রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

বাঁশখালীতে ফসলি জমিতে তিন ইটভাটা, দূষিত হচ্ছে পরিবেশ

প্রকাশিতঃ ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ | ১:৩৫ অপরাহ্ন


এম. বেলাল উদ্দিন, বাঁশখালী (চট্টগ্রাম): চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া ফসলি জমিতে গড়ে উঠেছে ইটভাটা। উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের ইলশা গ্রামে তিনটি ইটভাটা গড়ে উঠেছে। লোকালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছাকাছি নির্মিত ইলশা গ্রামের ভাটায় ইট পোড়ানো চলছে পুরোদমে।

বাহারছড়া ইউনিয়নের ইলশা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সোলেহার বাপের পুল থেকে বাহারছড়া সমুদ্র সৈকত সড়কের এলজিইডির পাকা সড়কের আনুমানিক ৩০ গজের মধ্যে প্রায় ২৫ থেকে ২৬ বিঘা আয়তনের আবাদি জমি নষ্ট করে ইটভাটা নির্মাণ করা হয়েছে। লোকালয় থেকে ভাটার দূরত্ব খুব কাছাকাছি। ফসলি জমির মাঝখানে গড়ে উঠেছে আল্ মদিনা, চৌধুরী ব্রিকস-১ ও চৌধুরী ব্রিকস-২ নামে ৩টি অবৈধ ইট ভাটা। এই ইট ভাটা গুলোতে প্রতিনিয়ত পোড়ানো হচ্ছে পাহাড়ি কাঠ ও ফসলি জমির মাটি। কয়লার পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে কাঠ। তাছাড়া এই ইটভাটা গুলোতে অত্যাধুনিক পরিবেশ সম্মত কয়লা ও চিমনী ব্যবহারের নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। যার দরুন ইটভাটায় পোড়ানো ধোয়ার কারণে এলাকায় দেখা দিয়েছে বিভিন্ন রোগব্যাধির প্রাদুর্ভাব। আমের মুকুল ঝরে পড়ছে।

ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১৩-তে স্পষ্টভাবে বলা আছে, ইটভাটায় ফসলি জমির উপরের মাটি ব্যবহার করলে তার শাস্তি দু’বছর কারাদণ্ড ও ২ লাখ টাকা জরিমানা। ওই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে শাস্তি ২-১০ বছরের জেল এবং ২-১০ লাখ টাকা জরিমানা। অনুমোদন না নিয়ে ইটভাটা স্থাপন করলে শাস্তি ১ বছরের কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা। আইনে আরও বলা আছে, আবাসিক, জনবসতি, সংরক্ষিত এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা, বনভূমি, জলাভূমি এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার এলাকায় ইটভাটা স্থাপন করলে একই শাস্তি প্রযোজ্য হবে।

জানা যায়, উপজেলার ১৪টি ইটভাটার মধ্যে ১২টিই অবৈধ। লবণের মাঠ, ফসলি জমি, জনবসতি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে বেশিরভাগ ইটভাটা। এগুলো হচ্ছে চৌধুরী ব্রিকস, চৌধুরী ব্রিকস ২, জামান ব্রিকস, ঝন্টু ব্রিকস, রত্নপুর ব্রিকস। চৌধুরী ব্রিকস, চৌধুরী ব্রিকস-২ ও আল মদিনা ব্রিকস নামের ইটভাটাগুলোর চারপাশে কৃষি জমি। জলকদর খালের মাঝখানে খাল ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে গাজী ব্রিকস নামের আরও একটি ইটভাটা। ভাটার চুল্লি জ্বালানো হলে আশপাশের মাটি গরম হয়ে যায়। চিমনি দিয়ে ধোঁয়ার সঙ্গে ছাই বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে। এ অবস্থায় ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে ফসলসহ নানা জাতের ফলের।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বাঁশখালী ১ নম্বর পুকুরিয়া ইউনিয়নের চা-বাগান সংলগ্ন পাহাড়ি এলাকায় সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে গড়ে তোলা হয়েছে লম্বা চিমনির মেসার্স চৌধুরী ব্রিক নামের ইটভাটা। এছাড়া বাহারছড়ার ইলশায় গড়ে তোলা হয়েছে নতুন আরো তিনটি ইট ভাটা। যা সম্পূর্ণ পরিবেশ সম্মত নয়।

জনসম্মুখে রাস্তার পাশেই কৃষি জমিতে দিন দুপুরে বনের কাঠ ব্যবহার করে চালানো হচ্ছে এই ইটভাটা। একে একে ২ কিলোমিটারের ব্যবধানে গড়ে উঠেছে ৪টি ইট ভাটা। তাছাড়া সাধনপুর ইউনিয়নের লটমনি পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে তোলা হয়েছে ৩টি ইটভাটা। চাম্বল-বড়ঘোনা সড়কের পাশেই মুন্সী খীল এলাকায় লোকালয়ে কৃষি জামিতে ১টি, শেখেরখীল-ছনুয়া সড়কে ১টি, বাঁশখালী পৌরসভার দক্ষিণ জলদী পাহাড়ের পাদদেশে রয়েছে একটি ইটভাটা। তবে বর্তমানে সেটি মামলা সংক্রান্ত জটিলতায় বন্ধ রয়েছে। অন্যদিকে বাঁশখালী-সাতকানিয়া সীমান্তের চূড়ামণি এলাকায় ৪ টি ইটভাটা রয়েছে।

জানা যায়, একবার ইট পোড়াতে প্রায় চার হাজার মণ কাঠ পোড়াতে হয়। এসব কাঠ জোগাড় হচ্ছে আশপাশের সংরক্ষিত বন থেকেই। ফলে উজাড় হয়ে যাচ্ছে বনাঞ্চল। এতে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বাড়ছে। পরিবেশ হুমকির মুখে পড়ছে। প্রশাসনের নাকের ডগায় এমন ইটভাটা গুলো গড়ে উঠলেও তা নিয়ে কারও যেন কোনো মাথাব্যথা নেই।

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলার রিসার্চ অফিসার আশরাফ উদ্দিন বলেন, ইটভাটাগুলোকে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি। কোনোটির বিরুদ্ধে মামলা আছে, আবার কোনোটির বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিটও হয়েছে। আমরা শিগগিরই সেখানে অভিযানে যাব।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরিবেশ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ভাটার অবস্থান হতে হবে লোকালয় ও এলজিইডির পাকা সড়ক থেকে ন্যূনতম আধা কিলোমিটার দূরে। প্রস্তাবিত জায়গাটি আবাদি কি না সে ব্যাপারে কৃষি বিভাগের প্রত্যয়নপত্র, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং প্রশাসনের অনাপত্তি, ট্রেড লাইসেন্স, আনুষঙ্গিক কাগজপত্রসহ আবেদনপত্র হাতে পেলে সরেজমিনে তদন্ত করে স্বপ্নপূরণ সাপেক্ষে পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদানের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। কৃষি বিভাগ থেকে অনাবাদি জমির প্রত্যয়ন না দিলে পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদানের প্রশ্নই আসে না।

ইলশা এলাকার কৃষক ছৈয়দ নুর বলেন, ‘ইটভাটার মালিকরা সব ফসলি জমি চড়া দাম দিয়ে নিয়ে ফেলার ফলে এখন এখানে ধানিজমি নেই বললেই চলে। আগে যেখানে দুই-তিনবার ধান হতো সেখানে বর্ষা মৌসুম ছাড়া আর ধান উৎপাদন করা যাচ্ছে না।’

লবণ মাঠ, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা ও বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের কাছে গড়ে ওঠা মেসার্স চৌধুরী ব্রিকসের অনুমোদন পরিবেশ অধিদপ্তর দিয়েছে বলে দাবি করেন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মহিউদ্দিন চৌধুরী। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘এলাকাবাসীর মধ্যে অসন্তোষ থাকলেও পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসন অনুমোদন দিয়েছে কেন?’

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবু সালেক বলেন, ‘ইটভাটাগুলো কৃষি বিভাগ থেকে অনাবাদি জমির প্রত্যয়ন নিয়েছে কিনা জানা নেই। এসব ভাটার কার্যক্রম অনেক আগে থেকে চলে আসছে। ইটভাটার ধোঁয়ার ফলে যেকোনো ফলগাছে মুকুল নষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া ফসলি জমির উর্বর মাটি টপ সয়েল নিয়ে ফেলায় ফসল উৎপাদনে ঘাটতি হয়।’

এ বিষয়ে বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেসমিন আক্তার একুশে পত্রিকাকে বলেন, আমি এতদিন এ বিষয়ে অবগত ছিলাম না। আপনার কাছ থেকে প্রথম শুনলাম। এছাড়া ইটভাটাগুলো নিয়ে কেউ অভিযোগও দেয়নি। এ বিষয়ে আমি পরিবেশ অধিদপ্তরের সাথে কথা বলে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।