অপ্রতুল অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা, আর কত প্রাণ গেলে টনক নড়বে?


নজরুল কবির দীপু : দেশে একের পর এক ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনা যেন সামগ্রিক গাফিলতির উদাহরণ। বছরের পর বছর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি, বছরের পর বছর গণমাধ্যমের তাগিদ। কিন্তু টনক কি আদৌ নড়েছে? আর কত প্রাণ গেলে টনক নড়বে সবার?

সবশেষ বেইলি রোডের গ্রিনকজি কটেজ ভবনে অগ্নিদুর্ঘটনা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে আবারও দেখিয়ে দিয়েছে কতটা অব্যবস্থাপনা ও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার মাঝে আমাদের বসবাস। জনগণের সচেতনতার অভাব তো রয়েছেই; পরিতাপের বিষয়, কর্তৃপক্ষও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। কোনো দুর্ঘটনার পর সরকারের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠনসহ নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও পরবর্তীকালে তা আর আলোর মুখ দেখে না।

আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, বন্দরনগরী চট্টগ্রামের অধিকাংশ এলাকায় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে নানা বাহারি খাবারের দোকান। কোথাও কোথাও তো পুরো ভবনজুড়েই স্থান করে নিয়েছে একাধিক রেস্তোরাঁ। ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে, ভবন তো বটেই, অধিকাংশ রেস্তোরাঁতেই নেই যথাযথ অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা। শুধু অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা কেন, ভোক্তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে কমার্শিয়াল স্পেসের যেসব নিয়ম পালনের কথা রয়েছে, অধিকাংশ ভবন মালিক জেনেবুঝেই তা মানেন না।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী, ভবন নির্মাণের আগে তাদের কাছ থেকে অনাপত্তিপত্র নিয়েছে চট্টগ্রামের শতকরা মাত্র সাত জন ভবন মালিক। আবার অনাপত্তিপত্রের সব শর্ত পূরণ করে চূড়ান্ত ছাড়পত্র নিয়ে নির্মিত হয়েছে মাত্র তিন ভাগ ভবন। কয়েক বছর আগে চকভিউ সুপার মার্কেট, কেয়ারি শপিংমল, গুলজার মার্কেট, রিয়াজউদ্দিন বাজার, জহুর হকার মার্কেট, টেরিবাজার, তামাকমুন্ডি লেইন, কর্ণফুলী মার্কেটসহ চট্টগ্রামের ৪৩টি বাজার, মার্কেট-বিপণিবিতানকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছিল ফায়ার সার্ভিস। তবে এসব ভবন ও মার্কেটের কোনো পরিবর্তন আসেনি বলে নগর পরিকল্পনাবিদরা জানিয়েছেন।

দিনের পর দিন কর্তৃপক্ষের চোখের সামনেই এসব ভবনে অবৈধভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে নানা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। রেস্তোরাঁগুলোয় যত্রতত্র রাখা থাকে যাচাই-বাছাইহীন গ্যাস সিলিন্ডার। আবাসিক ভবনে অবৈধভাবে কেমিক্যাল মজুদ করে রাখাও বন্ধ হয়নি। নিয়ম না মানার প্রতিযোগিতায় রাজধানী এখন রীতিমতো অগ্নিকুণ্ডের ওপর বসে আছে। অভিযোগ আছে, যাদের এসব দেখার কথা, তারাই জনবলের অভাবের নামে উৎকোচের বিনিময়ে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছে।

আবার আইনের কিছু দুর্বলতাও বিদ্যমান। বলা হচ্ছে, আইনের ফাঁকফোকরের সুযোগ নিয়ে অনিয়মে বেড়ে ওঠা অসংখ্য ভবন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। কোনো বাসযোগ্য শহরে এমনটা চলতে পারে না। আমরা মনে করি, আইনের যথাযথ প্রয়োগ হলে অগ্নিদুর্ঘটনায় এত প্রাণহানি হতো না। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে ভবনগুলোর অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা এতটা দুর্বল হতো না। ফায়ার সার্ভিস বিভাগেরও দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।

সিডিএ, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম দূরীকরণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যেসব ভবনে বিল্ডিং কোড মানা হচ্ছে না, সেসব ভবন মালিককে জরিমানাসহ তাদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এর আওতায় থাকবে যারা নিয়ম না মেনে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন, তারাও। পাশাপাশি গ্যাসের সিলিন্ডার যারা তৈরি ও ব্যবসা করছেন, তাদের ওপরও সরকারি তদারকি সংস্থাগুলোর কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিকদেরও উচিত ভবন ভাড়া নেওয়ার আগে প্রশস্ত চলাচলের পথ, ফায়ার এক্সিট ও অগ্নিনির্বাপণসহ যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে কিনা, সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে নেওয়া।

এছাড়া অগ্নিনিরাপত্তায় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো অগ্নিকাণ্ডের সময় যাতে মানুষ বেরিয়ে যেতে পারে, তার জন্য যথাযথ বহির্গমন পথের ব্যবস্থা রাখা। কিন্তু বাংলাদেশে কোনো বহুতল ভবনে বিশেষ বহির্গমন পথ নেই। স্বাভাবিকভাবেই অগ্নিকাণ্ডের সময় লিফট বন্ধ থাকে। ছাদ থেকে লাফ দিলেই কেউ বেঁচে যায়। এ বিষয়টি ধরে নির্মাণাধীন ভবনের বহির্গমন পথ তৈরির প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করলে বেশির ভাগ মানুষকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা সম্ভব।

স্বয়ংক্রিয় মই ছাদে থাকলেও এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে চলে যেতে পারবে। অগ্নিনিরাপত্তার জন্য বহির্গমন পথ অগ্নিনির্বাপণের চেয়ে বেশি প্রয়োজনীয়, কারণ অগ্নিনির্বাপণ সময়সাপেক্ষ। অগ্নিনির্বাপণের আগেই বহির্গমন পথ দিয়ে উদ্ধার কার্যক্রম শেষ করা সম্ভব। তা ছাড়া প্রচণ্ড ধোঁয়ার কারণে মানুষ খেই হারিয়ে ফেলে; নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। কিন্তু এসব প্রক্রিয়া কম ব্যয়বহুল হওয়া সত্ত্বেও আমাদের দেশে উদ্যোগ গ্রহণের ইচ্ছা অনেক মালিকের নেই।

বহুতল ভবনে ফায়ার স্প্রিংকলার, স্মোক ডিটেক্টর এবং হিট ডিটেক্টরের মতো প্রযুক্তি রাখতে হবে। ভবনে দৈনন্দিন কাজের মধ্যেই সতর্কতামূলক কিছু কাজ করতে হবে। যেমন– দাহ্য পদার্থ থাকলে তা সঠিক জায়গায় রাখা হয়েছে কিনা এটা লক্ষ্য করতে হবে। বৈদ্যুতিক সার্কিটে কোনো অসুবিধা পরিলক্ষিত হলে সঙ্গে সঙ্গেই পরিবর্তন করে ফেলতে হবে। প্রতিটি বৈদ্যুতিক সংযোগ জিএফসিআই নিয়ন্ত্রিত রাখলে আগুন লাগার ঘটনা ঘটবে না। অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রগুলো ঠিক আছে কিনা, তা কিছুদিন পরপরই যাচাই করে দেখতে হবে।

গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর বেইলি রোডের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত ১১ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাদের কারও কারও জীবন শঙ্কামুক্ত নয়। আমরা এই ধরনের ট্র্যাজেডি আর দেখতে চাই না। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর যেসব ব্যর্থতায় এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর সুষ্ঠু তদন্তের পাশাপাশি দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার। নইলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে। আইনগত ত্রুটি সংশোধনের পাশাপাশি বিল্ডিং কোড, অগ্নিপ্রতিরোধ আইন, ইমারত নির্মাণ বিধিমালার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিতে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, এটাই প্রত্যাশা।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।