কিশোর গ্যাং দমনে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি


নজরুল কবির দীপু : পুলিশের হিসাবে, চট্টগ্রাম মহানগরে এখন সক্রিয় রয়েছে অন্তত ২০০ কিশোর গ্যাং। একেক দলে রয়েছে ৫ থেকে ১৫ জন। নগরজুড়ে এদের সদস্যসংখ্যা অন্তত ১ হাজার ৪০০। এলাকায় নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে খুনোখুনি থেকে শুরু করে জায়গা দখল, অপহরণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মারামারি, অস্ত্রবাজি, উত্ত্যক্তসহ নানা অপরাধে জড়িয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।

২০১৮ সালে নগরের জামাল খান এলাকায় স্কুলছাত্র আদনান ইসফারকে গুলি করে খুনের ঘটনার পর নগরে কিশোর গ্যাং আলোচনায় আসে। এর পরের বছর নগর পুলিশ কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা করে। এর পর থেকে গত ছয় বছরে ৫৪৮টি অপরাধের ঘটনায় কিশোর গ্যাং জড়িত বলে জানায় পুলিশ। এর মধ্যে খুনের ঘটনা ঘটেছে ৩৪টি।

পুলিশের দাবি, উঠতি তরুণদের দলে ভেড়াতে প্রশ্রয় দিচ্ছেন চট্টগ্রাম সিটির ৫ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ ৬৪ ‘বড় ভাই’। নগরের গুরুত্বপূর্ণ ৪৫টি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন তারা। মূলত এলাকায় চাঁদা আদায়ের জন্য আধিপত্য বজায় রাখতে তারা কিশোর গ্যাং গড়ে তোলেন। চাঁদার একটি অংশ ব্যয় হয় গ্যাংয়ের সদস্যদের পেছনেও।

গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এলাকাভিত্তিক কিশোর গ্যাংয়ের প্রধানসহ ১৮৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব-পুলিশ। সর্বশেষ গত বুধবার রাতে চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ছয়টি কিশোর গ্যাংয়ের প্রধানসহ ৩৩ জনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। র‍্যাব-৭ চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক (গণমাধ্যম) নুরুল আবসার জানিয়েছেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা আসন্ন পবিত্র ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ে জড়িত ছিল বলে তথ্য পেয়েছে র‍্যাব।

কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে এমন অভিযান, একটি ভালো উদ্যোগ বলে মনে করি আমরা। যদিও আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ অভিযানেও বন্ধ হয়নি কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য। আর এর কারণ হলো কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকরা ক্ষমতাশালী এবং অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের, বিশেষত ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী। তারা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেন। রাজনৈতিক দলের মিছিল-মিটিংয়ে লোক জোগান দেওয়াসহ এলাকায় দলীয় আধিপত্য বিস্তারে কিশোর গ্যাংকে ব্যবহার করা হয়।

পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, এসব পৃষ্ঠপোষকের মধ্যে রয়েছেন বিভিন্ন ওয়ার্ড কাউন্সিলর, রাজনৈতিক দলের কতিপয় নেতারা। কাজেই কিশোর গ্যাং দমন করতে হলে কেবল গ্যাংয়ের সদস্যদের গ্রেপ্তার করলেই চলবে না, তাদের গডফাদারদের বিরুদ্ধেও নিতে হবে ব্যবস্থা।

বস্তুত কিশোর গ্যাং এখন এক আতঙ্কের নাম। তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে এরা অহরহ খুন-খারাবি করছে। ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে জড়িত এই কিশোররা। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে তারা। চট্টগ্রাম নগরের কয়েকটি এলাকার বাসিন্দারা কিশোর গ্যাংয়ের হাতে রীতিমতো জিম্মি।

তবে শুধু চট্টগ্রাম নয়, সারা দেশেই এখন কিশোর গ্যাংগুলো মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সবার আগে প্রয়োজন কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকদের দমন করা। তাদের রাজনৈতিক পরিচয় যা-ই হোক না কেন, তাদের আইনের আওতায় আনা। এক্ষেত্রে কোনো শৈথিল্যের সুযোগ নেই।

যদিও পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, যে কোনো মূল্যে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণ করা হবে। বিশেষ করে যারা কিশোর গ্যাং লালন-পালন করেন অর্থাৎ যারা গডফাদার, তাদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করছে পুলিশ। ইতোমধ্যে অনেকের নাম পাওয়া গেছে। শিগগিরই তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে প্রভাবশালী বা অন্য কোনো পরিচয়ে কেউ ছাড় পাবে না।

কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকদের দমনে পুলিশের এ কঠোর অবস্থানের যেন পরিবর্তন না হয় কোনোভাবেই। অন্যদিকে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছারও প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করি আমরা। কিশোর গ্যাংয়ের কারণে যে দেশে অপরাধ বাড়ছে এবং তাতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। আমরা আশা করব, সরকারের নীতিনির্ধারকরা বিষয়টি অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন।

কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যেন কোনো অদৃশ্য বাধার সম্মুখীন হতে না হয়; বরং তারা সরকারের কাছ থেকে এ ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতা পাবেন, এটাই আশা করি আমরা।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।