জিন্নাত আয়ুব : ‘সংকেত’ না পেলে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার এসিল্যান্ড বা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মুমিন কাজ করেন না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এই ঘটনায় গত ১৩ নভেম্বর চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক বরাবর করা একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী নুরুন্নেছা বেগম; যিনি উপজেলার বরুমছড়া এলাকার বহদ্দার বাড়ির বাসিন্দা।
লিখিত অভিযোগে নুরুন্নেছা উল্লেখ করেন, তিনি আনোয়ারার জুইদন্ডীর মৌজার স্থায়ী বাসিন্দা। তিন শতক নাল জমির নামজারি করার জন্য তিনি দলিলপত্রের তথ্য দিয়ে অনলাইনে আবেদন করেন। এরপর গত ২৭ সেপ্টেম্বর এ বিষয়ে প্রস্তাব দেওয়ার জন্য ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মো. এনতেজার উদ্দীনকে দায়িত্ব দেন এসিল্যান্ড।
পরবর্তীতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য এনতেজার দায়িত্ব দেন সার্ভেয়ার সোহেল পারভেজকে। কিন্তু কোনরূপ প্রতিবেদন না দিয়ে আবেদনের নথি এসিল্যান্ড বরাবর প্রেরণ করেন তারা। এরপর আবেদনকারী জমির মালিকানার সমর্থনে কোন দালিলিক প্রমাণপত্র উপস্থাপন করতে পারেননি, উল্লেখ করে নামজারি আবেদন নামঞ্জুর করেন এসিল্যান্ড।
অথচ আবেদনের সাথে আমার ২০০৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তারিখের ৬১০নং আমমোক্তারনামা, ১৯৫৬ সালের ১৪ এপ্রিল তারিখে রেজিস্ট্রি করা ২১৪২ নং কবলা, গত ২৪ জুলাই রেজিস্ট্রি করা ৩৮৯১ নং দলিল, আরএস খতিয়ান নং- ৬৪৩, বিএস খতিয়ান নং ৪৬২, এনআইডি ইত্যাদি উল্লেখ করে আবেদন করি।
শুনানির সময় এসব কাগজপত্র না দেখেই দালিলিক প্রমাণপত্র উপস্থাপন করা হয়নি উল্লেখ করে নামজারির আবেদন এসিল্যান্ড নামঞ্জুর করেন বলে উল্লেখ করা হয় লিখিত অভিযোগে।
ভুক্তভোগী নুরুন্নেছা বেগম অভিযোগ করে একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এসিল্যান্ড মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মুমিন, ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মো. এনতেজার ও সার্ভেয়ার সোহেল পারভেজ মিলে তাকে হয়রানি করছেন। এই কারণে সুবিচার পাওয়ার আশায় জেলা প্রশাসক বরাবর অভিযোগ করেছেন।’
ভুক্তভোগী নুরুন্নেছার স্বামী মো. আইয়ুব অভিযোগ করে একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘নামজারি করার জন্য আমি আবেদন করেছিলাম। আমাদের জায়গার সব কাগজপত্র ঠিক আছে। কিন্তু বটতলী ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা এনতেজার তদন্তে গিয়ে আমার কাছে ১৫ হাজার টাকা চান। আমি বলেছি, কাগজপত্রে আমি ওকে আছি। এতো টাকা কেন দেব?’
‘তখন এনতেজার বলেন, স্যার (এসিল্যান্ড) আমার সংকেত না পেলে ফাইল ধরবে না। তখন আমি এসিল্যান্ড স্যারের কাছে গেলে এনতেজার বলেন, আমার নাকি সমস্যা আছে। এভাবে সবাই মিলে নামজারির বিষয় নিয়ে মাসের পর মাস হয়রানি করে যাচ্ছে। আমি বিষয়টি চট্টগ্রামের ডিসি মহোদয়কে অবগত করি। ডিসি স্যার আমাকে আশ্বস্ত করেন আপনি এসিল্যান্ডের কাছে যান করে দেবে। এরপর এসিল্যান্ডের কাছে গেলে এসিল্যান্ড এই ফাইল বাতিল করে আমাকে আবার নতুনভাবে আবেদন করতে বলেন। আমি বলছি এটাতে করলে সমস্যা কী, এ কথা বললে আমার উপর রেগে যান তিনি। পরে আমি চলে আসি। শুধু আমি না এভাবে শত শত সেবা গ্রহীতারা সংকেত না পেয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন দিনের পর দিন।’
ভুক্তভোগী নুরুন্নেছা বেগমের অভিযোগের বিষয়ে বটতলী ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মো. এনতেজার উদ্দীন বলেন, ‘নুরুন্নেছা নামক এক নারী আমিসহ এসিল্যান্ড স্যারের বিরুদ্ধে ডিসি অফিসে অভিযোগ দিয়েছে। অভিযোগ দিয়ে লাভ কী? এখান থেকে আমার সংকেত যেতে হবে!’
আরেকজন ভুক্তভোগী নুরুল হক বলেন, ‘আমি একজন প্রবাসী। আমার জায়গাটা বিক্রি করে আমার সহধর্মিণীকে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নিয়ে যাব বলে ঠিক করেছি। এমন অবস্থায় নুর উদ্দীন নামের এক প্রতারক ভুয়া একটি ওয়ারিশ সনদ (যা ২০১৭ সালে পত্রিকায় মাধ্যমে প্রকাশ করে বাতিল করেন তৎকালীন বৈরাগ ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও নারী ইউপি সদস্য) নিয়ে ভূমি অফিসে একটি মিস মামলা করেন। ২০২২ সাল থেকে এই মিস মামলার কয়েকবার শুনানি করেও এসিল্যান্ডের কাছে সঠিক কোন ডকুমেন্টস দিতে পারেননি তিনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সর্বশেষ বর্তমান বৈরাগ ইউপি চেয়ারম্যানকে আবার তদন্ত করতে দেন এসিল্যান্ড। চেয়ারম্যান এলাকা থেকে যাচাই করলেও এসিল্যান্ড নাকি সংকেত পায় নাই বলে আমাকে এখনো পর্যন্ত হয়রানি করে যাচ্ছে। অথচ বর্তমান চেয়ারম্যান খরচ বাবদ আমার কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা নিয়েছেন। এসিল্যান্ডকে ভালো সংকেত দেওয়ার জন্য বটতলী ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা এনতেজারকে ১০ হাজার টাকাও দিয়েছি। কী দেশে আমরা বসবাস করছি। সংকেতের কারণে মানুষ বছরের পর বছর এভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন।’
নুরুল হকের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বটতলী ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মো. এনতেজার উদ্দীন বলেন, ‘তার (নুরুল) ব্যাপারে তো আমি ভালো সংকেত দিয়েছি। তারপরও স্যার (এসিল্যান্ড) কেন করে নাই, জানি না। ওনার তো ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার আছে। যা করবেন ওনার মর্জিতে করবেন।’
অভিযোগের বিষয়ে জানার জন্য গত বুধবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে আনোয়ারা উপজেলার এসিল্যান্ড মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মুমিনের অফিসে যান এ প্রতিবেদক। তখন তিনি বলেন, ‘এতো কিছু করার পরেও মানুষ বাইরে গিয়ে বলে হয়রানির শিকার হচ্ছে।’
এই কথা বলার সময় দেখা যায়, উপস্থিত একজন সেবা গ্রহীতাকে শাসাচ্ছেন এসিল্যান্ড। পরক্ষণে তিনি বলে উঠেন, ‘এই আপনি কি এগুলো রেকর্ড করেছেন? গত সপ্তাহে এরকম একজনকে পুলিশে দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। পরে হাতে পায়ে ধরাতে ছেড়ে দিয়েছি। ঠিক আছে, এখন যান। নুরুল হকের বিষয়ে দুই পক্ষকে কয়েকদিনের মধ্যে ডাকব।’
পরে আবার যোগাযোগ করা হলে এসিল্যান্ড মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মুমিন বলেন, ‘নুরুল হকের বিষয়ে চেয়ারম্যান থেকে এখনও সংকেত আসেনি।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চট্টগ্রামের ডিসি আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের মুঠোফোনে কল করেও সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে চট্টগ্রাম অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রাকিব হাসানকে অবগত করলে তিনি বলেন, ‘এসিল্যান্ডের এসব বিষয় উপ-পরিচালক (স্থানীয় সরকার) দেখেন।’
এরপর চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের উপ-পরিচালক (স্থানীয় সরকার) লুৎফুন নাহারকে না পেয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (জেলা ও মাঠ প্রশাসন অনুবিভাগ) মো. আমিন উল আহসানকে এসব অভিযোগ অবগত করা হয়। তখন তিনি জানান, অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখার জন্য সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠাবেন।