চট্টগ্রাম: ডাচ-বাংলা ব্যাংকের খোয়া যাওয়া ১০ লাখ টাকা উদ্ধারের পর ক্ষতিগ্রস্ত মামলার বাদিকে ৫ লাখ টাকা ফেরতের বিনিময়ে আসামির সঙ্গে আপোষ-মীমাংসার প্রস্তাব দেয় কোতোয়ালী থানা পুলিশ। বাদি বিষয়টি তার কলেজ জীবনের বন্ধু চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের সচিব শাব্বির ইকবালকে জানিয়ে পুরো টাকাটি পেতে সহযোগিতা কামনা করেন।
শাব্বির ইকবাল তার ঘনিষ্ঠজন গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (বন্দর) মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ’র কাছে পাঠান ভুক্তভোগী রূপাশকে। উপকমিশনার শহীদুল্লাহ তাকে রেফার করেন উপকমিশনার (পশ্চিম) এস এম মোস্তাইন হোসেনের কাছে। মোস্তাইন ফোন করেন কোতোয়ালী থানার ওসি মো. জসিম উদ্দিনকে। যেহেতু স্বীকারোক্তি আছে, সিসিটিভির ফুটেজ আছে সেহেতু পুরো ১০ লাখ টাকা আদায় করে দিতে অনুরোধ করেন উপকমিশনার মোস্তাইন। এরপর মামলার বাদি দেখা করতে গেলে ওসি বেঁকে বসেন। বলেন, ডিসি (উপকমিশনার) স্যারের কাছে গেলেন কেন, এখন এক টাকাও পাবেন না!
জানতে চাইলে ইতস্তত বোধ করেন ভুক্তভোগী রূপাশ কান্তি রুদ্র। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলেন, ‘ওসি নয় তদন্তকারী দারোগা এমদাদ হোসেন জানতে চেয়েছেন কেন ডিসির কাছে গেলাম। সেই কারণে তিনি টাকা উদ্ধার নয় মামলার পথেই হাঁটবেন বলে জানান। চার্জশিট দেয়ার কথা থাকলেও সময়ক্ষেপন করছেন। বলছেন চার্জশিট দিতে হলে অধিকতর তদন্ত প্রয়োজন।’
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, গত ২১ জুন ২৭ কোটি টাকা তুলতে বাংলাদেশ ব্যাংকে যান ডাচ-বাংলা ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার চিফ ক্যাশ অফিসার রূপাশ কান্তি রুদ্র। সঙ্গে নিয়ে যান ব্যাংক ম্যাসেঞ্জার ইকবাল হোসেনকে। টাকা নিয়ে মূল গেইট দিয়ে বের হতে হলে দুতলা থেকে গেইট পাশ নিতে হয়। সেটি নিতে যান রূপাশ। আর টাকার পাশে বসিয়ে যান ম্যাসেঞ্জার ইকবাল ও সিকিউরেক্স সিকিউরিটি কোম্পানির মহসীন মোল্লাকে।
২০ মিনিট পর ফিরে এসে রূপাশ দেখতে পান ১ হাজার টাকার ১০টি বান্ডিল (১০ লাখ টাকা) উধাও। পাহারারত ইকবাল-মহসীনের কাছেও এই ১০ লাখ টাকার উত্তর নেই। অনেক চেষ্টা করেও হিসাব মেলাতে পারেন না রূপাশ। মুহূর্তের মধ্যে অফিস-অর্ডার জারি হলো-দিনের মধ্যেই ২৭ কোটি টাকার ক্যাশ মেলাতে হবে। অন্যথায় চাকরিচ্যুতিসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে রূপাশের বিরুদ্ধে। গত্যন্তর না দেখে সমস্ত আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের সহযোগিতায় ১০ লাখ টাকা জোগাড় করে সেদিনই রাত সাড়ে ১১টায় ক্যাশ মিলিয়ে চাকরি রক্ষা করেন রূপাশ।
রূপাশ কান্তি রুদ্র জানান, গত ২১ জুন ডাচ-বাংলা ব্যাংকের হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তোলা ২৭ কোটি টাকার মধ্যে ব্যাংকে থাকা অবস্থায় ডাচ-বাংলা ব্যাংক চৌমুহনী শাখার লোকজন ১৫ কোটি টাকা, এটিএম ক্যাশ লোডকারী প্রতিষ্ঠান লুতফর ১০ কোটি টাকা গ্রহণ করে ভাউচারে স্বাক্ষর করে। সিকিউরেক্স সিকিউরিটি কোম্পানির ২ কোটি টাকা নিয়ে আমি ও ম্যাসেঞ্জার ইকবাল অপেক্ষা করছিলাম। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে কর্মচারী মহসীন মোল্লা হাজির থাকলেও তাদের আরেক কমকতা যিনি আসার কথা তিনি আসতে বিলম্ব করছিলেন। এ অবস্থায় মহসীনকে টাকাগুলো গ্রহণ করতে বললে জানান, তিনি টাকা গ্রহণের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি নন। এই পরিস্থিতিতে টাকাগুলো নিয়ে ডাচবাংলা ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখায় চলে যাবার জন্য গেইট পাশ আনতে গিয়েছিলাম ইকবাল ও মহসীনকে টাকা পাহারায় রেখে। আর এই সময়ের মধ্যে ঘটে গেল ঘটনাটি। এর মধ্যে ১৫ কোটি, ১০ কোটি করে যারা গ্রহণ করেছেন টেলিফোনে তাদেরও দ্বারস্থ হয়েছি তাদের কাছে ভুলে বাড়তি কোনো টাকা চলে গেছে কিনা। কিন্তু তারা নিশ্চিত করলেন তাদের কাছে এধরনের কোনো টাকা যায়নি।
রূপাশ জানান, বন্ধু-স্বজনের সহযোগিতায় উধাও হওয়া ১০ লাখ টাকা পূরণ দিয়ে পরদিন ২২ জুন ইকবাল হোসেন ও মহসীন মোল্লাকে আসামি করে কোতোয়ালী থানায় মামলা করি।
পুলিশের সংগৃহীত সিসিটিভির ফুটেজ দেখা যায়, পাহারারত সময়ে ম্যাসেঞ্জার ইকবাল হোসেন একটি খাকি খাম নিয়ে বাইরে যান। ৩ জুলাই ইকবালকে গ্রেফতার করে কোতোয়ালী থানা পুলিশ। পরদিন আদালতে হাজির করে ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে আদালত ইকবালকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। জিজ্ঞাসাবাদে ইকবাল ১০ লাখ টাকা সরিয়ে ফেলার কথা স্বীকার করেন পুলিশের কাছে।
চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের সচিব শাব্বির ইকবাল একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘রূপাশ আমার কলেজ জীবনের বন্ধু। তার অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যার কথা শুনে ভাবলাম ডিসি (ডিবি) শহীদুল্লাহ সাহেব আমার ঘনিষ্ঠজন। তদুপরি তিনি একজন সৎ পুলিশ অফিসার। তার দ্বারস্থ হলে হয়তো পুরো টাকাটাই পাওয়া যাবে। সে কারণে রূপাশকে পাঠিয়েছিলাম। কিন্ত এটা যে কাল হবে ভাবতে পারিনি। শহীদুল্লাহ সাহেব আন্তরিক হলেও পুরো ব্যাপারটাই এখন ধোয়াশাচ্ছন্ন।’
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (বন্দর) মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘এ ঘটনায় কোতোয়ালী থানায় মামলা হয়েছে। এ বিষয়ে কিছু জানার থাকলে কোতোয়ালী থানায় যোগাযোগ করুন।’ এর বাইরে কিছু বলতে রাজি হননি পুলিশের ঊর্ধ্বতন এই কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে জানতে কোতোয়ালী থানার ওসি জসিম উদ্দিনের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়; প্রসঙ্গটি জানানোর পর তিনি একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘তদন্ত চলছে।’ এরপরই মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি। এরপর আবার ফোন করে প্রসঙ্গ তুলতেই ওসি জসিম উদ্দিন বলেন, ‘তদন্ত শেষ হয়নি। টাকাও উদ্ধার হয়নি।’ এরপর যথারীতি আবার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি।