রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

মিয়ানমারে বর্বরতা অব্যাহত: ভেসে আসলো ১৯ রোহিঙ্গার নিথর দেহ

প্রকাশিতঃ ৩১ অগাস্ট ২০১৭ | ৬:৫৫ অপরাহ্ন

কক্সবাজার: মিয়ানমারের বর্বরতা থেকে পালিয়ে এসেও প্রাণে বাঁচতে পারছে না রোহিঙ্গারা। বাংলাদেশের মাটিতে একটু ঠাঁই নিতে প্রাণ নিয়ে ছুঁটলেও তাদের ঠাঁই হচ্ছে নিথর দেহটি। এপার ওপার নয়; দু’দেশের মাঝখানের নাফ নদে ভাসছে রোহিঙ্গাদের মৃতদেহ। আর মৃতদেহগুলো মিয়ানমারের তীরে নয়; বাংলাদেশের তীরেই ভেসেই আসছে।

বৃহস্পতিবার ভোরে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে ১৯ জন রোহিঙ্গার মৃতদেহ ভেসে আসে। দ্বীপের পশ্চিম পাড়া থেকে মৃতদেহ গুলো উদ্ধার করা হয়। এদের মধ্যে ১০ জন শিশু ও ৯ জন নারী রয়েছে।

সাবরাং ইউনিয়নের স্থানীয় ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নুরুল আমিন বলেন, বৃহস্পতিবার ভোরে নাফ নদীর শাহপরীরদ্বীপ এলাকার পশ্চিম পাড়া পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ চেষ্টার সময় মিয়ানমার দিক থেকে আসা একটি ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটে। এতে এ ঘটনা ঘটেছে।

তিনি বলেন, স্থানীয়রা সকালে নদীতে বেশ কয়েকটি মৃতদেহ ভাসতে দেখে উদ্ধার করে কূলে নিয়ে আসে। পরে বিষয়টি পুলিশকে অবহিত করা হয়েছে।

টেকনাফ থানার ওসি মাইনউদ্দিন বলেন, নাফ নদীতে বেশ কয়েকটি মৃতদেহ ভাসতে দেখে স্থানীয়রা উদ্ধার করে কূলে নিয়ে আসে। পরে পুলিশকে খবর দিলে সেখানে পৌঁছে মৃতদেহগুলো দেখতে পায়। তারা সবাই মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিক।

ওসি বলেন, কি কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে; তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, মিয়ানমার থেকে অবৈধভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের সময় ট্রলার ডুবে তাদের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে বুধবার সকালে নাফ নদী শাহপরীরদ্বীপ পয়েন্ট থেকে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছিল রোহিঙ্গা ২ নারী ও ২ শিশুর মৃতদেহ।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বুধবার গভীর রাতে মিয়ানমার থেকে ২টি ট্রলারে করে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করে। নাফনদী হয়ে শাহপরীর দ্বীপের পয়েন্টে দিকে রওনা দেয়া তারা। কিন্তু মাঝপথে এসে একটি ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটে। এতে ট্রলারে থাকা রোহিঙ্গারা নাফনদে ডুবে যায়। ভোর থেকে রোহিঙ্গা মৃতদেহ গুলো ভাসতে থাকে। এরমধ্যে ১৯টি মৃতদেহ শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিম পাড়া পয়েন্টে ভেসে আসে। এসময় আরো ২০ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে বলো জানা গেছে।

প্রাণে রক্ষা পাওয়া মিয়ানমার মংডুর বাসিন্দা ওমর হাকিমের ছেলে আয়াতুল্লাহ (২৫) জানান, ট্রলার ডুবির ঘটনায় তার ছেলে আয়াছ ও মেয়ে রুজিনা, মা গোলজার, খালা ও দুই ফুফুসহ তার ১৫ জন স্বজন মারা গেছে। তিনি বলেন, বুধবার গভীর রাতে নাফ নদীতে চারটি ট্রলার দেখতে পায়। প্রতিটি ট্রলারে ৩০ থেকে ৪০ জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু রয়েছে। প্রতিটি ট্রলার বাংলাদেশে ঢুকার চেষ্টা করছিল ।

স্থানীয় আব্দুল আমিন মাঝির সহায়তায় তিনিসহ ৪জন পুরুষ, ৮জন মহিলা ও আটজন শিশুসহ মোট ২০জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারকৃতরা হাঙ্গরপাড়ার আব্দুল মজিদের বাড়ি হতে আশ্রয় নিয়েছে।

এদিকে বুধবার রাতে উখিয়ার বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করানোর দায়ে ১৫ দালালকে আটক করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। আটক দালালদের পুলিশের কাছে তুলে দেওয়া হয়েছে রাতেই।

উখিয়ার থানার ওসি আবুল খায়ের বলেন, সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে কিছু পুরনো রোহিঙ্গা তাদের আতœীয় স্বজনকে এদেশে অনুপ্রবেশ করার সময় বিজিবির হাতে ১৫ আটক হয়। আটককৃতদের মধ্যে ৭ জন পুরুষ, ৬ জন মহিলা ও ২ জন শিশু রয়েছে। পরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে ৭ জন পুরুষকে ৭ দিনের কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। ৬ মহিলাকে ৩০০ টাকা করে জরিমানা আদায় করে দুইশিশু সহ তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানান, মিয়ানমারে সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে। নতুন নতুন গ্রামে হামলা চালাচ্ছে সেদেশের সেনাবাহিনীরা। যে যার মতো করে দিক-বেদিক পালিয়ে যাচ্ছে। এদিকে বৃহস্পতিবার ভোরেও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নের চাকঢালা সীমান্তে (বাংলাদেশ-মিয়ানমার) জিরো পয়েন্টে নতুন করে শত শত রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। জিরো পয়েন্টের পাঁচটি পাহাড়ে অন্তত ২৫ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া সীমান্তের বড়ছনখোলা ভিতরের ছড়া, ছেড়াখালের আগা, আতিকের রাবার বাগান, সাপমারাঝিরি ও নুরুল আলম কোম্পানির রাবার বাগানে রোহিঙ্গারা ঝুপড়ি ঘর তৈরী করে গত শুক্রবার থেকে অনিশ্চিত জীবন পার করছেন। মিয়ানমারের কাঁটাতার বেদ করে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের তালিকাও ঘন্টার পর ঘন্টা দীর্ঘ হচ্ছে। তবে তাঁরা যেন বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে না পাওে সে বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। বিজিবির সদস্যরা আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নজরদারিতে রেখেছেন।

নাইক্ষ্যংছড়িস্থ ৩১ বিজিবির অধিনায়ক লেঃ কর্নেল আনোয়ার আযীম বলেন, ‘রোহিঙ্গারা যাতে আমাদের দেশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সে বিষয়ে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। তারা জিরো পয়েন্টে অবস্থান করছে। পাশাপাশি সীমান্তে সব ধরনে পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিজিবি প্রস্তুত রয়েছে।

অন্যদিকে টেকনাফের লেদা, হ্নীলার হোয়াব্রাং, হোয়াক্যং এর মিনাবাজার, ঝিমংখালী, খারাংখালী ও উখিয়ার বালুখালী, আনঞ্জুমান পাড়া, পালংখালীর রহমতের বিল পয়েন্টে দিয়ে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করছে বলে জানা গেছে। মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় এসব পয়েন্ট দিয়ে কৌশলে রোহিঙ্গারা ঢুকে উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, লেদা ও হ্নীলায় অবস্থান করছে।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার ড. একেএম ইকবাল হোসেন জানান, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে ক্যাম্প গুলো ছাড়াও পুরো কক্সবাজারে নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। নতুন করে কোনো রোহিঙ্গা যাতে বাংলাদেশে অবস্থান করতে না পরে; সে বিষয়ে পুলিশ সজাগ রয়েছে। এতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ে সহযোগিতা করার বিষয়ে অনেক দালালকে আটক করা হয়েছে।

মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গত ২৪ আগষ্ট রাতে রাখাইন রাজ্যে একসঙ্গে ২৪টি পুলিশ ক্যাম্প ও একটি সেনা আবাসে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে।

এরপর ‘সন্ত্রাসীদের’ সঙ্গে দেশটির নিরাপত্তাকর্মীদের সংঘর্ষে প্রায় একশ জন নিহত হন। এরমধ্যে ১২ নিরাপত্তাকর্মী ও বাকিদের ‘সন্ত্রাসী’ বলে দাবি করেছে মিয়ানমারের রাষ্টীয় পরামর্শদাতার কার্যালয়।

গত বছরের ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের সীমান্তে এলাকায় দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের ক্যাম্পে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা এ হামলা চালায় বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য মারা যান। অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুটের ঘটনা ঘটে।