মনীষা হত্যার বিচার দাবির ৩৩ ঘণ্টার মাথায় নিজের হত্যার বিচারের হাহাকার!

প্রত্যয় জসিম : গত শনিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) স্বামীর বাড়িতে হত্যার শিকার হন সিটি কলেজ হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্স ১ম পবের মেধাবী ছাত্র মনীষা দাশ। হত্যা করে লাশ ঝুলিয়ে রেখে আত্মহত্যা বলে প্রচারণা চালিয়ে পার পাবার চেষ্টা করছিলেন মনীষার স্বামীর বাড়ির লোকজন।

৪ অক্টোবর রাত ১০টা ৪১ মিনিটে এ বিষয়ে পোস্ট দিয়ে মনীষাকে সিটি কলেজের বোন উল্লেখ করে তার হত্যার বিচার দাবি করেন সুদীপ্ত বিশ্বাস (৩০)। সেই পোস্টের মাত্র ৩৩ ঘণ্টার মাথায় নিজেই লাশ হয়ে গেলেন প্রতিবাদী সুদীপ্ত। সৃষ্টি করলেন নিজের হত্যার বিচারের আরেকটি হাহাকার।

শুক্রবার সকাল সাড়ে ৮ টায় বাসা থেকে ডেকে নিয়ে সুদীপ্তকে প্রকাশ্যে হত্যার ১৭ ঘণ্টা পরও পুলিশ কাউকে আটক করতে পারেনি। উদ্ধার করতে পারেনি হত্যার কোনো মোটিভ।

এদিকে, হত্যার আগের দিন দুপুরে আকস্মিক সিটি কলেজ ক্যাম্পাসে গিয়ে বন্ধুদের জড়ো করে ছবি তুলে তা ফেসবুকে পোস্ট দেন সুদীপ্ত। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা ৪৮ মিনিটে প্রিয় সহপাঠিদের সাথে তোলা দুটি ছবি আপলোড দিয়ে তাতে সুদীপ্ত লিখেন ‘হঠাত প্রাণপ্রিয় কলেজ ক্যাম্পাসে।’

বন্ধুরা বলছেন, সুদীপ্ত হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন এটা তার শেষদিন, তাই বন্ধুদের সাথে মিলিত হয়ে ছবি তুলতে আকুল হয়ে উঠেছিলেন আগেরদিন। নিষ্ঠুরভাবে সুদীপ্ত মারা যাবার পর এখন এই কথাগুলোই বন্ধুদের মুখে মুখে ফিরছে।

জানা যায়, চট্টগ্রাম সিটি কলেজ থেকে মাস্টার্স করা সুদীপ্ত বিশ্বাস নগর ছাত্রলীগের সহ সম্পাদক হলেও চিন্তা চেতনায় স্বাতন্ত্র্যতা বজায় রেখে চলতেন। ফলে বন্ধুদের কাছে পরিচিত ছিলেন ঠোঁটকাটা, বিপ্লবী ও কট্টর সমালোচক হিসেবে। রাজনীতিতে যখনই যাদের আচরণ দৃষ্টিকটু ও অশোভন মনে হতো তিনি তাদের ইংগিত করে কথা বলতে ছাড়তেন না। এমনকি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে কখনো কখনো সমালোচনার ঝড় তুলতেন। এজন্য নিজেদের মধ্যেই খুব সহসা কিছু শত্রু তৈরি হয়।

গত ১০ দিনে তার ধারাবাহিক ফেসবুক স্ট্যাটাসগুলো দেখলে তা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠে।

গত ২৬ সেপ্টেম্বর রাত ১০টার দিকে তিনি লিখেন, ‘এবার প্রিয় নেত্রীর জন্মদিন পুরোনো ছাত্রলীগ নেতা বাদ দিয়ে নতুন নেতৃত্ব দিয়ে উদযাপন করা হোক।’

২৭ সেপ্টেম্বর রাত ৮টা ১০ মিনিটে লিখেন, ‘দীর্ঘ ১২-১৩ বছর কলেজ ক্যাম্পাসে দুপুরবেলা না খাওয়া ছেলেগুলোকে কেউ একবেলা খাওয়াতে আসেনি। আজ বড় বড় কথা শুনে হাসি পায়।’

২৮ সেপ্টেম্বর রাত ৮ টার দিকে পোস্ট দেন ‘কলেজের বারান্দায় হাঁটেনি এমন পাবলিকও আজকাল মিছিল-পরবর্তী সমাবেশের মঞ্চে উঠে। নোংরামি আর কত?’

১ অক্টোবর দুপুর ২টার দিকে লিখেন ‘ রাজনীতি বড়ই জটিল জিনিস। একসময়কার কথিত ডাস্টবিন এখন ফুলের বাগানে সৌরভ ছড়াচ্ছে।’

৩ অক্টোবর দুপুর দেড়টার দিকে লিখেন, ‘ওয়ান ইলেভেনে অনেককেই দেখিনাই রাজপথে…ও সরি এটা বললে আবার অন্যায়।’

৪ অক্টোবর দুপুর তিনটার দিকে লিখেন, প্রজা ছাড়া রাজার দাম নেই, তেমনি কর্মীছাড়া নেতার দাম নেই।’
একইদিন সন্ধ্যা ৭টায় আরও একটি পোস্ট দেন সুদীপ্ত বিশ্বাস। লিখেন, সুস্থ হোক মানসিকভাবে অসুস্থ রোগীগুলো…গেট উইল সোন।’

সর্বশেষ মৃত্যুর আগের দিন রাতে দুই শব্দের একটি স্ট্যাটাস দেন। রাত ১১টা ৪২ মিনিটে তাতে সুদীপ্ত লিখেন ‘অপেক্ষায় রইলাম।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব বাঁকা কথামালায় রাজনীতিতে তৈরি হওয়া ক্ষোভ থেকে এই হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে বলে ধারণা করছেন অনেকেই।

পুলিশ এই বিষয়গুলো সামনে রেখেই মোটিভ উদ্ধারে চেষ্টা চালাচ্ছে জানিয়ে সদরঘাট থানার ওসি মরজিনা আক্তার বলেন, বাইরের কেউ নয়, সতীর্থদের মাঝ থেকেই কেউ কেউ এই ঘটনা ঘটাতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে। তবে হত্যাকারী যারাই হোক তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসব আমরা।