কক্সবাজার : রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো দিন দিন অরক্ষিত হয়ে যাচ্ছে। উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি আশ্রিত শিবিরে তদারকি কমে যাওয়ায় রোহিঙ্গারা নানান কৌশল অবলম্বন করে ক্যাম্প থেকে পালানোর উৎসবে মেতে উঠেছে। কেউ দালালের মাধ্যমে, আবার কেউ ক্যাম্পের বাইরে অবস্থানরত পূর্বের আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে।
রোহিঙ্গাদের আকৃতি, ভাষা, পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ স্থানীয়দের সঙ্গে অনেক মিল। যার কারণেই রোহিঙ্গা পুরুষ, নারী ও শিশুরা সহজেই স্থানীয় জনগণের সঙ্গে মিশে যেতে পারছে। ক্যাম্প ছেড়ে তাদের পালানোর বিষয়টি এখন উদ্বেগজনক। অনেক রোহিঙ্গা গত ৬ বছরের মধ্যে কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন আলোচিত সমালোচিত হত্যাকাণ্ড, অপহরণ, ধর্ষণ, মাদকসহ নানা অপরাধ কর্মকান্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েছেন।
এভাবে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেওয়া ১১ লাখের বেশি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিক নিয়ে সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। শত চেষ্টা করেও গত ছয় বছরে তাদের নিজ দেশে ফেরানো যায়নি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে যত দেরি হচ্ছে ততই বাড়ছে ঝুঁকি।
সব শেষ গতকাল মঙ্গলবার (১৯ সেপ্টেম্বর) শতাধিক রোহিঙ্গাকে উখিয়া-টেকনাফ মহাসড়ক থেকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। উখিয়া ডিগ্রি কলেজ গেট সংলগ্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়। এর আগে সোমবার ৫৫ জন, রোববার ২৯ জন এবং শনিবার ২৯ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে পুলিশ। পরে তাদের নিজ নিজ ক্যাম্প প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
উখিয়া থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ আলী জানান, রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প ছেড়ে বাইরে আসা ঠেকাতে পুলিশ কঠোর নজরদারি শুরু করেছে। অনেকে ক্যাম্প কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই ক্যাম্পের নিরাপত্তা কর্মীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ক্যাম্পের বাইরে বেরিয়ে আসে। এটা ঠেকাতে গত ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে পুলিশ বিশেষ অভিযান শুরু করেছে।
ওসি বলেন, আটক রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ছেড়ে বাইরে আসার বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের তথ্য দিয়েছে। কেউ আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে, কেউ কাজের সন্ধানে, কেউ চিকিৎসার জন্য, কেউ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে বের হয়েছে বলে পুলিশকে জানিয়েছে।
জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি তাদের মধ্যে কারও বিরুদ্ধে অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান ওসি। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদের নিজ নিজ রোহিঙ্গা ক্যাম্প ইনচার্জের কাছে হস্তান্তর করা হয় বলে জানান তিনি।
এদিকে রোহিঙ্গাদের এভাবে ক্যাম্প ছেড়ে বেরিয়ে পড়ায় উদ্বেগ বাড়ছে স্থানীয়দের মধ্যে। কক্সবাজারের উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবীর চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, আমরাই এখন আতঙ্কে থাকি। রোহিঙ্গারা আসার পর এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি হয়েছে। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা চুরি, ডাকাতি, খুন, অপহরণ, মাদকসহ নানা ধরনের অপরাধে যুক্ত। এলাকার অনেক মানুষকে তারা অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করেছে। আমরা সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে বিষয়টি জানিয়েছি। আপাতত রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি।
জানা গেছে, কক্সবাজার শহরের পাহাড়তলী, বার্মাপাড়া, হালিমাপাড়া, ইসলামপুর, বাদশাঘোনা, খাজামঞ্জিল, বৈদ্যঘোনা, সমিতিপাড়াসহ জেলার বিভিন্ন পাহাড় অধু্যষিত বহু এলাকায় বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা এসে ঘরবাড়ি তৈরি করে বসবাস করছে। তাদের চলাচলে কোনো বাধা নেই।
শুধু তাই নয়, স্থানীয় অনেক ছেলে ক্যাম্পে এসে বিয়ে করছে। সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে প্রতিদিন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষদের অনেকে কাজের সন্ধানে ক্যাম্প থেকে বের হন। সন্ধ্যা বা রাতে কেউ ফেরেন, কেউ ফেরেন না। এভাবে পালিয়ে খুন, অপহরণ, মাদকসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছেন অনেক রোহিঙ্গা। কম মজুরিতে পাওয়ায় রোহিঙ্গাদের অনেকে নিজেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, গৃহস্থালী এবং কৃষি, ইটভাটায় স্থায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। আবার অভিযোগ রয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণির সদস্য টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের বাইরে যেতে দিচ্ছে।
রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির নেতা মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে কাজ করার কোনো ধরনের বৈধতা নেই রোহিঙ্গাদের। কারণ, তারা প্রতি সপ্তাহে রেশনসামগ্রী পাচ্ছেন। ক্যাম্পের বাইরে এসে কাজ করলে স্থানীয়দের শ্রমবাজারের জন্য হুমকি তৈরি হচ্ছে।’ ক্যাম্পের বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও রোহিঙ্গা শরণার্থীরা সেটা মানছেন না।’
ক্যাম্পে কাজ করা একটি এনজিও’র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে সীমানায় ঘেরা দিয়ে তার কেটে একাধিক পথ করে তারা বনজঙ্গলসহ বিভিন্ন চোরাপথ দিয়ে সহজে বের হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গারা পালাচ্ছে। হাতেগোনা কিছু দালালের প্ররোচনায় সাগর পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পালানোর চেষ্টা করলেও অধিকাংশ রোহিঙ্গা বিভিন্ন গ্রামে বসবাস গড়ে তুলছে। সেখানে রোহিঙ্গা মেয়েরা প্রথমে কিছুদিন স্থানীয়দের ভাষা রপ্ত করে বসবাস শুরু করে। পরে আচার-আচরণ সবকিছু স্থানীয়দের মতো শিখে ফেলে। এরপর স্থানীয়দের সাথে সখ্য গড়ে কাজের সন্ধানে নেমে পড়ে। অনেকে আবার পাসপোর্ট তৈরি করে উড়াল দেয় বিদেশে।
উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের ৯নং ওয়ার্ড সদস্য (কুতুপালং) হেলাল উদ্দীন বলেন, ‘ক্যাম্প ছেড়ে প্রতিদিন শত শত রোহিঙ্গা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে কৌশলে ক্যাম্প থেকে বের হয়ে কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ছে। এসব রোহিঙ্গাকে নিযন্ত্রণ করা এখন কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্যাম্পে কাঁটাতারের বেড়া ও ক্যাম্পের ভেতরে এবং সড়কের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্তত ১০টি চেকপোস্ট ফাঁকি দিয়ে কীভাবে রোহিঙ্গারা পালিয়ে যাচ্ছে সেটিই ভাবনার বিষয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে রোহিঙ্গারা স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গাদের টাকা উপার্জনের লোভ দেখিয়ে এক শ্রেণির দালাল বাংলাদেশের জাল পাসপোর্ট তৈরি, নাগরিকত্ব প্রদান, বিদেশে বৈধ বা অবৈধভাবে পাচার করছে। প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প পালানোর প্রবণতা প্রতিরোধে আরও কঠোর হতে হবে।’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ বলেন, এত অল্প জায়গায় এত বেশি মানুষ থাকলে নিরাপত্তা সংকট তো হবেই। এখন এই সংকটের সমাধান যেভাবে সম্ভব, সেটা তো হচ্ছে না। ওদের ফেরত পাঠিয়ে দিতে পারলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। এখন সেটা তো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে আমাদের যেটা করা দরকার, সেটা হলো, নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও কঠোর করতে হবে। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যও বাড়াতে হবে। পাশাপাশি মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি অব্যহত রাখতে হবে, যাতে দ্রুত রোহিঙ্গাদের ফেরানো যায়।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে পরবর্তী কয়েক মাস গণহত্যা ও নির্যাতনের মুখে লাখ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিতে থাকে। এর আগেও বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে আসে হাজার হাজার রোহিঙ্গা। সবমিলিয়ে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারে ক্যাম্পগুলোতে অবস্থান করছে।
সর্বাত্মক চেষ্টা করেও গত ছয় বছরে সরকার একজন রোহিঙ্গাকেও নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরাতে পারেনি। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বারবার আশ্বাস দিলেও মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে নানা টালবাহানা করছে। এই অবস্থায় লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে বাংলাদেশ। কক্সবাজারের জনজীবনে কিছুটা চাপ কমাতে এক লাখ রোহিঙ্গা নাগরিককে নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হাতিয়ায় পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে কয়েক দফায় রোহিঙ্গাদের সেখানে স্থানান্তর করা হয়েছে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প ছেড়ে পালানোর বিষয়টি উদ্বেগজনক। ক্যাম্পে সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা দেয়ার পরও অনেক রোহিঙ্গা আরও সচ্ছল জীবনের আশায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে ক্যাম্পের বাইরে যাচ্ছে। এই বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। সবাই সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে এই সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশেষ অনুমতি ছাড়া রোহিঙ্গাদের অবাধ চলাচল বন্ধে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
রোহিঙ্গা শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি সৈয়দ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘নিয়ম ভেঙে ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের বের হওয়ার প্রবণতা অনেক বেড়ে গেছে। তাদের পালানোর বিষয়টি আমরা অত্যন্ত কঠোরভাবে দেখছি।’
তিনি আরও বলেন, স্থানীয় অপরাধী চক্রের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের যোগাযোগ থাকায় জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তবে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ক্যাম্পের ভেতরে তল্লাশিসহ একাধিক চেকপোস্ট সব সময় দায়িত্ব পালন করছে। তাছাড়া ক্যাম্পে গোয়েন্দা নজরদারিসহ টহল পুলিশ সব সময় সতর্ক হয়ে কাজ করছে’