মহসীন কাজী : ২১ অক্টোবর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ— সেদিন ছিল আমার বাবার ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। সঙ্গত কারণে যেতে হয় গ্রামের বাড়িতে। যেখানে চিরঘুমে শায়িত আছেন বাবাসহ মুরুব্বিরা। ওই দিন ছিল তপ্ত রোদ, দুপুরে ভ্যাপসা গরম। গরমের কারণে বাড়িতে থাকতে ইচ্ছে করছিল না। তাই ছোটবেলার বন্ধু কামালকে নিয়ে ঘুরতে বের হই।
গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির হারুয়ালছড়ি থেকে নাজিরহাট-কাজীরহাট (রামগড় রোড সেকশন-১) হয়ে অটোরিকশা চেপে যাচ্ছিলাম সোজা উত্তর দিকে। উপজেলার অন্যতম প্রধান সড়ক হলেও তেমন গাড়ি নেই, কোলাহলও নেই। প্রায় ফাঁকা রাস্তায় চলছিলাম। ছায়া সবুজ-শ্যামল গ্রাম, ঝিরিঝিরি বাতাস, ভালোই লাগছিল। বাতাসের উষ্ণতার মাঝে শো, শো করে চলছিল আমাদের অটোরিকশা। প্রায় তিন কিলোমিটার যাওয়ার পর ওমর কাজীর বাড়ি ফেলে সড়কের বাঁকে চোখ আটকে যায়। মাত্র দুই-তিন ফুট জায়গা রেখে সড়ককে এমনভাবে কাটা হয়েছে, যেন পড়ে যাচ্ছে যাচ্ছে অবস্থা।
স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে, মাটি কাটার যন্ত্রের কোপ। অন্ততঃ ১৫-২০ ফুট খাড়া গর্ত নয়, যেন এক পুকুর। যার মাধ্যমে গিলে ফেলা হয়েছে সড়কের ধার, যাকে বলা হয় ফুটপাত। আশপাশ মিলিয়ে দেখলে মনে হবে আস্ত একটি পুকুর। পাশে বিশাল মাটির ঢিবি। ওপাশে মাটি কাটার যন্ত্র তখনও চলছিল। চারদিকের অবয়ব বলে এটি একটি ইটভাটা। বুঝতে বাকি রইলো না, ইটভাটার মাটি জমা করতে গিয়ে সড়কের বুকও কেটে নেওয়া হয়েছে।
অনুসন্ধানী মনে জাগছিল নানা প্রশ্ন। দেখেই বুঝা যাচ্ছিল, ইটভাটাটি অনেক পুরনো। আগামী মৌসুমে ইট তৈরির জন্য আবার প্রস্তুত করা হচ্ছে। ভাবলাম, আইন মানলে এখানে ইটভাটা হয় কী করে। আশপাশে প্রধান সড়ক ছাড়াও আছে জনবসতি, স্কুল, মসজিদ আর ফসলের মাঠ। তার উপর নির্দয়ভাবে কোপ পড়েছে সড়কে। এসব ভাবতে ভাবতে সঙ্গে থাকা বন্ধুকে বললাম ফেরার পথে যেন এখানে দাঁড়াতে মনে করিয়ে দেয়।
ঘণ্টা দুয়েক উত্তরে ঘুরে আবার দক্ষিণে ফেরার পালা। কোম্পানি টিলা ফেলে বামে বাঁক। যে বরাবর সড়কের বুকে যন্ত্রের কোপ। এখানে এমনভাবে খোঁড়া হয়েছে, যাতে রয়েছে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার ঝুঁকি। সড়কটি পুরোপুরি চালু হলে এটি হবে মরণফাঁদ। তার উপর আগামী বর্ষায় সড়কটির অস্তিত্ব থাকবে কিনা তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। অথচ এটিই হবে চালুর অপেক্ষায় থাকা রামগড় স্থলবন্দরের অন্যতম প্রধান যোগাযোগমাধ্যম। মাথায় নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে খেতে থামলাম সেখানে।
পড়ন্ত বিকেল তখন। সূর্য পুরো পশ্চিমে হেলেছে। সড়ক কেটে এমন নির্মমতা দেখলে যে কেউ ভাববেন, থমকে যাবেন। ছবি তোলার উপযুক্ত আলো দেখে অন করলাম মোবাইল ক্যামেরা। ক্ষতবিক্ষত সড়ক ধরে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে কয়েকটি ছবি নিলাম। ছবি তোলা দেখে মাটির ঢিবি থেকে বেরিয়ে আসলেন একজন। কী যেন বলতে চাইছিলেন। আমার খেয়াল সেদিকে নেই। মাটি কাটার যন্ত্রসহ আরেক ক্লিক দিতে দিতে চালকের কাছে জানতে চাইলাম, এভাবে রাস্তা কাটার কারণ। তিনি জবাব দিলেন না। চালকের দৃষ্টি ছবি তোলার দিকে। মুখে কথা নেই। আর তাকালাম না ওদের দিকে। সোজা ফিরলাম আমার গন্তব্যে।
শহরে ফিরে পরদিন ভাবলাম কী করা যায়! সে ভাবনা সে কাজ। সড়কের মাটি ইটভাটায় নেওয়ার কাহিনি ছোট করে লিখে ছবি আপলোড। তারপরের ক্লিকে সেটি হয়ে যায় ফেসবুক স্ট্যাটাস। এ স্ট্যাটাসের পরের ঘটনা আমার ফেসবুক বন্ধুদের জানা।
সড়কের বুক কেটে পুকুর বানিয়ে ইটভাটায় মাটি নেওয়ার এই ছবি সচেতন মহলকে ভাবিয়ে তোলে। স্ট্যাটাসটি দ্রুত শেয়ার হতে থাকে। এভাবে বিষয়টি নজরে আসে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। ২২ অক্টোবর স্ট্যাটাস দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যায় এলজিইডির ইঞ্জিনিয়ারিং টিম। পরদিন সকালে অভিযান চালায় উপজেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। মালিককে না পেলেও আদালত অপরাধের প্রমাণ পেয়ে উপস্থিত ম্যানেজারকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করেই যেন দায়িত্ব শেষ করেন। মামলা কিংবা প্রতিষ্ঠান সিলগালা কিছুই করেননি। এতদিন ‘রহস্যময়’ ঘুমে থাকা পরিবেশ অধিদপ্তরও যেন হালকা জাগে। হালকা পরিদর্শন করলেও তাদের কোনো অ্যাকশন নেই।
যাত্রাপথে ইটভাটা অনাচারের যে দৃশ্য আমার চোখে ধরা পড়ে তা বলতে গেলে সামান্যই। আরও করুণ চিত্র আছে ফটিকছড়ির ইটভাটাকে ঘিরে। এসব দেখে কীভাবে নীরব থেকেছে কর্তৃপক্ষ, সেটা আমাকে আরও ভাবাচ্ছে।
ফটিকছড়ির একটি গ্রামের নাম পাইন্দং। এখানে ইটভাটার সংখ্যা বেশি। হারুয়ালছড়ি, ভূজপুর, পাইন্দং- তিন ইউনিয়নের সীমানাবর্তী পাইন্দংয়ের উত্তর সীমানায় এক কিলোমিটারের মধ্যে আছে ছয়টি ইটভাটা। এখানকার একটি ইটভাটা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হালদা নদীর ভেড়িবাঁধের মাটি কেটে হালদাকেও গিলতে বসেছে।
এই সীমানার আরেক ইটভাটার নির্মমতার সাক্ষী হয়ে আছে একটি বটগাছ। গাছটির চারপাশের বিশাল এলাকাজুড়ে অন্তত ১৫ ফুট মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গাছটি ইটভাটার নির্মমতার সাক্ষী হয়ে আছে। হালদা আর বটগাছের এই করুণ ছবি ইতিমধ্যে আমি ফেসবুকে পোস্ট করেছি। ছবি দেখে যারপরনাই বিস্মিত হয়েছেন সচেতন মহল। অনেকে ফোন করে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
আমাদের হারুয়ালছড়ি একটি নয়নাভিরাম গ্রাম। এ গ্রামকে পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করেছে হাজারীখিল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও নয়নাভিরাম রাঙাপানি চা বাগান। এখানে যাওয়ার পথে চা বাগান ঘেঁষে লম্বাবিলের লোকালয় আর প্রাইমারি স্কুল এলাকায় চোখে পড়ে পাশাপাশি দুটি ইটভাটা। আমাদের বাড়ির কাছাকাছি আছে আরও তিনটি।
প্রতি বছর শীতকালে এ গ্রামসহ এলাকার ইটভাটা এলাকায় সূর্যের দেখা মেলে না। দিনের বেলায়ও ইটভাটার ধোঁয়ায় আকাশ থাকে গুমোট। আর আশপাশের গাছগাছালিও হয়ে যায় ক্ষীণকায়। পাতায় সতেজতা নেই। গ্রামের বাড়ির আম, কাঁঠালসহ মৌসুমি ফলের ফলনেও প্রভাব লক্ষণীয়। আমের ফুল ঝড়ে যায়, মুকুল আসে না। পাশাপাশি শিমসহ রবিশস্য আবাদেও ঘটে ব্যাঘাত।
পরিবেশ আইনের কোনো ধারায় বিধিসম্মত নয় এসব ইটভাটা। পরতে পরতে লঙ্ঘিত হচ্ছে আইন। আইনে যা আছে তার উল্টোটাই হচ্ছে এসব ইটভাটায়। কেস স্টাডি হিসেবে এখানে ফটিকছড়ির চিত্র তুলে ধরা হলেও চট্টগ্রামজুড়ে চলছে এমন অনাচার।
ইটভাটার প্রধান কাঁচামাল হচ্ছে মাটি। প্রতি শুষ্ক মৌসুমে মাটি সংগ্রহের নামে চলে আরেক অনাচার। ভাটা মালিকের অর্থের টোপে স্থানীয় মাস্তানদের মাধ্যমে সাবাড় হচ্ছে কৃষি জমির টপ সয়েল। ইটভাটা প্রবণ এলাকা ছাড়াও আশপাশের গ্রামের কোনো কৃষি জমি অবশিষ্ট রাখছে না তারা। এতে ফসলি জমির ফলন কমছে দ্রুত। পাশাপাশি আশপাশের মানুষের রোগবালাই তো আছেই। চর্মরোগ ও শ্বাসকষ্টের রোগ লেগেই থাকে।
প্রশ্ন আসতে পারে, কীভাবে চলে আসছে এই অবৈধ কর্মযজ্ঞ। জবাব একটাই ‘ম্যানেজ’ করে। এ কারণে নাকি স্থানীয় ছোট-বড় প্রায় সকল জনপ্রতিনিধি, দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসন নীরব। আবার ক্ষেত্র বিশেষে অনেক ইটভাটার মালিকই খোদ জনপ্রতিনিধি।
গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ফটিকছড়িতে যে ইটভাটা সড়কের বুক কেটে পুকুর বানিয়ে ফেলেছে, সেটির মালিকও এক প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি। তার নাকি আরও ইটভাটা আছে। আবার তিনিই নাকি অবৈধ ইটভাটা মালিক সমিতির বড় নেতা। বছর খানেক আগে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার আবু আজাদ রাঙ্গুনিয়ায় যে ইটভাটায় হামলার শিকার হয়েছিলেন সেটির মালিকও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, অবৈধ ইটভাটার মালিকরা ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত। তাদের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ উপজেলা প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার আছে। কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়ার এই প্রক্রিয়া অনেকটা মন্থর- এটাও রহস্যজনক। একটু লেখালেখি হলে নড়েচড়ে বসে। নইলে চলে স্বাভাবিকের মতো।
আইনের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে পরিবেশ আইনে অভিযুক্ত হলে অতিমুনাফা লোভী এসব জনপ্রতিনিধিদের পদে থাকার বৈধতাও থাকবে না। অপকর্ম রোধ ও পরিবেশ রক্ষায় এমন শাস্তির উদাহরণ থাকলে ভবিষ্যতে কোনো জনপ্রতিনিধি এসব অপকর্মে জড়ানোর সাহস পাবেন না।
ধারাবাহিকভাবে চলে আসা এই অনাচারে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে পরিবেশ, প্রতিবেশ ও প্রকৃতির। এসবের প্রভাব ইতিমধ্যে লক্ষণীয়। জলবায়ু পরিবর্তনের মোড়কে প্রকৃতি তার আপন গতিতে ফিরিয়ে দিচ্ছে তার প্রতি বিরূপ আচরণের ফল। যার কুফল আমাদের বইতে হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
লেখক: সাংবাদিক।