চট্টগ্রাম: প্রাণ বাঁচাতে অন্যদের সঙ্গে শিশুটিও দৌড়ে ছিল। তবু শেষরক্ষা হয়নি। মিয়ানমারের সেনাদের ছোড়া গুলিতে লুটিয়ে পড়ে মংডুর হাসুরাতা চমইন্যা গ্রামের রহমত উল্লাহ। রক্ত ঝরেছে তার ছয় বছরের ছোট্ট শরীরে। অবশ্য কপাল জোরে বেঁচে গেছে। গুলি তার পেটের ডান পাশে লেগে বেরিয়ে গেছে বাম পাশ দিয়ে।
মঙ্গলবার দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারী ওয়ার্ডে রহমত উল্লাহর বাবা হাফিজ উল্লাহ দিচ্ছিলেন সেদিনের ঘটনার বর্ননা। এরই ফাঁকে বেডে শুয়ে রহমত উল্লাহ শুধু এতটুকুই বললো, ‘আরে গুলি মাইরগি।’ এরপর নিজ থেকে আর কিছুই বলেনি সে। হয়তো তার না বলাটাই অনেককিছু বলা! ক্যামেরার লেন্স দেখেও তার চোখ দুটোর ভূমিকা ছিল শুধুই তাকিয়ে থাকা। নেই কোন সাড়া-শব্দ।
হাফিজ উল্লাহ বললেন, ‘মিয়ানমারের সেনারা বলছে, আমরা নাকি বাঙালি। আমরা বলেছি, জন্ম থেকে আমরা এখানে আছি। আমরা কেন বাঙালি হবো? ২৬ আগস্ট বিকেলে সাড়ে ৪টার দিকে আমাদের গ্রামে আসে সেনারা। বাড়ি থেকে বের হয়ে কয়েক পা এগোতেই শুনি- বাড়িঘর পোড়ানো শুরু করেছে তারা। আত্মরক্ষার জন্য বাড়ির অদূরে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলাম।’
তার বর্ননা অনুযায়ী, প্রাণ ভয়ে সকলে তখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। বেশ কয়েক রাউন্ড গুলির শব্দ শুনতে পাই। সেনারা চলে যাওয়ার পর বাড়িতে গিয়ে দেখি রহমত গুলিবিদ্ধ। বাড়িতে তখন শুধু তার মা ছিল। তার মা বলেছে, বাড়িতে সেনারা প্রবেশ করার পর রহমতকে ধরতে চায়। দৌড়ে ধরতে না পেরে তাকে গুলি করে দেয়। রক্ত ছড়িয়ে পড়ে ঘরজুড়ে।
হাফিজ বলেন, ‘গুলি খেয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে জ্ঞান হারায় রহমত উল্লাহ। তখন আমি ভেবেছিলাম সে হয়তো আর নেই। কিন্তু কিছুক্ষণ পর দেখি সে কথা বললো। গুলি লাগার কথা নিজে নিজেই জানালো। এরপর তাকে বাঁচাতে নাফ নদী পেরিয়ে এদেশে আসতে চাই। শেষ পর্যন্ত সেনাদের নজর এড়িয়ে ২৮ আগস্ট নাফ নদী পার হয়ে শাহপরীর দ্বীপে পৌঁছি। সেখান থেকে ২৯ আগস্ট কুতুপালং শরণার্থী হাসপাতালে ও পরে কক্সবাজার হাসপাতালে নিয়ে আসি। এরপর ৩০ আগস্ট রহমতকে নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল আসি। অনেক কষ্টে এই পর্যন্ত এসেছি।’
নাফ নদী পার হতে সবাইকে ১০ হাজার টাকা করে দালালকে দিতে হলেও তার কাছ থেকে কেউ একটাকাও দাবী করেননি বলে জানান হাফিজ উল্লাহ, ‘ছেলে গুলিবিদ্ধ দেখে নিয়ে আসছে। এখানেও ওষুধের কোন সমস্যা নেই। একটি ফার্মেসী ঠিক করে দিয়েছে একজন। বলেছে, যা ওষুধ দরকার সব সেখান থেকে আনতে। ডাক্তারও বলেছে, দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে।’
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারী ওয়ার্ডে দায়িত্বরত ডা. আব্দুল্লাহ আল ফারুক বলেন, ‘রহমত উল্লাহ’র পেটে গুলি লেগে বেরিয়ে যায়। চিকিৎসায় সে পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার পথে। সপ্তাহখানেক ধরে সে মুখে খেতে পারছে। অস্ত্রোপচারের আর দরকার নেই। আশা করছি কয়েকদিনের মধ্যে সে হাঁটতে পারবে।’
এদিকে ছেলের সুস্থ হয়ে ওঠার খবরেও তেমন খুশি হতে পারছেন না হতভাগ্য বাবা হাফিজ উল্লাহ; বলেন, ‘আমার বৃদ্ধ মাকে গুলি করে মেরেছে ওরা। স্ত্রী ও তিন সন্তান এখনো আছে মংডুর নলগইন্যা এলাকার শ্বশুর বাড়িতে। তিন ছেলের বয়স ১০, ৮ আর ৪ বছর। শুনেছি সেখানে সেনারা মাইকিং করে ঘোষণা দিয়েছে মঙ্গলবারের মধ্যে এলাকা ছাড়তে। তারা এখনো মিয়ানমার থেকে আসতে পারেনি। ছেলেটা বারবার মায়ের কথা জানতে চায়, কাঁদে।’
নাগরিক অধিকার নিয়ে মিয়ানমারে ফিরতে চান হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোহিঙ্গা যুবক শাহ আলম; বলেন, ‘জন্ম থেকেই দেখতাম কেউ না কেউ খুন হচ্ছে বা বাড়ি লুঠ করে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে সরকারি লোকজন। ওরা বলে, আমরা নাকি ওখানকার লোকই নয়। কলেজে পড়তে দেয়া হয় না। এমনকি গত পাঁচ বছর ধরে আরবী শিক্ষা পর্যন্ত কেউ নিতে পারছে না। আমাদেরকে মাঠের কাজ অথবা মাছ ধরার কাজই করতে হয়। অনেক সময় মংডু শহরে পর্যন্ত যেতে দেয় না। কারাগারের মধ্যে ছিলাম সেখানে।’
মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত ৮৬ রোহিঙ্গা চিকিৎসাধীন আছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কেউ এসেছেন গুলিবিদ্ধ হয়ে। কেউ আবার সংঘাতের বলি হয়ে। তাদের অনেকেই হারিয়েছেন হাত-পা। পরিবার-পরিজনকে হত্যা আর বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার সেই দৃশ্য ভুলতে পারছেন না তারা।
গত শনিবার রাতে ঘুনধুম রেজু আমতলী সীমান্তের ওপারে মাটিতে পুঁতে রাখা বোমার বিস্ফোরণে দুই পা উড়ে যায় ইউছুপ নবীর। রোববার রাতে চট্টগ্রাম মেডিকেলে আনার পর এখন ইউছুপের চিকিৎসা চলছে। বিস্ফোরণের ফলে তার চোখ ও শরীরের বিভিন্ন অংশেও রয়েছে স্প্রিন্টার।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অর্থোপেডিক বিভাগের প্রধান ইকবাল হোসাইন বলেন, ‘মাইন বিস্ফোরণে আহত ইউছুপের দুই পা কেটে ফেলতে হয়েছে। মাইনে আহত হাসানের একটি পা কাটতে হয়েছে। তাদের অনেক দিন চিকিৎসা নিতে হবে। অন্য রোহিঙ্গাদের গুলি করা হয়েছে খুব কাছ থেকে। এতে তাদের হাড়গুলো একেবারেই ভেঙে যায়। ফলে কিছু কিছু রোগীকে পঙ্গুত্ববরণ করতে হচ্ছে।’
রোহিঙ্গাদের আর্তি কে শুনবে? শুনছে না মিয়ানমার। এখন বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর চাপ সামলানো বাংলাদেশ সরকারের পক্ষেও সম্ভব হচ্ছে না।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত ৯৮ জন রোহিঙ্গা চিকিৎসা নিতে এসেছেন। এদের মধ্যে ১০ জন সেবা নিয়ে চলে গেছেন। দুইজন মারা গেছেন। বর্তমানে ৮৬ জন চিকিৎসাধীন আছেন।’
আহত রোহিঙ্গাদের আন্তরিকভাবে সেবা দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জালাল উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের চিকিৎসকরা তাদের পেশাদারিত্ব, দায়িত্ববোধ ও মমত্ব নিয়ে রোহিঙ্গা রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন।’