সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

কোন মিশনে মেজর ইকবাল চট্টগ্রামে?

প্রকাশিতঃ ৭ অক্টোবর ২০১৭ | ৫:৫১ অপরাহ্ন

প্রত্যয় মজুমদার: চট্টগ্রামের অপরাধ জগতের পরিচিত নাম- মেজর ইকবাল। বেশ কয়েকটি নৃশংস খুনের ঘটনার প্রধান অভিযুক্ত তিনি। ৭ বছর জেল খেটে ২০১০ সালে জামিনে মুক্তি পান ইকবাল। এরপর দুবাই গিয়ে পলাতক থাকেন আরও ৭ বছর। মাস দুয়েক আগে দেশে ফিরেছেন এ শীর্ষ সন্ত্রাসী। ভয়ংকর এই সন্ত্রাসীর দেশে ফেরার কারণ অনুসন্ধানে মিলেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।

মেজর ইকবাল নামে পরিচিত এই সন্ত্রাসীর আসল নাম মো. ইকবাল হোসেন। ইকবালের নামের আগে মেজর হওয়া নিয়ে মর্মান্তিক একটি ঘটনা আছে। একদিন মোটরসাইকেল নিয়ে চলার পথে থামিয়ে ইকবালকে ছুরিকাঘাত করে প্রতিপক্ষ কুখ্যাত সন্ত্রাসী বিধান বড়ুয়ার অনুগতরা। এতে পেটের বড় অংশ কেটে যায়। এরপর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার পেটে ‘মেজর’ মানে বড় অপারেশন হয়। সেই থেকে অপরাধ জগতে তার নাম হয়ে যায়- মেজর ইকবাল!

চট্টগ্রামের রাউজানের বাসিন্দা মেজর ইকবাল জেলা পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। বর্তমানে ইকবাল প্রকাশ্য চলাফেরার কারণে সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে পরিচিত রাউজানে নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ইকবালের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একটি সূত্রের দাবি, বড় একটি ঘটনা ঘটানোর জন্য ইকবালকে দেশে আনা হয়েছে। আর তাকে আনার পেছনে রয়েছে এক জনপ্রতিনিধির হাত।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাউজানের একজন বাসিন্দা বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে রাউজান উপজেলা আওয়ামী লীগ অফিসে মেজর ইকবালকে একাধিকবার দেখা গেছে। আরেক ভয়ংকর সন্ত্রাসী আজিজও সেখানে প্রায়ই যাতায়াত করে । দুইজনের বিরুদ্ধেই গ্রেফতারি পরোয়ানা আছে। গত সপ্তাহে রাউজান উপজেলা আওয়ামী লীগ অফিসে গিয়েছিল র‌্যাবের একটি দল। ধারণা করছি, তাদেরকে ধরতে সেখানে গিয়েছিল।’

চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফখরুদ্দিন মোহাম্মদ বাবর ও রাউজান কলেজ ছাত্র সংসদের সহসভাপতি (ভিপি) মজিবুর রহমানকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ১৯৮৯ সালে; নৃশংস এসব খুনের ঘটনার মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসেন মেজর ইকবাল।

১৯৯৩ সালে পূর্ব গুজরা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আকতার হোসেন ওরফে রাজুকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়; এ মামলায় প্রধান আসামি হন মেজর ইকবাল।

রাউজানের দুই ভাই টিটু ও মিঠুকে একসঙ্গে হত্যা, মুক্তিযোদ্ধা নিহার কান্তি বিশ্বাস হত্যা, ইকবাল ও জামিল নামে ছাত্রলীগের দুই কর্মীকে একসঙ্গে হত্যাসহ বেশ কয়েকটি হত্যা মামলায় মেজর ইকবাল আসামি হয়েছিলেন।

অভিযোগ রয়েছে, সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর সন্ত্রাসী বাহিনীর অন্যতম ক্যাডার হিসেবে মেজর ইকবাল রাউজানে বেশ কয়েকটি খুন করেন। ১৯৮৯ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত সাকা বাহিনীর সদস্য হিসেবে তিনি সন্ত্রাস ও হত্যাকাণ্ড ঘটাতেন।

১৯৯১ সালে নতুন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি) গঠন করেন সাকা চৌধুরী; এরপর মেজর ইকবাল ওই দলে যোগ দেন। ১৯৯৬ সালে এনডিপি বিলুপ্ত করে বিএনপিতে যোগ দেন সাকা। তখন ইকবালও সাকার সঙ্গে দলবদল করেন। অবশ্য পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দলবদল করে প্রগতিশীল দলটিতে যোগ দেন মেজর ইকবাল।
একই সময়ে বিয়ে করেন বিএনপির এক শীর্ষ নেতার বোনকে; অসংখ্য নাশকতার মামলায় বর্তমানে কারাবন্দি আছেন ওই নেতা।

২০০৪ সালের ১ জানুয়ারি গ্রেফতার হয়েছিলেন মেজর ইকবাল। সে সময় হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগে মেজর ইকবালের বিরুদ্ধে ২২ টি মামলা ছিল। বন্দিজীবনে নতুন করে আরও বেশ কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসীর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠে মেজর ইকবালের। বন্দি থাকাকালীন কারাগারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন তিনি। এ কারণে চট্টগ্রাম কারাগার থেকে তাকে বেশ কয়েকবার কুমিল্লা ও সিলেট কারাগারে পাঠানো হয়েছিল।

এদিকে একে একে সব মামলায় জামিন পেলেও তিনি দীর্ঘদিন স্বেচ্ছায় কারাগারে ছিলেন। ২০১০ সালের ৩১ মার্চ আদালত থেকে হাজিরা পরোয়ানা প্রত্যাহার হলে একই বছরের ২ এপ্রিল তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। ওই সময় কারাফটক থেকে ইকবালকে ফের হেফাজতে নিতে চেয়েছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী একটি বাহিনীর সদস্যরা। তবে একজন জনপ্রতিনিধি নিজের গাড়িতে উঠিয়ে ইকবালকে সেখান থেকে নিয়ে আসেন। সে যাত্রায় বেঁচে যাওয়ার পর দুবাই পাড়ি জমান তিনি।

বিগত জীবনে অনেক দুঃসময় পার করে আসতে হয়েছে মেজর ইকবালকে। হত্যার শিকার হতে হয় তার ভাই ইস্কান্দরকে। ১৯৯৯ সালের দিকে হালিশহরের একটি বাসা থেকে তার রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করেছিল পুলিশ। এরপর ইস্কান্দরের দুই মেয়ের লাশ উদ্ধার হয় পুকুর থেকে।

ইকবালের ভাই ইস্কান্দরকে মৃত্যুর আগে সন্ত্রাসী কাজে ব্যবহার করেছিল সাকা চৌধুরী। যুক্তরাষ্ট্রে তৈরী ‘টমি গান’ নিয়ে সাকা চৌধুরীর গাড়ি থেকে গ্রেফতার হন ইস্কান্দর, ১৯৯৪ সালে। এ ঘটনায় রাউজান থানায় মামলা হয়। সে সময় পিটুনিতে মারাত্মক আহত হন ইস্কান্দর। ব্যান্ডেজে মোড়া ছিল তার সারা শরীর। ভাইয়ের এ অবস্থা দেখে প্রতিশোধ পরায়ণ, হিংস্র হয়ে উঠেন মেজর ইকবাল।

র‌্যাব-৭ চট্টগ্রামের অধিনায়ক লে. কর্ণেল মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এক সময় সে ভয়ংকর অপরাধে লিপ্ত ছিল বলে শুনেছি। তখন তো আমি ছিলাম না। তার ব্যাপারে আমি খোঁজ নিচ্ছি।’