নজরুল কবির দীপু : রমজান মাসে সংযত জীবনযাপনের কঠোর অনুশাসন আত্মিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধন তথা মনের পবিত্রতা অর্জনের এক সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয়। মানুষের আত্মশুদ্ধির একটি বলিষ্ঠ হাতিয়ার সিয়াম পালন বা রোজা। মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার মধ্য দিয়ে মানুষ তার পাশবিক প্রবৃত্তিকে সংযত এবং আত্মিক শক্তিকে জাগ্রত ও বিকশিত করে তোলার পরিপূর্ণ সুযোগ লাভ করে।
আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি লাভে অন্তর পবিত্র বা আত্মশুদ্ধির বিকল্প নেই। পবিত্রতা শুধু বাহ্যিক পবিত্রতা নয় বরং বিশ্বাসের পবিত্রতা, কর্মের পবিত্রতা, শারীরিক ও মানসিক পবিত্রতা, আর্থিক পবিত্রতা, বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ পবিত্রতা, পরিবেশের পবিত্রতা বুঝায়। এক কথায় সর্বক্ষেত্রে পবিত্রতা অবলম্বনের শিক্ষা আমরা পবিত্র কুরআন থেকেই পেয়ে থাকি। কেননা আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই, সে বিষয়ে কোনো অবস্থান নিও না। নিশ্চয় কর্ণ, চক্ষু, হৃদয়, এগুলোর প্রতিটি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে।’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত : ৩৬)।
আমাদের প্রয়োজন আত্মশুদ্ধির। আমাদের অন্তর পবিত্র না করে যত ভালো কাজই করি না কেন কোনো লাভ নেই। রমজানের ত্রিশ রোজা রাখলাম, অনেক মানুষকে ইফতার করালাম, দান-খয়রাত করলাম কিন্তু নিজ আত্মশুদ্ধির দিকে দৃষ্টি দিলাম না এতে কিন্তু আমার কোনো লাভ নেই। কেননা হাদিস শরিফে এসেছে, ‘জেনে রেখ, মানুষের দেহের মধ্যে একখণ্ড মাংসপিণ্ড আছে, যখন তা সংশোধিত হয়, তখন গোটা দেহ সংশোধিত হয়ে যায়। আর যখন তা দূষিত হয়, তখন পুরো দেহ দূষিত হয়ে যায়। মনে রেখ, সেটাই অন্তর।’ (সহিহ বুখারি)। মহানবি হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের আকৃতি ও সম্পদের দিকে তাকান না, বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও সৎকর্মের প্রতিই লক্ষ করেন। এরপর রাসূল (সা.) অন্তর দেখানোর জন্য আঙুল দিয়ে নিজের বুকের দিকে ইশারা করেন।’ (সহিহ্ মুসলিম, হাদিস : ২৫৬৪)।
আমরা বিভিন্ন বক্তৃতায় অপরকে অনেক ভালো জ্ঞান দিয়ে থাকি কিন্তু নিজেই তা পালন করি না। এমনটি হলে সেই উপদেশ কখনো কাজে আসবে না। আমরা যদি নিজে সৎভাবে চলি আর অন্যদেরও সৎপথে চলার নির্দেশ দেই, তবেই একটি আদর্শ সমাজ ও দেশ গড়তে পারে। তাই প্রথমে আমাদের নিজেদের সৎ ও পবিত্র হৃদয়ের অধিকারী হতে হবে। বিশেষ করে আল্লাহতায়ালা যেসব কাজ হারাম করেছেন, তা থেকে বেঁচে থাকা একজন মুমিনের একান্ত কর্তব্য। তাই প্রথমে নিজে সৎ ও পবিত্র হৃদয়ের হব, সব ধরনের হারাম কাজ পরিত্যাগ করব, তারপর অন্যকে সৎ হতে উৎসাহিত করব। চলার পথে প্রতিনিয়ত অনেক মন্দ বিষয় আমাদের দৃষ্টিতে পড়ে। আমাদের উচিত, সেগুলোকে প্রতিহত করা। যেভাবে মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা যদি খারাপ কিছু দেখ তাহলে নিজ হাতে তা দূর কর, আর তা নিজ হাতে না পারলে নিজ জিহ্বা দ্বারা একে মন্দ বলে নিষেধ কর, আর তাও যদি না পার, তাহলে মনে মনে একে ঘৃণা কর ও দোয়া কর আর এমন করাটা বিশ্বাসের দিক থেকে সর্ব নিম্ন পর্যায়ের।’ (মুসলিম)।
নৈতিক অধঃপতনের এক চরম সীমায় আজ আমরা বসবাস করছি। যে দিকেই তাকাই, শুধু মন্দকর্মই যেন ছেয়ে আছে। আজ আমরা পার্থিব জগতের মোহে আল্লাহর অসন্তুষ্টির পথে ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছি। ভালো-মন্দের পার্থক্য করা ভুলে গেছি। পাপ করতে করতে এমন হয়েছে যে পাপকে পাপই মনে হয় না। হাদিসে সাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবি (সা.) বলেছেন, আমি আমার উম্মতের একদল সম্পর্কে অবশ্যই জানি, যারা কিয়ামতের দিন তিহামার শুভ্র পর্বতমালার সমতুল্য নেক আমলসহ উপস্থিত হবে। মহামহিম আল্লাহ সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করবেন। সাওবান (রা.) বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! তাদের পরিচয় পরিষ্কারভাবে আমাদের কাছে বর্ণনা করুন, যাতে অজ্ঞাতসারে আমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত না হই। তিনি বলেন, তারা তোমাদেরই ভ্রাতৃগোষ্ঠী এবং তোমাদের সম্প্রদায়ভুক্ত। তারা রাতের বেলা তোমাদের মতো ইবাদত করবে। কিন্তু তারা এমন লোক যে একান্ত গোপনে আল্লাহর হারামকৃত বিষয়ে লিপ্ত হবে। (ইবনে মাজাহ)।
বিশ্বময় করোনায় লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, এটি প্রত্যক্ষ করেও যদি আমি আত্মশুদ্ধির চেষ্টা না করি তাহলে আমার চেয়ে বোকা আর কে আছে। পাপ কাজ পরিহার করে সৎ পথে চলার সময় কি এখনো আসেনি? অথচ আল্লাহ এবং তার রাসূল (সা.) আমাদের সতর্ক করে গেছেন আমরা যেন সৎ কাজে লিপ্ত থাকি। আমরা যদি সৎকাজ ও পবিত্রতা অবলম্বন করি, তাহলে আল্লাহ পাকের কৃপার চাদরে আমরা আবৃত থাকব আর আল্লাহর নিরাপত্তায় থাকলে দুনিয়ার বিপদ আমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
রমজানের ফরজ রোজা বা অন্যান্য দিনের নফল রোজা, যে রোজাই হোক না কেন তা আমাদের আত্মার সংশোধনের কারণ হয়ে থাকে। আর বিশেষ করে পবিত্র মাহে রমজানের রোজা আমাদের পুরো বছরের দোষত্রুটি ক্ষমার কারণ হয়। কেননা, মানুষ যখন আল্লাহতায়ালার জন্য জাগতিক আরাম-আয়েশ, চাওয়া-পাওয়া ইত্যাদি থেকে বিরত থাকে তখন সে তার নফসকে পুণ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখতে অধিক শক্তি পায়। কিন্তু এ বিষয়টি স্মরণ রাখা উচিত, রোজার প্রকৃত উদ্দেশ্য কেবল উপবাস থাকাই নয়। যদি উপবাস থাকার ফলে খোদার জান্নাত পাওয়া যেত তাহলে প্রতিটি ব্যক্তি এ জান্নাত পাওয়ার চেষ্টা করত। কেননা উপবাস থেকে মৃত্যুবরণ করে নেওয়াটা তেমন কোনো কঠিন বিষয় নয় বরং কঠিন বিষয় হলো আধ্যাত্মিক ও চারিত্রিক পরিবর্তন সাধন করা।
আমরা জানি, ঈদ ধনী-দরিদ্র, সুখী-অসুখী, আবালবৃদ্ধবনিতা সব মানুষের জন্য কোনো না কোনোভাবে নিয়ে আসে নির্মল আনন্দের আয়োজন। ঈদ ধর্মীয় বিধিবিধানের মাধ্যমে সর্বস্তরের মানুষকে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস নেয় এবং পরস্পরের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের শিক্ষা দেয়। মহান সৃষ্টিকর্তার দরবারে আমাদের কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা হলো জগতের সব মানুষের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি। পৃথিবী সর্বপ্রকার হিংসা-বিদ্বেষ ও হানাহানিমুক্ত হোক! সন্ত্রাসের বিভীষিকা দূর হোক! আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের বন্ধন দৃঢ়তর হোক! আগামী দিনগুলো সুন্দর ও সৌন্দর্যমণ্ডিত হোক! হাসি-খুশি ও ঈদের আনন্দে ভরে উঠুক প্রতিটি প্রাণ। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সংযম, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির পরিবেশ পরিব্যাপ্তি লাভ করুক—এটাই হোক ঈদ উৎসবের ঐকান্তিক কামনা। সবাইকে পবিত্র ঈদুল ফিতরের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও আন্তরিক অভিনন্দন— ‘ঈদ মোবারক!’
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।