নজরুল কবির দীপু : ব্যবহারকারীর অজান্তে ফেসবুকসহ বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যম নিয়ন্ত্রণে নিয়ে প্রতারণার ঘটনা ঘটছেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে লোভনীয় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঋণ দেওয়ার ফাঁদে ফেলার মাধ্যমে প্রতারণা। আবার দামি রেস্তোরাঁয় খাবারের ভুয়া ফরমাশ দেওয়াসহ নানা কায়দায় মানুষের কাছ থেকে অর্থ বের করে নেওয়া হচ্ছে।
মামলা বিশ্লেষণ করে নতুন ধরনের যেসব অপরাধের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে, কিছু বিদেশি নাগরিক ঋণের ফাঁদে ফেলে অনেক ব্যক্তির কাছ থেকে বড় অঙ্কের টাকা নিয়ে নিচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে তারা ফেসবুকসহ অনলাইনের বিভিন্ন মাধ্যমে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। ওই ঋণ পেতে হলে তাঁদের নির্দিষ্ট অ্যাপ নামাতে হচ্ছে। একবার এই অ্যাপ নামালেই বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে।
অ্যাপ দিয়ে ওই ব্যক্তির সব ধরনের ব্যক্তিগত তথ্য (পাসওয়ার্ড, ছবি-ভিডিও ইত্যাদি) হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারক চক্র। এরপর তাদের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা ঋণ নিলেও সুদসমেত ৫০ হাজার টাকা দাবি করার ঘটনাও ঘটছে। আর টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে ওই সব ব্যক্তিগত তথ্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
অনলাইনে প্রতারণার আরেকটি নতুন ঘটনা সামনে এসেছে, ফ্রিল্যান্সিংয়ের নামে ঘরে বসে মোটা অঙ্কের টাকা আয়ের লোভ দেখিয়ে সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র তরুণ-তরুণীদের অর্থকড়ি হাতিয়ে নিচ্ছে। জানা গেছে, এসব চক্র ফেসবুক, ইউটিউবসহ সামাজিকমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে অর্থ আয়ের লোভনীয় অফার দেয়। এসব বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে যোগাযোগ করেন তরুণ-তরুণীরা। এরপর প্রতারক চক্র প্রথমে তাদের কাজের বিনিময়ে কিছু অর্থ পেমেন্টও করে।
একপর্যায়ে বিশ্বস্ততা অর্জন করে তারা তরুণ-তরুণীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এর পাশাপাশি অনলাইন জুয়ার মতো অপরাধ তো আছেই। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, টোপে পড়ে সর্বস্ব হারালেও লোকলজ্জা এবং বাড়তি ঝামেলার ভয়ে তাদের অনেকেই আইনি প্রতিকার চাইতে যান না। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে, প্রতারণার ক্ষত পোষাতে কেউ কেউ অন্যায় পথে পা বাড়াচ্ছেন। তাদের মধ্যে সাধারণ মানুষ তো আছেনই, প্রতারণার শিকার হয়ে খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলার একটি বৌদ্ধবিহারের প্রধান পুরোহিত ইয়াবা পাচারের মতো ঘৃণ্য অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছেন, এমনটিও অন্য এক খবরে প্রকাশ পেয়েছে।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সবার হাতে হাতে স্মার্টফোন। সে তুলনায় সাইবার জগৎ সম্পর্কে সুরক্ষা-সচেতনতা তৈরি হয়নি সেভাবে। আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, সাইবার স্পেসে অপরাধ দিন দিন বেড়েই চলেছে। ভুক্তভোগীরা অভিযোগ না করায় পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রতারকের সংখ্যা।
এটা সত্য, বর্তমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অগ্রগতির ধারায় বাংলাদেশও চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে প্রবেশ করেছে, যার মূলমন্ত্র প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধন। তবে প্রযুক্তির এই জ্ঞান ব্যবহার করে ওৎ পেতে থাকা অনলাইনভিত্তিক নানা অপরাধ চক্র প্রতারণার ফাঁদ বুনছে। এ ধরনের প্রতারকদের খপ্পর থেকে বাঁচতে তরুণসমাজকে সচেতনতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি কর্তৃপক্ষকে আইনি সহায়তার পথ আরও সুগম করতে হবে।
আমরা জানি, দেশে যত সাইবার অপরাধ হয়, তার সব অভিযোগ পুলিশের কাছে আসেও না। বিচিত্র ধরনের সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। সামাজিক হেনস্তার ভয়ে অনেক ভুক্তভোগীই অভিযোগ দায়ের না করে চেপে যান। এতে সাইবার অপরাধীরা আরও অপরাধের সুযোগ পায়।
এই পরিস্থিতিতে প্রতারিতরা অভিযোগ জানাতে এসে যেন অহেতুক হয়রানির শিকার না হন, তা নিশ্চিত করতে হবে। দেশে সাইবার নিরাপত্তার জন্য কাজ করা সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো ‘ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মরিয়া গেল’ নীতিতে নয়, বরং উল্টো নীতিতেই হাঁটবে, এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক।