সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে কে

প্রকাশিতঃ ২৪ মার্চ ২০২৪ | ১২:১৫ অপরাহ্ন


নজরুল কবির দীপু : চালের বাজারে অস্থিরতা চলে আসছে বহুদিন থেকে। বাজারে চালের সংকট নেই, অথচ দাম বেড়েই চলেছে। চালের বাজারের অস্থিরতা দূর করতে অতীতে বারবার অভিযান চালানো হলেও তেমন সুফল পওয়া যায়নি। এক্ষেত্রে বাজার তদারকি সংস্থার অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে অসাধু ব্যবসায়ীদের আঁতাতের বিষয়টি বারবার আলোচনায় এসেছে।

এবার জানা গেল, খাদ্য বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর দায়িত্বে অবহেলা ও লোভের কারণে চালের বাজার স্বাভাবিক রাখা যাচ্ছে না। বস্তুত প্রতিবছরই চালের বাজার নিয়ে এক ধরনের কারসাজিতে মেতে ওঠেন ব্যবসায়ীরা। এ কারণে চালের বাজার প্রায় সারা বছরই অস্থির থাকে। ধান-চালের অবৈধ মজুতের সঙ্গে খাদ্য বিভাগের মাঠ পর্যায়ের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশের বিষয়টি উদ্বেগজনক।

জানা যায়, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এক ব্যক্তিকে একাধিক ফুড গ্রেইন লাইসেন্স দিচ্ছেন। লাইসেন্সপ্রাপ্ত কিছু প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা সরেজমিন দেখা হয় না বলেও অভিযোগ উঠেছে। এ সুযোগেই অবৈধভাবে চালের মজুত গড়ে তুলছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। অবৈধ মজুতের দায়ে ব্যবসায়ীদের জরিমানা করা হলেও মজুতের প্রবণতা কেন কমছে না, তা তদন্ত করে দেখা দরকার। অসাধু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বাজার তদারকি সংস্থার অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আঁতাতের বিষয়টি আলোচনায় এলেও তাদের বিরুদ্ধ কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা জানা যায় না।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ধান-চালের বাজারে কৃষক থেকে ভোক্তাপর্যায়ে পৌঁছাতে পাঁচবার হাতবদল হয়। প্রতিবার হাতবদলের সময় যোগ হয় খরচ আর মুনাফা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুনাফা করছেন চালকলের মালিকেরা। তাঁরা প্রতি কেজি চাল ও এর উপজাত বিক্রি করে ৮ থেকে ১৩ টাকা ৬৬ পয়সা পর্যন্ত মুনাফা করছেন। যদিও চালকলের মালিকেরা এ মুনাফার কথা অস্বীকার করছেন।

গবেষণায় দেখা গেছে, বাজারে ধান-চালের ব্যবসায় মূলত পাঁচটি পক্ষ জড়িত। প্রথমত, কৃষক নিজে; দ্বিতীয়ত, ফড়িয়ারা; তৃতীয়ত, আড়তদারেরা; চতুর্থত, চালকলমালিকেরা ও পঞ্চমত, চালের খুচরা বিক্রেতারা। এর মধ্যে সবচেয়ে কম লাভ করেন ফড়িয়ারা। প্রতি কেজি ধানে ৫০ থেকে ৬৫ পয়সা। আড়তের মালিকেরা প্রতি কেজিতে ১ টাকা ৭৫ পয়সা পর্যন্ত মুনাফা করে থাকেন। তাঁদের খরচ বলতে দোকান ও গুদামের ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল ও শ্রমিক-কর্মচারীদের মজুরি।

মূলত চালকলের মালিকদের কারণে দাম দ্রুত বাড়ছে। ফলে চালকলগুলোর উচিত তারা কত দামে ধান কিনে তা কীভাবে চালে পরিণত করছে এবং ধান ও উপজাত বাবদ মোট কী পরিমাণ মুনাফা করছে, তার হিসাব দেওয়া। আর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত, চালকলের মালিকদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে চালের মিলগেট দাম কমানোর উদ্যোগ নেওয়া।

আমরা দেখছি, আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান হওয়ায় চালকলের মালিকেরা চালের বাজারে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রশ্ন হলো খাদ্য মন্ত্রণালয় কাজটি করবে কি না। এর আগে যখনই চালের দাম বেড়েছে, সরকার দু-একটি বাজারে অভিযান চালিয়ে কিছু মজুত চাল উদ্ধার করেই দায়িত্ব শেষ করেছে।

ভরা মৌসুমে যেসব কারসাজির কারণে চালের বাজার অস্থির হয়, সেসব কারসাজির রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করা হলে বাজার অস্থিরতার কারণ জানা যেতে পারে। প্রশ্ন হলো, ধান-চালের অবৈধ মজুতের সঙ্গে শুধু কি খাদ্য বিভাগের মাঠ পর্যায়ের অসাধু কর্মকর্তারাই জড়িত? এসব অসাধু কর্মকর্তার অপকর্মের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যারা জড়িত, তাদেরও চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা দরকার।

যেহেতু সিন্ডিকেটের কারসাজির কারণে সারা বছর চালের বাজার অস্থির থাকে, সেহেতু এ ধরনের অপকর্মে যারাই জড়িত থাকুক, সবাইকে দ্রুত আইনের আওতায় আনা দরকার। চালের ভোক্তা সব শ্রেণির মানুষ। কাজেই ভোক্তার স্বার্থসংরক্ষণে যা যা করা দরকার, তার সবই করতে হবে।

বহুদিন ধরে প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্য বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দরে। ফলে নিত্যপণ্যের বাজারে ক্রেতার দীর্ঘশ্বাস বেড়েই চলেছে। এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে গরিব মানুষ। সরকারের পক্ষ থেকে ভোক্তাদের স্বস্তির বিষয়ে নানা রকম আশ্বাস দেওয়া হলেও বাস্তবে ভোক্তারা এসব আশ্বাসের সুফল পায় না। নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রে এ দুর্ভোগ অব্যাহত থাকলে এর অনিবার্য পরিণতি হিসাবে দরিদ্র ও স্বল্প-আয়ের মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভুগবে।

তবে চালের দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সবার আগে ভাবতে হবে কৃষকের কথা। আসল উৎপাদকের কথা। যে আমন সে ঘরে তুলতে পারেননি, তিনি কীভাবে বোরো আবাদে সর্বস্ব উজাড় করে দেবেন। তেল, সার, কীটনাশক, সেচ, বীজ—এগুলো লাগবেই। প্রকৃত কৃষকের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে এগুলো পৌঁছে দেওয়ার একটা পথ আমাদের বের করতেই হবে।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।