নজরুল কবির দীপু : চট্টগ্রাম শহরে প্রায়ই দেখা যায় ফাঁকা রাস্তায় বিকট শব্দে হর্ন বাজিয়ে দ্রুতগতিতে ছুটছে গাড়ি ও বাইক। পুরো রাস্তা প্রায় খালি থাকার পরও হর্ন বাজায় অনেক চালক। কারণে-অকারণে হর্ন বাজানোর প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। অন্যের কান ঝালাপালা হলেও চালকের যেন তাতে কিছু এসে যায় না।
শুধু বন্দরনগরী নয়, ঢাকাসহ সারা দেশেই শব্দদূষণ দিন দিন বাড়ছে। অনেক চালকের মনোভাব দেখে মনে হয়, শুধু হর্ন দিলেই সব সমাধান হয়ে যাবে, কিন্তু হয় উল্টোটা। সমাধানের বদলে আশপাশে থাকা মানুষ মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে।
বর্তমানে শব্দদূষণের মাত্রা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এ হারে শব্দদূষণ চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে বিপুলসংখ্যক মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়বে। বর্তমানে উচ্চশব্দের কারণে বিভিন্ন বয়সি মানুষ শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বন্দরনগরীর পাশাপাশি বিভিন্ন নগর-মহানগরে, এমনকি কোনো কোনো গ্রামীণ জনপদেও শব্দদূষণ সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। শব্দদূষণের কুফল বিষয়ে জনসচেতনতার অভাব এবং দূষণ প্রতিরোধে যথাযথ প্রশাসনিক নজরদারি ও পদক্ষেপের ঘাটতির কারণেই এমনটি হচ্ছে। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে বিধিমালা প্রণয়ন করা হলেও এর প্রয়োগ খুবই অপ্রতুল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘসময় অতিরিক্ত শব্দের মধ্যে থাকার কারণে হাইপারটেনশন, আলসার, হৃদ্রোগ, মাথাব্যথা, স্মরণশক্তি হ্রাস, স্নায়ুর সমস্যা ও মানসিক চাপ তৈরি হতে পারে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কান। অন্যদিকে উচ্চ শব্দ শিশু, গর্ভবতী মা, হৃদ্রোগীর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। শব্দদূষণের ফলে শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, আকস্মিক উচ্চ শব্দ মানবদেহের রক্তচাপ ও হৃৎকম্পন বাড়িয়ে দেয়, মাংসপেশির সংকোচন করে, পরিপাকে বিঘ্ন ঘটায়, শিরা ও স্নায়ুতন্ত্রের ওপর প্রচণ্ড চাপ দেয়।
৬০ ডেসিবল মাত্রার শব্দে মানুষের সাময়িক শ্রবণশক্তি নষ্ট এবং ১০০ ডেসিবল মাত্রার শব্দে স্থায়ীভাবে শ্রবণশক্তি হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। শব্দদূষণের বর্তমান অবস্থা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে বন্দরনগরীর বিপুলসংখ্যক মানুষ মারাত্মক ক্ষতির শিকার হবে। কাজেই এ বিষয়ে উদাসীন থাকার সুযোগ নেই।
বন্দরনগরীতে শব্দদূষণের বহু উৎস রয়েছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। যানবাহনের হর্ন, নির্মাণকাজ, সংস্কারের সময় সেবা সংস্থাগুলোর সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি, মাইকের ব্যবহার, শিল্পকারখানা-কোনো ক্ষেত্রেই শব্দদূষণ বিষয়ে যথাযথ নিয়ম মানা হয় না। বস্তুত চট্টগ্রাম শহরের ব্যস্ত সড়কে নামলে কখনো কখনো মনে হয়, যানবাহনের চালকরা হর্ন বাজানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। এক্ষেত্রে চালকের পাশে যারা থাকেন, তাদের দায়িত্বশীল হতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, তীব্র শব্দ মানবদেহের স্নায়ুতন্ত্রের ওপর নানা মাত্রায় প্রভাব ফেলে। উচ্চমাত্রার শব্দ বিভিন্ন রোগের কারণ হতে পারে। উচ্চমাত্রার শব্দ আংশিক বা পূর্ণ বধিরতারও কারণ হতে পারে। শব্দদূষণের কারণে নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি হলেও দূষণরোধে কর্তৃপক্ষের জোরালো তৎপরতা একেবারেই দৃশ্যমান নয়। সাধারণ মানুষ এ বিষয়ে খুব একটা সচেতন নয়। শব্দদূষণ নিয়ে বছরে দু-একদিন সভা-সেমিনার, কর্মশালা ইত্যাদির আয়োজন করা হলে তেমন সুফল মিলবে না। এসব আয়োজনের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে শব্দদূষণের বিষয়ে সচেতন করার পদক্ষেপও নিতে হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের করা এক জরিপে উঠে এসেছে, মাত্রাতিরিক্ত শব্দের কারণে ইতিমধ্যেই দেশের প্রায় ১২ শতাংশ মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস পেয়েছে। একই সঙ্গে বর্তমানে শব্দদূষণের যে মাত্রা, সেটা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে ২০২৩ সাল নাগাদ এক তৃতীয়াংশ মানুষ এর দ্বারা আক্রান্ত হবে। তারা বধিরতায় আক্রান্ত তো হবেই, পাশাপাশি ক্ষুধামান্দ্য, রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, কাজে মনোযোগী হতে না পারা, কানের মধ্যে ভোঁ ভোঁ করাসহ হৃদ্রোগের সমস্যাও হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে যে বিধিমালা রয়েছে, সেখানে বিস্তারিত বলা আছে, কোনো এলাকায় দিনের কোন সময়ে কোন ধরনের শব্দের মাত্রা কেমন হবে। কিন্তু বলতে গেলে কেউই মানছে না এ নিয়ম।
কর্তৃপক্ষের উচিত শব্দদূষণের উৎসগুলো চিহ্নিত করে দূষণ রোধে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া। দেশে বায়ুদূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এছাড়া পানি ও মাটি দূষণের বিষয়টিও বহুল আলোচিত। যেহেতু দেশে পরিবেশদূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, সেহেতু সব ধরনের দূষণ রোধে জোরালো অভিযান চালানো জরুরি হয়ে পড়েছে।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।