শরীফুল রুকন : দিনবদলের স্বপ্ন নিয়ে গত ২ এপ্রিল সৌদি আরবে গিয়েছিলেন খালেক মিয়া (৩০)। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পরই বুঝতে পারেন তিনি প্রতারিত হয়েছেন। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ পাননি।
বিষয়টি পরিবারকে জানান খালেক। এরপর গত ২৪ মে এই বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেন খালেকের ছোট ভাই হাফিজুর রহমান।
অভিযোগটি করা হয় মূলত খালেককে বিদেশে নিয়ে যাওয়া রিক্রুটিং এজেন্সি বিজিএল ওভারসীজ লিমিটেডের বিরুদ্ধে। অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়ে গত ৮ জুন বিজিএল ওভারসীজ লিমিটেডের লাইসেন্স স্থগিত করে মন্ত্রণালয়।
এরপর গত ১৫ জুন মন্ত্রণালয়ে ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে লিখিত দিয়ে বিজিএল ওভারসীজ জানায়, ২৫ জুনের মধ্যে সৌদিতে খালেক মিয়ার কাজের ব্যবস্থা করবে তারা। আর এতে ব্যর্থ হলে তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। কিন্তু কাজ দিতে তারা ব্যর্থ হন।
এরপর গত ২১ জুলাই সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরেন খালেক মিয়া। তার চারদিনের মাথায় ২৫ জুলাই জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) অফিসে খালেককে ক্ষতিপূরণের ৩ লাখ টাকা বুঝিয়ে দেন বিজিএল ওভারসীজের প্রতিনিধিরা।
মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ দেওয়ার দুই মাস পর ক্ষতিপূরণের টাকা হাতে পেয়ে আনন্দিত খালেক মিয়া। তিনি বলেন, “ঋণ নিয়ে আমি বিদেশে গিয়েছিলাম। ক্ষতিপূরণ না পেলে আত্মহত্যা করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।”
বিএমইটির উপপরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, “অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সি উভয়পক্ষ ক্ষতিপূরণ দেওয়া-নেওয়া করেছেন। এভাবে অভিযোগটি নিষ্পত্তি করা হয়।”
খালেক মিয়া অভিযোগ করে প্রতিকার বা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। কিন্তু প্রতারিত হলেও মন্ত্রণালয় অথবা বিএমইটিতে লিখিত অভিযোগ করছেন না অনেক প্রবাসী।
যদিও অনেক সৌদি প্রবাসী বিদেশে গিয়ে কাজ পাচ্ছেন না। একপর্যায়ে তাদেরকে অবৈধ হয়ে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। অথচ সাড়ে ৩ লাখ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা খরচ করে তারা সৌদিতে গিয়েছেন। তাদের প্রলোভন দেখানো হয়, সরাসরি কোম্পানিতে চাকরি দেওয়ার। কাউকে সেলসম্যান, সুপারশপের চাকরি বা ডেলিভারি ম্যান পদে কাজ দেওয়ার।
অথচ যাওয়ার পর অনেকে কাজ খুঁজে পাওয়া দূরে থাক, কোম্পানিও খুঁজে পাননি। একপর্যায়ে অবৈধ হয়ে যাচ্ছেন। এরপর কেউ নিয়তির দোষ দিচ্ছেন, কেউ সরকারের দোষ দিচ্ছেন, কেউ আবার দালালকে দায়ী করছেন। কিন্তু যথাযথ জায়গায় লিখিত অভিযোগ অনেকেই দিচ্ছেন না প্রতারণার শিকার হওয়া অনেকেই।
সরকারি হিসাবে চলতি বছরের ১১ মাসে সৌদি আরবে গেছেন চার লাখ ৫১ হাজার ৫০২ জন কর্মী। আর গত নভেম্বরে অভিবাসন গবেষণা সংস্থা রামরুর প্রকাশ করা এক প্রতিবেদন বলেছে, প্রতি মাসে যত কর্মী সৌদি আরব যান তার ১৪ শতাংশই ওই মাসে ফেরত চলে আসেন। এ ছাড়া সৌদি আরব যাওয়া কর্মীদের মধ্যে যাওয়ার প্রথম তিন মাসে ফেরত আসেন ১৩ শতাংশ, ছয় মাসের মধ্যে ২৪ শতাংশ এবং এক বছরের মধ্যে ৪৯ শতাংশ কর্মী ফেরত আসেন।
ফেরত আসার কারণ হিসেবে রামরু বলছে, চুক্তি অনুযায়ী কাজ না পাওয়া, একদম কাজ না পাওয়া, ইকামা বাতিল হয়ে যাওয়া, ঠিকমতো বেতন না পাওয়া, মালিকের নির্যাতন, গ্রেপ্তার হওয়া, কম বেতন ও শারীরিক অসুস্থতা।
রামরুর গবেষণার সঙ্গে মিল পাওয়া যায় চট্টগ্রামের বাঁশখালীর বাসিন্দা আলাউদ্দিনের অভিজ্ঞতার। গত জানুয়ারিতে আলাউদ্দিন সৌদি আরব যান। তিনি বলেন, “সাড়ে ৪ লাখ টাকা খরচ করে সৌদি গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি ইকামা নেই, মালিক নেই, থাকার রুম নেই, কাজ নেই। তিন মাস থেকে এপ্রিলে দেশে চলে আসি।”
প্রতারণার বিষয়ে কোথাও অভিযোগ করেছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “দেশের বিচার ব্যবস্থা ঠিক নাই। দূতাবাসে অভিযোগ করেও অনেকে প্রতিকার পাননি। সৌদির অলিতে গলিতে দালাল আর দালাল। অন্য সব দেশের মানুষ সরাসরি কোম্পানির চাকরিতে ঢুকে। খরচ পড়ে মাত্র ৫০ হাজার। আর আমাদের দেশের লোকদের ৪-৫ লাখ টাকায় এনে সাপ্লাই কোম্পানিতে দেয় দালালরা। সেখানে না টাকা দেয়, না ইকামা। পরে তারা অবৈধ হতে বাধ্য হয়। এরকম ঘটনা তো হাজার হাজার না, লাখ লাখ। এগুলোর তো বিচার হতে দেখি না।”
আলাউদ্দিনকে জানানো হয়, মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করার কারণেই, খালেক মিয়া নামের এক ব্যক্তি গত ২৫ জুলাই ৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। তখন তিনি বলেন, “খালেক মিয়ার ঘটনা নিয়ে নিউজ হয়েছিল। তাই হয়তো তাড়াতাড়ি ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। প্রবাসীদের বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে দেখি, অনেকে অভিযোগ করেও প্রতিকার পাচ্ছেন না।”
তবে এই অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন বলেন, “একটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আমার কাছে আসে না। কেন আসে না, এটার অজুহাত দেবেন না। অভিযোগ দিন। এরপর আমার কাছে জিজ্ঞেস করুন, আপনি কী করেছেন।”
তিনি আরও বলেন, “বিভিন্ন অভিযোগে বিভিন্ন সময়ে ২৪৭টি লাইসেন্স সানপেন্ড করেছে মন্ত্রণালয়। কর্মীরা অভিযোগ করলে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া মেনে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। এটা আমাদের চলমান প্রক্রিয়া। ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের বিন্দুমাত্র শৈথিল্য নেই।”
একই কথা বলেছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমেদ; তিনি বলেন, “শোনা কথার (অভিযোগ) উপর নির্ভর করে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি না। যখন লিখিত অভিযোগ আসে, তখন আমরা অ্যাকশনে যেতে পারি। লিখিত অভিযোগ-প্রমাণ ছাড়া কিছু করা যায় না।”
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিদেশে গিয়ে প্রতারিত হওয়া ব্যক্তিদের পাশাপাশি তাদের পরিবারের সদস্যরাও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী, প্রবাসী কল্যাণ সচিব ও বিএমইটির মহাপরিচালক বরাবর অভিযোগ করতে পারেন।
এক্ষেত্রে নাম, পাসপোর্ট নাম্বার, ঠিকানা, কোন রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কবে, কোন দেশে গিয়েছেন, কোন কোম্পানিতে পাঠানোর কথা বলা হয়েছিল, কী কাজ দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল, কাজ দিয়েছে কিনা, আকামা বা ওয়ার্ক পারমিট হয়েছে কিনা, যোগাযোগের ফোন নাম্বার, এসব বিস্তারিত তথ্য লিখে অভিযোগ করতে হবে।
জনশক্তি রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) মহাসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, “দালালদের খপ্পরে পড়ে অনেকে বিদেশে গিয়ে কাজ পান না। অনেক সময় পাচারেরও শিকার হন। এছাড়া অনেকই দালালের খপ্পরে পড়ে ফ্রি ভিসার নামে বাইরে যান। আসলে ফ্রি ভিসা বলতে কোনো ভিসা নেই। আর দালালদের খপ্পরে পড়ে এ ধরনের ভিসায় গেলে আমাদের কিছুই করার থাকে না।”
তিনি আরও বলেন, “যদি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কেউ হয়রানি ও প্রতারণার শিকার হয়ে থাকেন, তাহলে অবশ্যই অভিযোগ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়।”
## লোভের শিকার প্রবাসীরা
## ‘মালয়েশিয়ায় অনেক কষ্টে আছি, ভাষায় প্রকাশ করার মতো না’
শেষ