লোভের শিকার প্রবাসীরা


শরীফুল রুকন : “৫ লাখ টাকা দিয়ে আমি সৌদি আরবে এসেছি। আসার তিনদিন পরে খুরুজ (সৌদি থেকে চলে যাওয়ার ভিসা) লাগিয়ে রেখেছে। তারপর বলে খুরুজ উঠাতে হলে ৬ হাজার রিয়াল লাগবে। বাধ্য হয়ে সেটাও দিয়েছি। এখনও খুরুজ তুলে নেয়নি। যে আমাকে এখানে এনেছে, তাকে ফোন করলে রিসিভ করে না।,” একুশে পত্রিকাকে বলছিলেন বর্তমানে সৌদি আরবে অবস্থান করা এক যুবক (অনুরোধের কারণে তাঁর নাম প্রকাশ করা হলো না), যিনি সুপারশপের সেলসম্যান হিসেবে গত ২৫ নভেম্বর দেশটিতে কাজ করতে গিয়েছিলেন।

“কাজ নেই। বাড়ি থেকে টাকা এনে খাচ্ছি। আমার মতো হাজার হাজার মানুষ আছে, যাদের ইকামা (কাজ করার অনুমতিপত্র) নেই, কাজ নেই। আবার কাজ করলেও বেতন নেই। এসব কারণে প্রতিদিন মক্কার মিসফালা ব্রিজের নিচে বাংলাদেশিরা বসে থাকে, যাতে পুলিশ তাদেরকে ধরে দেশে পাঠিয়ে দেয়। নিজের চোখে না দেখলে, এমন দুর্দশা অনুধাবন করা যাবে না।” বলছিলেন ওই যুবক।

সৌদি আরবে অবস্থান করা সাতকানিয়ার বাসিন্দা মাহবুব রহমান বলেন, “সৌদি আরবের বেকার নাগরিকরা ভিসার ব্যবসা করে। কোনো কাজ না থাকলেও ভিসা বের করে বিক্রি করে তারা। আবার অনেক সময় প্রবাসীদের দিয়ে কাজ করানোর পরও সৌদিরা টাকা দেয় না। কারণ তারা জানে, অবৈধ হওয়ার কারণে আমি কারও কাছে গিয়ে অভিযোগও করতে পারবো না। অবৈধ হওয়ায় আমি এই বছর চার মাসের বেতন পাইনি।”

তিনি জানান, সৌদি আরবের কিছু অসাধু নাগরিক ও বাংলাদেশি কিছু রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকের যোগসাজসে ভিসা নিয়ে প্রতারণা চলছে। ভিসা দিলেও কাজ দিচ্ছে না। ভিসা কিনে এসে সৌদি নাগরিক ও বাংলাদেশি দালালদের হাতে জিম্মি হয়ে যাচ্ছেন অনেকেই। সৌদিরা নতুন করে ইকামা করে না দেওয়ায় অনেকে অবৈধ হয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে সাপ্লাইয়ারের মাধ্যমে কাজ করা অনেকে ঠিকমতো বেতন পান না। অনেক সাপ্লাইয়ার বেতনের পুরো টাকা মেরে দেন। যার কারণে বাংলাদেশিরা দেশে ফিরে যেতে বাধ্য হন।

৭ বছরের বেশি সময় ধরে সৌদি প্রবাসী মাসুমুর রহমান বলেন, “ইকামা নবায়নের জন্য প্রতি বছর প্রায় ১২ হাজার রিয়াল লাগে। এই টাকা নিয়োগদাতা দেয় না, দিতে হয় আমাদের মতো প্রবাসীদেরকে, যারা ফ্রি ভিসার নামে কাজ করেন বা সাপ্লাইয়ারের অধীনে কাজ করেন। ইকামা নবায়ন বা বাতিলের সব ক্ষমতা সৌদির জনগণের কাছে দিয়ে রেখেছে দেশটির সরকার। তারা চাইলেই এটা যেকোনো সময় বাতিল করতে পারে।”

“এই সুযোগে সৌদিরা কাজ তো দেবেই না, উল্টো মাসে ৫০০ থেকে ৭০০ রিয়াল নিয়ে ফেলছে। না দিলে ইকামা বাতিল করে দিচ্ছে। এভাবে মাসে দেড় হাজার রিয়াল ইকামা ও কাফালার (নিয়োগদাতার মাসোহারা) পেছনে চলে যাচ্ছে। অনেকে এই টাকাটাও আয় করতে পারেন না, থাকা-খাওয়ার টাকা জোগাড় দূরে থাক।“ বলেন মাসুমুর রহমান।

সৌদি আরবের নতুন আইন অনুযায়ী, দেশটির কর্তৃপক্ষ নতুন অভিবাসীদের মাত্র তিন মাসের ইকামা দিচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে যদি কোনো প্রবাসী কাজের সন্ধান করে অন্য কোনো কোম্পানির নামে নিজের ভিসা ট্রান্সফার করতে না পারেন তাহলে পরে রেসিডেন্ট পারমিট নবায়ন করার জন্য বড় অঙ্কের ফি গুনতে হয়। এতে অবৈধ হয়ে যাওয়া ছাড়া কর্মীদের আর কোনো উপায় থাকে না। তখন বাধ্য হয়ে তাঁকে ফেরত আসতে হয়।

এসব কারণে সৌদি আরব থেকে বিপুল সংখ্যায় বাংলাদেশি শ্রমিক দেশে ফিরে আসছেন। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য বলছে, এ বছরের ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত শূন্য হাতে দেশে ফিরে এসেছেন ৮০ হাজার ৮১১ জন প্রবাসী। এর মধ্যে পুরুষ কর্মী ৭৮ হাজার ৭৯ জন ও নারী কর্মী ২ হাজার ৭৩২ জন। তবে এটি আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

সরকারি তথ্য বলছে, গত অক্টোবরে দেশে ফিরেছেন ৬ হাজার ৪৯৩ জন। আর নভেম্বরে দেশে ফিরেছেন ৮ হাজার ৪৫২ জন। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

১৫ জন প্রবাসী কর্মী, সরকারি কর্মকর্তা এবং অভিবাসন বিশেষজ্ঞ – এরকম নানা পক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যাচ্ছে: সংঘবদ্ধ চক্রের লোভের শিকার হচ্ছেন প্রবাসী শ্রমিকরা। এই সংঘবদ্ধ চক্রের মধ্যে মূলত রয়েছেন সৌদি আরবের কিছু নাগরিক ও বাংলাদেশের কিছু অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকরা। এই চক্রটি তথাকথিত ‘ফ্রি ভিসার’ নামে প্রতারণায় যুক্ত রয়েছে। আর যাচাই না করেই এসব ভিসার বিষয়ে দূতাবাসের পক্ষ থেকে প্রত্যয়ন দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া সৌদি আরবের নতুন শ্রমনীতি এবং অর্থনীতির নতুন বাস্তবতাও প্রবাসী শ্রমিকদের দুর্দশায় ফেলেছে।

গত নভেম্বরে অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) এক প্রতিবেদন বলেছে, প্রতি মাসে যত কর্মী সৌদি আরব যান তার ১৪ শতাংশই ওই মাসে ফেরত চলে আসেন। এ ছাড়া সৌদি আরব যাওয়া কর্মীদের মধ্যে যাওয়ার প্রথম তিন মাসে ফেরত আসেন ১৩ শতাংশ, ছয় মাসের মধ্যে ২৪ শতাংশ এবং এক বছরের মধ্যে ৪৯ শতাংশ কর্মী ফেরত আসেন। যার প্রভাব পড়ছে প্রবাস আয়েও।

ফেরত আসার কারণ হিসেবে রামরু বলছে, চুক্তি অনুযায়ী কাজ না পাওয়া, একদম কাজ না পাওয়া, ইকামা বাতিল হয়ে যাওয়া, ঠিকমতো বেতন না পাওয়া, মালিকের নির্যাতন, গ্রেপ্তার হওয়া, কম বেতন ও শারীরিক অসুস্থতা।

অভিবাসীদের সংগঠন অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) চেয়ারপারসন শাকিরুল ইসলাম বলেন, “সৌদি আরবে ফ্রি ভিসা নাম দিয়ে কর্মী নিয়ে যাওয়া হয়। ফ্রি ভিসার মানে হচ্ছে, যারা কর্মী নিয়োগ করছে, তারা কোনো কাজ দেবে না। যখন কাজ করতে দেওয়া হবে না, তখন তাদের ওয়ার্ক পারমিট বা ইকামা হচ্ছে না। ফলে তারা আনডকুমেন্টেড অবস্থায় থাকেন। আনডকুমেন্টেড হওয়ায় তারা সেখানে বৈধভাবে থাকতে পারছেন না। অন্য জায়গায় কাজ করলে পুলিশ তাদেরকে ধরে ফেলছে।”

তিনি বলেন, “পাসপোর্ট ছাড়া শুধু আউট পাস নিয়ে এ বছর ফিরেছেন ৮০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি। আউট পাস নিয়ে যাঁরা ফেরেন, তাঁরা সর্বস্বান্ত হয়ে, আটক হয়ে ফেরেন। এর বাইরে অসুস্থ হয়ে, কাজ না পেয়ে, স্বেচ্ছায় অনেকে ফিরে আসেন। তাঁদের সংখ্যা কারও জানা নেই।”

‘ফ্রি ভিসার’ নামে প্রতারণা

“ফ্রি ভিসায় লোক পাঠানো হলেও কাগজে-কলমে কিন্তু তাদের চাকরি নিশ্চিত করা আছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ফ্রি ভিসা কোনো অফিসিয়াল ভিসা না। কাগজে কলমে ফ্রি ভিসা নামে কোনো শব্দ পাওয়া যাবে না।” -বলছিলেন ওকাপ চেয়ারপারসন শাকিরুল ইসলাম।

“ফ্রি ভিসার সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা, সৌদি আরবে অবস্থিত কোনো মালিকের কাছ থেকে ভিসাগুলো কেনেন। কেনার শর্তটাই থাকে এরকম, যাদেরকে পাঠানো হবে, তাদের কর্মসংস্থানের দায়িত্ব ওই মালিকের থাকবে না। যদিও ওই মালিকদেরকে টাকা দিয়েই কিন্তু ভিসাগুলো কেনা হচ্ছে।”

শাকিরুল বলেন, “ফ্রি ভিসার নামে প্রতারণা ঠেকাতে দুই জায়গায় কথা বলার সুযোগ আছে। প্রথমত যেসব রিক্রুটিং এজেন্সি ফ্রি ভিসার নামে লোক পাঠাচ্ছে, ৫-৬ লাখ টাকা নিয়ে, তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তারা যেন সেটা না করেন। একইভাবে সরকারিভাবে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন- আমরা সংখ্যায় অভিবাসী কর্মী বাড়াবো, নাকি আমরা গুণগতমান দিয়ে যে অভিবাসন হওয়া উচিত, এটা নিশ্চিত করবো?”

একইভাবে সৌদি আরবের কাছেও এসব তথ্য তুলে ধরা যায় মন্তব্য করে শাকিরুল বলেন, “সৌদি নাগরিকরা টাকার লোভে কথিত ফ্রি ভিসা বিক্রি করছে, যার ফলে আমাদের দেশের গরীব মানুষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তারা ৫-৬ লাখ টাকা দিয়ে গিয়েছেন। অনেকেই এই টাকা ঋণ নিয়েছেন। সেখানে গিয়ে কাজ পাচ্ছেন না। ফেরত আসলে ঋণের টাকা কীভাবে ফেরত দেবেন?”

“ফ্রি ভিসায় যাওয়া কেউ কেউ, ঘরবাড়ি বিক্রি করে আবার টাকা নিচ্ছেন, নতুন কোনো মালিকের অধীনে ইকামা করাতে। আবার অনেকে সেটা পারছেন না। তারা ফেরত আসছেন বা ধরে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। এভাবে যারা ফেরত আসছে, তাদের পরিবারের উপর অর্থনৈতিক চাপ তৈরি হচ্ছে, তারা একটা ঋণচক্রের মধ্যে পড়ে যাচ্ছেন।” বলেন ওকাপ চেয়ারপারসন শাকিরুল ইসলাম।

সৌদি প্রবাসী জহিরুল ইসলাম বলেন, “আমাদের দেশের কিছু অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সি ও কিছু সৌদি নাগরিক মিলে চক্র গড়ে উঠেছে। তাদের লোভের কারণে প্রবাসীরা প্রতারিত হচ্ছেন। প্রত্যেকটি শ্রমিকের বেতন ব্যাংকের মাধ্যমে দিতে নিয়ম করে দিয়েছে সৌদি সরকার। কিন্তু কেউ যদি মালিকের অধীনে কাজ না করেন, তাহলে তিনি বেতন পাবেন কীভাবে?”

“আমরা বাংলাদেশিরা অনেক সময় সৌদিদের বলি, আমাকে পাঁচটি ভিসা দাও, দশটি ভিসা দাও। আমি লোক আনবো। সৌদি নাগরিক থেকে যে ভিসা কিনতেছে সে জানে, এখানে কোনো কাজ নেই। তবুও সে প্রলোভন দেখিয়ে দেশের বেকার যুবকদের কাছে ভিসা বিক্রি করে, সৌদিতে আসার পর কাজ সংগ্রহ করে দেবে বলে। কিন্তু কাজ দিতে পারে না।”

তিনি বলেন, “আবার অনেক সময় যারা ভিসা নেয়, তারা সৌদি নাগরিককে বলে আমি যে পাঁচটা ভিসা নিচ্ছি, তারা আসার পর আমিই তাদের কাজের ব্যবস্থা করবো। আমিই কাজ দেবো। তোমাকে কাজের জন্য কোনো টেনশন করতে হবে না। আমি লোকগুলোকে তিন মাসের মধ্যে, ৬ মাসের মধ্যে রিলিজ করে নিয়ে যাবো। তোমাদের কোম্পানি থেকে ট্রান্সফার করে নিয়ে যাবো।”

বর্তমানে সৌদি আরবে কাজের খুব সংকট, বেতন অল্প উল্লেখ করে সৌদি প্রবাসী জহিরুল ইসলাম বলেন, “একজন প্রবাসী কর্মীকে প্রতি বছর ইকামার ফি দিতে হয় প্রায় ১২ হাজার রিয়াল। একটু ভালো করে থাকতে গেলে আনুসঙ্গিক খরচ, খাবার, থাকা, মোবাইল, নেট, সবমিলিয়ে জনপ্রতি মাসে দেড় হাজার রিয়াল খরচ হয়। একটা লোক যদি ৩ হাজার রিয়াল বেতনে চাকরি করতে পারে, তাহলে দেড় হাজার রিয়াল বাঁচাতে পারবে। অথচ দেখা যাচ্ছে, অনেক সময় ৩ হাজার রিয়ালে সৌদি নাগরিক পেয়ে যাচ্ছে। সৌদির শ্রমিক পর্যাপ্ত থাকলে বাংলাদেশিদের কাজে নেওয়া হয় না। নিলে নিয়োগকর্তার সার্বিক খরচ বেশি পড়ে যায়।”

ভিসা বিক্রি করতে রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকরাই খুলছেন ‘সাপ্লাইয়ার কোম্পানি’

১০ বছরের বেশি সময় ধরে সৌদি প্রবাসী মো. আলাউদ্দিন বলেন, “সৌদিতে আসা একটা বড় অংশ দেশে ফেরত যাচ্ছে। একটা কাজের কথা বলে এনে আরেকটা কাজ দেওয়া হচ্ছে। অনেক সময় কাজই দেওয়া হচ্ছে না।”

তিনি জানান, সৌদি সরকারের করা নিয়মের কারণে, বড় বড় কোম্পানিগুলো এখন সরাসরি ভিসা দেয় না বা নিয়োগ দেয় না। কারণ সরাসরি নিয়োগ দিলে শ্রমিককে প্রতিবছর ইনসেনটিভ দিতে হয়, মেয়াদ শেষে একটা অংকের টাকা দিয়ে কোম্পানিকে ফেরত পাঠাতে হয়।

যার কারণে কোম্পানিগুলো সাপ্লাইয়ারের কাছ থেকে শ্রমিক নিয়ে কাজ চালিয়ে নেয় বলে জানান সৌদি প্রবাসী মো. আলাউদ্দিন।

“এই সুযোগটা নিয়ে সৌদিতে অনেক শ্রমিক সাপ্লাইয়ার কোম্পানি গড়ে উঠেছে। যারা সৌদি সরকারের নিয়ম নীতি মেনে কাজটা করে। এর মধ্যে কিছু আছে আবার ভুঁইফোড় সাপ্লাইয়ার। বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সির কিছু মালিক নিজেরাই এখানে এসে নামে-বেনামে সাপ্লাইয়ারের ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে। যাতে তাদের ভিসা কেনা-বেচা সহজ হয়।”

রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর এই সাপ্লাইয়ার ব্যবসার কারণে বাংলাদেশ থেকে নতুন আসা কর্মীরা সমস্যার মধ্যে পড়েন জানিয়ে সৌদি প্রবাসী মো. আলাউদ্দিন বলেন, “নতুন আসা অনেকেই তার কাজটা কী, কোথায় আইনি সহযোগিতা পাবে, দূতাবাসের অবস্থান, এসব জানে না। দালাল তাকে সঠিক তথ্য জানতে দেয় না। ভুল বুঝিয়ে অন্য নিয়মকানুন বুঝিয়ে দেশে ফেরত পাঠায়। কারণ দালালরা যদি একজনকে ফেরত পাঠাতে পারে, তাহলে সে আরেকটা নতুন ভিসা পাবে, সেটা তারা বিক্রি করতে পারবে।”

যাচাই না করেই ভিসার প্রত্যয়ন দিচ্ছে দূতাবাস!

সৌদি প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৫ সালে দেশটিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পাওয়া গোলাম মসিহ, একটা নিয়ম চালু করেছিলেন। ওই নিয়মে ভিসা প্রদান করা কোম্পানি বা সৌদি নাগরিকের বিষয়ে যাচাই করবে দূতাবাস ও কনস্যুলেট। ঠিকমতো বেতন দেওয়ার সক্ষমতা আছে কিনা, কোম্পানির অবস্থা কী- এসব বিষয় তখন সরেজমিন যাচাই করা হতো ভিসার প্রত্যয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে। এই প্রত্যয়ন না পেলে সৌদিতে যাওয়ার বিষয়ে কর্মীদের ছাড় দেয় না জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)।

এই নিয়মটি এখনও চালু আছে। কিন্তু যাচাই ছাড়াই সেই প্রত্যয়ন দেওয়া হয় বলে অভিযোগ আছে। সৌদি আরবের রিয়াদে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেন, “যাচাই করে প্রত্যয়ন দিতে গেলে ফ্রি ভিসার নামে প্রতারণা অনেকটাই বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু বিভিন্ন মহল থেকে দোষ দেওয়া হয়, দূতাবাসের কড়াকড়ির কারণে ভিসাটা বাংলাদেশে যাচ্ছে না, শ্রমিক পাঠানো কমে যাচ্ছে। আবার এটাও ঠিক প্রতি বছর ৫ থেকে ৭ লাখ মানুষ সৌদি আরবে যাচ্ছে। এত বিপুল সংখ্যক মানুষের ভিসা সঠিকভাবে যাচাই করে প্রত্যয়ন দেওয়াও কঠিন, যেহেতু দূতাবাসে জনবল তুলনামূলক খুবই কম।”

অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে যদি জবাবদিহিতার আওতায় আনা না যায়, তাহলে কোনো লাভ হবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ওকাপ চেয়ারপারসন শাকিরুল ইসলাম বলেন, “সৌদি আরবের মতো এত বড় দেশে মাত্র দুটি কনস্যুলেট অফিস আছে, একটি রিয়াদে, আরেকটি জেদ্দায়। সেখানে জনবল খুবই কম। অথচ ২০২২ সালে সৌদিআরবে ৭ লাখ মানুষ গিয়েছেন। ৭ লাখ মানুষের ভিসা যদি ভেরিফাই করতে হয়, তাহলে ১০-২০ জন মানুষ দিয়ে কিন্তু এটা সম্ভব হয় না। যে কারণে ভেরিফাই না করে ভিসাগুলো প্রত্যয়ন করে দেওয়া হচ্ছে। সেই প্রত্যয়নের উপর ভিত্তি করেই বিএমইটি তাদেরকে পাঠাচ্ছে।”

তিনি আরও বলেন, “কনস্যুলেট অফিসে ভিসা ভেরিফাই, প্রত্যয়নের কাজের জন্য যথেষ্ট জনবল থাকা উচিত। এই পুরো প্রক্রিয়াটাকে স্বচ্ছ করতে হবে। রিক্রুটিং এজেন্সিকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।”

‘ফ্রি ভিসা’ বেঁচে দুই মাসে আয় কোটি টাকা!

সৌদি প্রবাসী জহিরুল ইসলাম বলেন, “ভালো মানুষ, খারাপ মানুষ সব জায়গায় আছে। তাদের লোভের শিকার হচ্ছেন আমাদের প্রবাসীরা।”

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “আমার নিজের দেখা, এক বাংলাদেশি একটি সাপ্লাই কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছিল। ৪-৫ বছর চাকরির পর দেখা গেল, সে আরবি ভাষা শিখে ফেলেছে। সৌদির আইনকানুন মোটামুটি অবগত। তখন সে নিজে একজন সাপ্লাইয়ার হয়ে যায়। তখন ১০০ ভিসা প্রসেসিং করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়। প্রতি ভিসায় বাংলাদেশি ১ লাখ টাকা করে লাভ করে। ১০০ ভিসায় তার এক কোটি টাকা লাভ। সময় কিন্তু অল্প। দুই মাস লাগে ১০০ ভিসা প্রসেসিং করতে। তারপর এই ১০০ লোক নিয়ে আসলো। কিন্তু এই ১০০ লোকের থাকার জায়গা নাই, খাবার নাই, চাকরি নাই। এই যে দুরাবস্থা কেউ যদি নিজের চোখে না দেখে, বুঝতে পারবেন না। আমরা যারা প্রবাসে আছি, আমরা অনেক জায়গায় এসব দেখি।”

“কেউ যদি ১০০ ভিসা পাঠিয়ে এক কোটি টাকা আয় করে, তাহলে নিশ্চয় দূতাবাসের প্রত্যয়ন নিতে হয়েছে। দূতাবাসের প্রত্যয়ন ছাড়া সৌদি আরবে কর্মী পাঠানো হয় না। এ বিষয়ে দূতাবাসকেও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। দূতাবাস কেন এটা করলো, কেন পরবর্তীতে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলো না? কারা এই কাজগুলো করছে, কাদের কারণে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে, এই বিষয়গুলো নিয়ে এখনই সময় কাজ করার।” বলেন সৌদি প্রবাসী জহিরুল ইসলাম।

এই বিষয়ে ওকাপ চেয়ারপারসন শাকিরুল বলেন, “সৌদি আরবের শ্রমবাজারটি বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমাদের যা যা করণীয় সব করতে হবে। এখানে যে অস্বচ্ছতাগুলো আছে, সেগুলোকে দূর করে একটা স্বচ্ছ সিস্টেম তৈরি করতে হবে। আমরা অনেক ক্ষেত্রে অভিবাসীদেরকে দায়ী করি, তাদেরকে অসচেতন বলি। বাস্তবতা হচ্ছে, কর্মসংস্থানের অভাবে অনেকেই যেনতেনভাবে বিদেশ যেতে চাইবে। সে ক্ষেত্রে আমি যত প্রশিক্ষণই দিই, যত সচেতনতা তৈরি করি না কেন, কাজ হবে না।”

তবে বিদেশে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রতারণা কমে এসেছে দাবি করে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সভাপতি আবুল বাশার বলেন, “আগে ছোট ছোট কোম্পানি নামে-বেনামে কর্মী নিত, এখন আর তারা সেভাবে কর্মী নিচ্ছে না। এখন যেসব কর্মী ফিরে আসে তারা আগের যাওয়া কর্মী।”

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন বলেন, “বিদেশে গিয়ে আমাদের কোনো কর্মী যাতে প্রতারিত হয়ে ফিরে না আসেন, তা নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে। এজন্য কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া আরও কঠিন করা হয়েছে। দক্ষ কর্মী পাঠানোর চেষ্টা চলছে। এছাড়া কর্মী পাঠানোর আগেই চাকরির নিশ্চয়তা যাচাই করতে কাজ করা হচ্ছে।”

আগামীকাল : ‘মালয়েশিয়ায় অনেক কষ্টে আছি, ভাষায় প্রকাশ করার মতো না’