জিন্নাত আয়ুব : চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা-কর্ণফুলী) আসনের সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান চৌধুরী যখন ভূমিমন্ত্রী ছিলেন তখন আনোয়ারা-কর্ণফুলীতে তেমন কর্মসূচি পালন করতে দেখা যেত না ২০১৪ সাল থেকে সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য ওয়াসিকা আয়শা খানকে।
অভিযোগ— আওয়ামী লীগের আমৃত্যু প্রেসিডিয়াম সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আতাউর রহমান খান কায়সারের মেয়ে ওয়াসিকা আয়শা খানকে আনোয়ারা-কর্ণফুলীতে কোনও কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হতো না। তাঁর কর্মসূচিতে সহযোগিতা করায় কিছু নেতাকর্মীকে নানামুখী হয়রানি, হামলা-মারধরের শিকারও হতে হয়েছে অতীতে।
কিন্তু নতুন মন্ত্রিসভায় সাইফুজ্জামান চৌধুরী ঠাঁই না পাওয়ার পর ধীরে ধীরে পরিস্থিতি পাল্টে যায়।
এখন আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলার প্রধান সড়কে রাজনৈতিক সাইনবোর্ড, ব্যানারের ছড়াছড়ি। তাতে দুজন নেতার উপস্থিতিই বেশি। কোনোটায় সংসদ সদস্য, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী কোনোটায় অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খানের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে।
অর্থাৎ আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলার রাজনীতি এখন প্রকাশ্যে এই দুই নেতাকে কেন্দ্র করে দুটি ধারায় বিভক্ত। দলের নেতা-কর্মীরা বলছেন, একসময় আনোয়ারা ও কর্ণফুলীর একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল সাইফুজ্জামান চৌধুরীর। তবে বর্তমানে পরিস্থিতি ভিন্ন। সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য ওয়াসিকা আয়শা খান অর্থ প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর সাইফুজ্জামান চৌধুরীর দাপট কমতে শুরু করেছে।
একসময় সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে ছিলেন এমন অনেকে এখন অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকার পক্ষে ভিড়ছেন।
গত ৭ মার্চ কর্ণফুলী উপজেলায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এবং ২৩ মার্চ আনোয়ারা উপজেলার পারকিতে মতবিনিময় সভায় বক্তব্য দেন ওয়াসিকা আয়শা খান। তিনি একটি সভায় বলেছিলেন, ‘রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। যেখানে শেষ হয়েছে, সেখান থেকে শুরু হবে। আমি আনোয়ারা-কর্ণফুলীর বঞ্চিত নেতা–কর্মীদের নিয়েই এগিয়ে যাব।’
এরপর গত ২৯ মার্চ দুপুরে আনোয়ারায় অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ৩৫ পরিবারকে টিন ও নগদ অর্থ বিতরণকালে সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেছেন, তাঁর এলাকায় কোনো দ্বৈত শাসন চলবে না। এই এলাকার প্রশাসনকে তিনি দিকনির্দেশনা দেবেন।
সাইফুজ্জামান চৌধুরী সরাসরি কারও নাম উল্লেখ না করলেও অর্থ প্রতিমন্ত্রী ও তাঁর অনুসারীদের উদ্দেশে এই বক্তব্য দিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন।
সাবেক এই ভূমিমন্ত্রী বলেন, ‘কে কী হয়েছে, কোন পদ পেয়েছে, সে বিষয় দেখার দায়িত্ব আমার নয়। আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, সাংবিধানিকভাবে আমি নির্বাচিত প্রতিনিধি, আমার এলাকায় কোনো দ্বৈত শাসন চলবে না। এই এলাকার প্রশাসনকে আমি দিকনির্দেশনা দেব। এলাকায় কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি করতে হলে এক সপ্তাহ আগে প্রশাসন থেকে অনুমতি নিতে হবে আয়োজকদের। অনুমতি না নিয়ে কোনো সমাবেশ করতে দেওয়া হবে না।’
সাইফুজ্জামান চৌধুরী আরও বলেন, ‘মানুষের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি আমি। জনগণকে কীভাবে শান্তিতে রাখতে হয়, সেই বিষয়টি দেখার দায়িত্ব আমার। মাদক ব্যবসা, ভূমিদস্যুতার সঙ্গে জড়িতদের একসময় রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম। সেই দুর্বৃত্তরা আবারও মাঠে ফিরেছে। তারা যেন কোনো অপকর্ম করে বেড়াতে না পারে, সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে।’
সাইফুজ্জামান-ওয়াসিকা দ্বৈরথের মধ্যে গত ১৪ এপ্রিল কর্ণফুলীর শাহ আমানত সেতুর দক্ষিণপাড় শিকলবাহা এলাকার সেতুর নিচে গোলচত্ত্বর প্রাঙ্গণে বৈশাখী মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ওয়াসিকা আয়েশা খান। সাইফুজ্জামান চৌধুরীর অনুপস্থিতিতে এমন আয়োজন আনোয়ারা-কর্ণফুলীতে আলোচনার ঝড় তোলে।
কারণ উক্ত অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম-১২ আসনের সংসদ সদস্য, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলাম, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শাহজাদা মহিউদ্দিন, সংরক্ষিত আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও দক্ষিণ জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বেগম চেমন আরা তৈয়ব, সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য, দক্ষিণ জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীমা হারুন লুবনাসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।
এরই ধারাবাহিকতায় আগামীকাল শনিবার (২০ এপ্রিল) বিকেলে আনোয়ারার চাতরী চৌমুহনী বাজারের দক্ষিণ পাশে ঈদ পুনর্মিলনী ও বর্ষবরণ উদযাপন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান। স্বাভাবিকভাবে এই আয়োজন নিয়েও উপজেলার সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা শ্রমিক লীগের একজন নেতা বলেন, ‘আনোয়ারা-কর্ণফুলীর অধিকাংশ সাধারণ মানুষ সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সাথে সরাসরি কথা বলতে পারেন না বা সহযোগিতা পান না। দুই উপজেলায় বছরের পর বছর ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করা হয়নি। একজন এপিএসের ইচ্ছায় সাংগঠনিক কমিটি গঠন করা হতো, বিচার করা হতো। এ নিয়ে মানুষ ক্ষুব্ধ ছিল। কিন্তু বিকল্প নেতৃত্ব না পাওয়ায় এই ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেনি। এখন ওয়াসিকা আয়শা খান অর্থ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর স্থানীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়েছেন। তাই তার পক্ষে এক ধরণের জনস্রোত দেখা যাচ্ছে।’
আনোয়ারা উপজেলার বারশত ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য ও ইউপি সদস্য তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। কিন্তু ১২ বছর ধরে সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ভাইকে কয়েকজন নেতা ঘিরে রেখেছেন। আমাদের মতো তৃণমূলের কর্মীরা কোনও অভিযোগ, অনুযোগ জানাতে পারেন না। তাই আমরা ওয়াসিকা আপার হাত ধরে প্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে এই উপজেলায় সরব রাখতে চাই।’
বৈরাগ এলাকার বাসিন্দা যুবলীগকর্মী জানে আলম বলেন, ‘আমরা গ্রামে রাজনীতি করি। আমরা কোনও সমস্যা নিয়ে কোনও সময় জাবেদ ভাই পর্যন্ত পৌঁছাতে পারি নাই। উপজেলার কিছু নেতা ওনার কাছে যেতে দেন না। তাদের কারণে সত্যিকারের ভুক্তভোগীরা হয়রানির শিকার হয়েছেন।’
তবে আনোয়ারা উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক জিয়া উদ্দিন বাবলু বলেন, ‘আমরা সবাই আওয়ামী লীগ, এটা হোক আমাদের পরিচয়। এখানে আমরা যুদ্ধ করব না। আমাদের সবার লক্ষ্য একটাই জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করা। সেটা যার মাধ্যমেই হোক।’
সাইফুজ্জামান-ওয়াসিকা দ্বৈরথ সম্পর্কে জানতে চাইলে আনোয়ারা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি কাজী মোজাম্মেল হক বলেন, ‘এখানে আমাদের পাল্টাপাল্টি কিছু করার নেই। আমাদের সবার লক্ষ্য আনোয়ারা উপজেলা আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করে নেত্রীর হাতকে শক্তিশালী করা। হিংসা-বিদ্বেষের কিছু নেই।’