলেও তা যে অরণ্যে রোদনে পর্যবসিত হচ্ছে, দেশে প্রতিদিন ঘটা দুর্ঘটনাগুলোই এর বড় প্রমাণ।

দুর্ঘটনা রোধে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা দরকার। ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনাসহ সড়ক ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন ক্ষেত্রে লোকবল কম, এ তথ্য আমরা জানি। তবে দুর্নীতি রোধে কর্তৃপক্ষ কঠোর হলে কম লোকবল নিয়েও বিভিন্ন ধরনের অভিযানে কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া সম্ভব।

ক্লান্ত-শ্রান্ত চালক গাড়ি চালালে স্বভাবতই তাতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে। কর্তৃপক্ষকে এসব দিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কর্তৃপক্ষকে কঠোর হতে হবে। পরিবহণ কর্মীদের জীবনমানের উন্নয়নেও পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে যত পরিকল্পনাই গ্রহণ করা হোক না কেন, দুর্নীতি রোধ করা না গেলে কাঙ্ক্ষিত ফল মিলবে কিনা সন্দেহ।

বর্তমানে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ, ট্রাফিক পুলিশ—সবাই যেন ধরে নিয়েছে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণহানি ও অঙ্গহানি যেন অপ্রতিকার্য সমস্যা। কিন্তু এটা চরম দায়িত্বহীনতার পরিচায়ক। বিশেষজ্ঞদের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে সচেষ্ট হলে সড়ক দুর্ঘটনার এই অস্বাভাবিক উচ্চ হার অবশ্যই কিছু মাত্রায় কমানো সম্ভব। সবচেয়ে জরুরি সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান ঘটাতে হবে।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।