নিয়মের তোয়াক্কা করেন না ওয়াসার এমডি, অবৈধ সংযোগে সম্মতি!


এম কে মনির : প্রাতিষ্ঠানিক আইন ভঙ্গ ও তদন্ত প্রতিবেদন উপেক্ষা করে ‘ওসাপ বাংলাদেশ’ নামক একটি এনজিওকে পানি সংযোগের অনুমোদন পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রাম ওয়াসার শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।

অভিযোগ, ওই এনজিও’র অর্থায়নে গত মে মাসে পরিবারসহ কক্সবাজারে প্রমোদ ভ্রমণে গিয়েছেন চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডিসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। আর এজন্য তাদেরকে খুশি করে নিয়ম বহির্ভূত সংযোগের অনুমোদন দিতে তদন্ত প্রতিবেদন ও নিয়মের কোনো তোয়াক্কা করেননি খোদ চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহও। এমনকি অনুমোদন পাইয়ে দিতে এমডির কাছে ওসাপের মিডিয়া হয়ে কাজ করেছেন উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) লাল হোসেন।

আবার এসব অনিয়মের নেপথ্যে ছিলেন বিক্রয় বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী রিচার্ড নেলসন পিনারু। অথচ সংশ্লিষ্ট মডের নির্বাহী প্রকৌশলী সরেজমিনে পরিদর্শন শেষে আবেদিত স্থানে সংযোগ না দিতে সুপারিশ করেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, উক্ত সংযোগের আবেদন অনুমোদন হলে আইনের লঙ্ঘন হবে এবং সেখানে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ অপ্রতুল। যেই স্থান থেকেই সংযোগ দেওয়া হোক না কেন, পানির সংকট শেষ প্রান্তের গ্রাহকের উপর চাপ সৃষ্টি করবে।

অভিযোগ, নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ওসাপ বাংলাদেশকে সংযোগ পাইয়ে দিতে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, বাণিজ্যিক কর্মকর্তা, ডিএমডি, এমডি পর্যন্ত ব্যাপক দৌড়ঝাঁপ চালিয়েছেন বিক্রয় বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী রিচার্ড নেলসন পিনারু। যিনি বিগত ১৫ বছর ধরে চট্টগ্রাম ওয়াসায় কর্মরত। এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এর আগেও দুর্নীতিতে জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছিল দুদক। কিন্তু কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার স্নেহভাজন হওয়ায় ও অঞ্চলপ্রীতির কারণে তিনি বরাবরই চট্টগ্রাম ওয়াসার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বহাল থাকেন।

জানা যায়, চট্টগ্রাম ওয়াসার আইনানুসারে ভূসম্পত্তির মালিক এমন গ্রাহককে সংযোগ দেওয়ার এখতিয়ার শুধুমাত্র ওয়াসার। এক্ষেত্রে নিয়ম মেনে সংশ্লিষ্ট গ্রাহককেই ওয়াসার কাছে আবেদন করতে হবে। আর নগরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে বসবাসরত নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠীর সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য ওয়াসায় কাজ করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ওসাপ বাংলাদেশ। এই উন্নয়ন সংস্থাটি চট্টগ্রাম ওয়াসার সাথে এ সংক্রান্ত চুক্তি সই করে।

নিয়মানুযায়ী এনজিওগুলো তাদের নিজ নামে পানি সংযোগের জন্য আবেদন করে থাকে। কিন্তু আগস্টের শুরুতে নগরীর ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইপিজেড এলাকার বক্স আলী মুন্সি রোড়ে ১৭টি পানি সংযোগের জন্য আবেদন করে ওসাপ বাংলাদেশ। গত ৯ আগস্ট তাদের আবেদন অনুমোদনের জন্য ওয়াসায় উপস্থাপিত হয়।

এরপর ওয়াসার মড-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলীর মতামত উপস্থাপনের জন্য বলা হয়। পরে গত ৪ সেপ্টেম্বর মড-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী ওসাপ বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলসহ সরেজমিনে পরিদর্শন করেন৷ পরিদর্শন শেষে গত ৭ সেপ্টেম্বর মড-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী ইপিজেড বক্স আলী মুন্সি রোডের ওই স্লাবে সংযোগ প্রদান না করার জন্য সুপারিশ করেন। তিনি তদন্ত প্রতিবেদনে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, সংযোগস্থলগুলো ব্যক্তি মালিকানাধীন ভাড়া ঘর। অর্থাৎ প্রত্যেকে ফ্ল্যাট মালিক, যারা ১০-১৬ টি বাসা ভাড়া দিয়েছেন। এতে তাদের এল.আই.সি প্রতীয়মান হয় না। পতেঙ্গা ইপিজেড এলাকায় পানির চাহিদার তুলনায় সরবরাহ অপ্রতুল। যেখান থেকেই সংযোগ দেওয়া হোক না কেন ক্রমান্বয়ে শেষ প্রান্তের গ্রাহকের উপর গিয়ে সংকটের প্রভাব পড়ে। ফলে ওই স্থানে সংযোগ প্রদান সমীচীন বলেও মনে হয় না।

এরপরও ওসাপ বাংলাদেশ এর করা আবেদনগুলোর অনুমোদন দিয়েছেন চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি এ কে এম ফজলুল্লাহ। এর মধ্য দিয়ে এনজিও হয়েও সরাসরি গ্রাহকের নামে আবেদন পেয়ে বসায় সংস্থাটি সাব ওয়াসায় রূপ নিলো। সেই সাথে বিধি ভঙ্গ করে সংযোগের অনুমোদন দেওয়ায় পতেঙ্গা ইপিজেড এলাকার ওই মডে পানি সংকট আরও বাড়বে। এতে ভোগান্তিও বাড়বে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম ওয়াসার বিক্রয় বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী রিচার্ড নেলসন পিনারু একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা ব্যক্তি মালিকের নামেই সংযোগ অনুমোদন দিচ্ছি। কোন এনজিও’র নামে দিচ্ছি না।’ তদন্ত প্রতিবেদনে সংযোগ না দেওয়ার পরামর্শের বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘যিনি তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছেন, সেরকম কেন দিয়েছেন এটা ওনাকে জিজ্ঞেস করুন।’

বিক্রয় বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মনিরুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি এসব বিষয়ে কিছুই জানাতে পারবেন না বলে জানান। পরে তিনি এমডির সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

চট্টগ্রাম ওয়াসার বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক কাজী শাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এটা আমি দেখিনি। না দেখে বলতে পারব না। আপনি আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দিন। আমি জানাচ্ছি।’ কিন্তু পরবর্তীতে এ কর্মকর্তাকে হোয়াটসঅ্যাপে বিষয়টি সম্পর্কে লিখে প্রশ্ন পাঠালেও সাড়া মেলেনি।

চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম ফজলুল্লাহ একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এসব ফাইল আমার কাছে আসে না৷’ তাহলে কি আপনার অজান্তেই অনুমোদন হয়- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘না, আমার অজান্তে নয়, আমার কাছে আসে না। এটার জন্য একজন দায়িত্বে আছেন। আপনি বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপকের সঙ্গে কথা বলুন।’