চট্টগ্রাম: একের পর এক নাশকতা, সহিংসতা ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপের কারণে ‘ক্রসফায়ার ঝুঁকি’ পিছু নিয়েছিল আবুল হাশেম বক্করের। যে কোনো সময় ‘ক্রসফায়ারের’ শিকার হতে পারেন সেই আশংকায় আত্মগোপনে অথবা পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছিল তাকে। সার্বক্ষণিক অস্থির, ভীতিকর এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য একটা যুতসই উপায় খুঁজছিলেন তিনি।
একসময় পেয়ে যান সে উপায়। তার মনে হলো, নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদকের মতো পদে বসতে পারলে চিরতরে এই ঝুঁকি কেটে যাবে। বিএনপির মতো বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের শক্তিশালী ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক ক্রসফায়ারের শিকার হলে দেশ কেঁপে উঠবে। তাই যেভাবেই হোক পদটি বাগিয়ে নিতে পারলে বেঁচে যান বক্কর। প্রাণপণ চেষ্টা-তদবিরের পর বক্করের ভাগ্যে জুটলো কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ সাংগঠনিকের পদ। কিন্তু এ পদ পাওয়ার পরও অস্বস্তি কিংবা ক্রসফায়ার ঝুঁকি থেকেই যায়।
এই আশংকার কথা জানিয়ে বিএনপির নোয়াখালী বেল্ট ও দলের শীর্ষ নেতাদের কাছে নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদকের পদটি ভিক্ষা চেয়ে বসেন বক্কর। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, নোয়াখালী অঞ্চলের নেতা বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান শামীমসহ কয়েকজন নেতা বক্করের জীবনঝুঁকির বিষয়টি হাইকমান্ডকে বোঝাতে সক্ষম হন। একই সাথে বক্করকে সাধারণ সম্পাদক করতে হাইকমান্ডে সমর্থন ও সুপারিশ যুক্ত হয় স্থায়ী কমিটির দুই প্রভাবশালী সদস্য মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের। ব্যাস, তাতেই কাজ হয়ে যায়। গত বছরের ৭ আগস্ট ঘোষিত তিন সদস্যের চট্টগ্রাম নগর বিএনপির কমিটিতে আবুল হাশেম বক্কর হয়ে গেলেন সাধারণ সম্পাদক।
বিএনপির নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্র বক্করের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার এই গল্প শুনিয়েছেন একুশে পত্রিকাকে; যে গল্প অবশ্য আগে থেকেই চাউর আছে বিএনপির সচেতন মহলে, এমনকি প্রশাসনেও।
বিএনপির কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, বিএনপির হাই কমান্ডের কাছে গুডবুকে থাকা ডা. শাহাদাত হোসেনকে কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক করে এ এম নাজিম উদ্দিনকে সভাপতি ও আবু সুফিয়ানকে সাধারণ সম্পাদক অথবা আবু সুফিয়ানকে সভাপতি ও সাইফুল আলমকে (ডবলমুরিং) সাধারণ সম্পাদক করে নগর বিএনপির কমিটি সাজাতে চেয়েছিল হাইকমান্ড।
কিন্তু শাহাদাত কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হয়ে ভাবলেন, এই পদে থাকার চেয়ে চট্টগ্রামের সভাপতি হওয়া অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নগর ছেড়ে যাওয়া মানে নগরের আধিপত্য হারানো। পাশাপাশি ভবিষ্যতে জাতীয় ও সিটি নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নের দৌড়ে পিছিয়ে থাকতে হবে নগর কমিটিতে থাকতে না পারলে।
‘এক দল, এক পদ’ নীতি চালু থাকায় ডা. শাহাদাত কেন্দ্রীয় পথ ছেড়ে নগরে থাকতে দেনদরবার শুরু করলে সুফিয়ানকে সভাপতি ও শাহদাতকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি ঘোষণার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে হাইকমান্ড।
কিন্তু বিষয়টি বুঝতে পেরে বেঁকে বসেন শাহাদাত। কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের প্রটোকল অনুযায়ী নগর বিএনপির সম্পাদকের পদটি বেমানান। বিষয়টি হাইকমান্ডকে বোঝাতে সক্ষম হন শাহাদাত। এক্ষেত্রে শাহাদাত সভাপতি আর আবু সুফিয়ানকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি গঠনের বিষয়টি হাইকমান্ডের ভাবনায় চলে আসে। রাজনীতিতে অপেক্ষাকৃত জুনিয়র ডা. শাহাদাতের অধীনে সাধারণ সম্পাদক হবেন কিনা তা ভাবতে ভাবতে একমাস পার করে দেন সুফিয়ান। সাধারণ সম্পাদক হওয়ার জন্য অবশেষে মনস্থির করে ঢাকায় গিয়ে সুফিয়ান দেখতে পান ততক্ষণে দৃশ্যপট অনেকখানি পাল্টে গেছে। তখন হাইকমান্ডের সামনে চলে আসে এক এগারোর সময় সুফিয়ানের বিদেশে পালিয়ে যাবার বিষয়টি। যদিও এই অপবাদ থাকার পরও স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে দিব্যি আসীন আছেন অনেকে। আর এই ইস্যুতে সাধারণ সম্পাদক থেকে ছিটকে পড়া আবু সুফিয়ানের জায়গা হয় সিনিয়র সহ সভাপতি পদে।
আর এ সু্যোগে পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসেন বক্কর। আর এক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রাখেন স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান (নোয়াখালী)। তারা হাইকমান্ডকে বুঝিয়েছেন সরকারবিরোধী আন্দোলনে বক্কর দলের জন্য ঝুঁকি নিয়ে এখন জীবনের ঝুঁকিতে আছেন।
তবে এই পন্থায় নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন আবুল হাশেম বক্কর; তিনি বলেন, ‘এগুলো ফালতু কথা। আমি উড়ে এসে জুড়ে বসা কেউ নই। তৃণমূল থেকে রাজনীতি করে আজকের অবস্থায় এসেছি। রাজনীতিই আমার ধ্যান-জ্ঞান। রাজনীতির বাইরে জীবনে আর কিছু ভাবতে পারিনি। নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদকের পদটি আমার ত্যাগ ও যোগ্য নেতৃত্বের ফসল। আর আমার বিরুদ্ধে দায়ের করা সবগুলো মামলাই রাজনৈতিক। রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে না পেরে আমার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দেয়া হয়েছে। এর বাইরে আমার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ও অস্ত্রের অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত। কাজেই রাজনীতির আপাদমস্তক একজন কর্মীকে নিয়ে এধরণের চিন্তা করাও হাস্যকর।’
এদিকে একবছর পেরিয়ে গেলেও চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির কমিটি নিয়ে মাঠ পর্যায়ে আলোচনা-সমালোচনা বন্ধ হচ্ছে না। বিশেষ করে আবুল হাশেম বক্করকে সাধারণ সম্পাদক করা নিয়ে চলছে অসন্তোষ। তিনি এই পদের যোগ্য কিনা সেই প্রশ্নও তুলেছেন অনেকে। এই প্রশ্নের অন্যতম কারণ হচ্ছে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা। আবুল হাশেম বক্কর মাধ্যমিক শিক্ষার গন্ডি পার হননি বলে রাজনীতির মাঠে প্রচলিত আছে। এছাড়া দলীয় সূত্রমতে, তিনি প্রায় ৮টি মামলারও আসামি।
একুশে পত্রিকার অনুসন্ধানে তার চারটি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। এগুলো হলো চান্দগাঁও থানার এফআইআর নং ৩১/৬৪, তারিখ ২৬/০২/১৫, ধারা ৩/৬ ১৯০৮ সালের বিস্ফোরক দ্রব্য আইন ততসহ ৩২৬/৩০৭/৩০২/১০১/৩৪ পেনাল কোড ১৮৬০, এজাহারে অভিযুক্ত। কোতোয়ালী থানার এফ আই আর নং ২১, তারিখ : ১০/২/১৫, ১৪৩/১৪৭/১৪৮/১৪৯/৩২৩/৪২৭ পেনাল কোড ১৮৬০ ততসহ ১৫ (৩) ১৯৭৪ সালের বিশেষ আইন; এজাহারভুক্ত। কোতোয়ালী থানার এফআইআর নং ০৮, ৭/২/১৫, ১৯০৮ সালের বিস্ফোরক দ্রব্য আইন, ততসহ ১৪৩/১৪৭/১৪৮/১৪৯/১৮৬/৩২৩/৩৫৩/৪২৭ পেনাল কোড ১৮৬০; ততসহ ১৫ (৩) ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন; এজাহারভুক্ত।
এর মধ্যে চান্দগাঁও থানার মামলা ছাড়াও নগরের তুলাতলিতে গাড়ি পোড়ানোর বাকলিয়া থানার মামলায় ২৯ নম্বর আসামী বক্কর শুরু থেকে পলাতক। বর্তমানে মামলাটি অতিরিক্ত মহানগর দায়রাজজ ৪র্থ আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে। এ মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে। মামলাটির পরবর্তী ধার্য্যদিন আগামী ২০ সেপ্টেম্বর।
এদিকে ২ টি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা কাধে নিয়ে আবুল হাশেম বক্কর প্রকাশ্য মিছিল-মিটিং করে বেড়ালেও রহস্যজনক কারণে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা তাকে গ্রেফতার করছে না।
জানতে চাইলে নিজের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকার কথা স্বীকার করে আবুল হাশেম বক্কর বলেন, ‘আমি জামিন নিয়ে নেব।’
কেন নিচ্ছেন না, যে কোনো সময় তো গ্রেফতার হতে পারেন- এমন প্রশ্নে বক্কর বলেন, ‘ভাই বুঝেন তো আদালতের অবস্থা!’
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) এস এম মোস্তাইন হোসেন বলেন, ‘কারো বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু করে আদালত। সেই ওয়ারেন্ট থানায় না এসে আদালতে কোনো কারণে থেকে গেলে পুলিশের কিছুই করার থাকে না। আবুল হাশেম বক্করের বিরুদ্ধে কোনো ওয়ারেন্ট সংশ্লিষ্ট থানায় আছে কিনা তা আমরা খতিয়ে দেখছি। আবুল হাশেম বক্করের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট থাকলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
পুলিশের তালিকায় আবুল হাশেম বক্করের নামের পাশে ত্রাস/সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী হিসেবে উল্লেখ আছে। র্যাবের খাতায়ও তিনি সন্ত্রাসী ত্রাস সৃষ্টিকারী। ২০১৩ সালের ১৩ নভেম্বর নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগে এনায়েত বাজার এলাকা থেকে বক্করকে গ্রেফতার করে র্যাব। কয়েকমাস কারাভোগের পর জামিনে এসে বক্কর আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেন। জন্ম দিতে থাকেন একের পর এক ভয়ংকর অপরাধের।
বক্করের পরিকল্পনায় ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ দিবাগত রাতে টাইগার পাস মোড়ে যাত্রীবাহী বাসে ছুড়ে মারা হয় পেট্রোল বোমা। এতে সুভাষ সোম নামের ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তি দগ্ধ হয়ে মারা যান। ব্যবসায়ী সুভাষ বাসটির যাত্রী ছিলেন। আহত হন বাসের আরো ৮ যাত্রী। বাসে বোমা ছুড়ে মারতে নগর ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক আলী মুর্তুজাকে ২০ হাজার টাকা দেন বক্কর। ঘটনার একমাস পর কোতোয়ালী থানা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান চৌধুরী শপথ। আবুল হাশেম বক্করের পরিকল্পনায় বাসে পেট্রোল বোমা মারার পরিকল্পনার বিষয়টি পুলিশের কাছে ফাঁস করে দেন শপথ। তখন ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রহমত আলীর আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও দেন সাবেক এ ছাত্রদল নেতা। ফেনীর পরশুরাম থানার গুদুমা আনসার চৌধুরী বাড়ির শায়েস্তা চৌধুরীর ছেলে শপথ ৯২-৯৩ সেশনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
যুবদলের রাজনীতির সাথে জড়িত দাবি করে আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে শপথ বলেন, গত ১১ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় যুবদলের সহ-সভাপতি আবুল হাশেম বক্কর মোবাইলে ফোন করে বলেন, হরতাল-অবরোধে এশিয়ান হাইওয়ের আগ্রাবাদ, টাইগার পাস, বিআরটিসি অংশে প্রচুর গাড়ি চলে। এসব বাস চলাচল বন্ধের ব্যবস্থা করতে হবে। দুদিন পর ১৩ ফেব্রুয়ারি সিআরবি সাত রাস্তার মোড়ে রেলওয়ে অফিসের পাশে একটি চায়ের দোকানে লালখান বাজার এলাকার ছাত্রদল নেতা হাড্ডি স্বপন, নগর যুবদল নেতা শামসুল হক, নগর ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক আলী মুর্তুজাসহ বৈঠক করি। এশিয়ান হাইওয়েতে গাড়ি চলাচল বন্ধের পরিকল্পনার বিষয়ে আলোচনা হয় বৈঠকে। আলী মুর্তুজা নাশকতার মাধ্যমে গাড়ি চলাচল বন্ধের দায়িত্ব নেন। নাশকতার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে বক্কর আমাকে ২০ হাজার টাকা দেন। ঐ টাকা রাতে মুর্তুজাকে দিয়ে পরদিন সকালে আমি বাড়িতে চলে যাই। ১৯ ফেব্রুয়ারি টিভি দেখে জানতে পারি, টাইগারপাস এলাকায় বাসে পেট্রোল বোমা হামলা হয়েছে। মুর্তুজার সাথে যোগাযোগ করলে জানতে পারি, বৈঠকের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হয়েছে। সাইফুর রহমান শপথের দাবি, তিনি মূলত আবুল হাশেম বক্করের নির্দেশ পালন করেছেন।
এছাড়া বাকলিয়ার তুলাতলিতে পেট্রোল বোমা ছুড়ে বাস পোড়ানোর পরিকল্পনা করেন আবুল হাশেম বক্কর ও বিএনপি নেতা শওকত আজম খাজা। সে অনুযায়ী, ১১ জানুয়ারি ১৫ রাত পৌনে আটটায় বাকলিয়ায় পেট্রোল বোমা মেরে হানিফ পরিবহনের একটি বাস পোড়ানো হয়। ঘটনার কয়েকদিন পর রাজাখালি এলাকা থেকে যুবদল নেতা মো. ইদ্রিসকে আটক করে বাকলিয়া থানা পুলিশ। মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ মাশফিকুল ইসলামের আদালতে দেয়া তার জবাবন্দিতে ফাঁস হয়ে পড়ে নাশকতার পরিকল্পনাকারী বক্কর ও খাজার নাম।
জবানবন্দিতে কালামিয়া বাজারের হাজি নুর মোহাম্মদের ছেলে যুবদল নেতা ইদ্রিস আলম বলেন, ‘আমি ৩৫ নং ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি। যুবদল নেতা আবুল হাশেম বক্করের সাথে রাজনীতি করি। গত ৫ জানুয়ারির দুই একদিন পর আবুল হাশেম বক্কর ও খাজা আমাকে বলেন, দলীয় লোকজন নিয়ে নতুন ব্রিজ বিশ্ব রোডের উপর গাড়িতে আগুন দিতে হবে। বক্করের অনুসারী সাইফুল ইসলাম সিফাতের সাথে যোগাযোগ করে গাড়ি পোড়ানোর টাকাও নিতে বলেন। বক্সিরহাট ওয়ার্ড যুবদলের সেক্রেটারি আমিরুল ইসলাম সাজু ও সাংগঠনিক সম্পাদক দিদারুল আলম দিদারকে নিয়ে গত ৯ জানুয়ারি ১৫ রাজাখালি ফায়ার সার্ভিস এলাকায় পেট্রোল বোমা ছুড়ে গাড়ি পোড়ানোর বিষয়ে পরিকল্পনা করি। বৈঠকের পর বিষয়টি নিয়ে আমার বন্ধু নাছিরের সাথে পরামর্শ করি। নাছির আমাকে মিয়াখান নগরের হোসেনের সাথে পরিচয় করে দেয়। নাছির ১০ জানুয়ারি হোসেন ও আরো এক ব্যক্তিকে নিয়ে রাজাখালি ফায়ার সার্ভিস এলাকায় আমার সাথে দেখা করে। সিদ্ধান্ত হয় খালপাড়ের তুলাতলি ব্রিজের উপর গাড়িতে আগুন দেয়া হবে।’
ইদ্রিস তার জবানবন্দিতে বলেন, ‘গাড়ি পোড়ানোর বিনিময়ে হোসেন ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা দাবি করে। পরবর্তীতে ১০ হাজার টাকায় রাজি হয়। হোসেনকে অগ্রিম ৭শ টাকা দেয়া হয়। বিষয়টি বক্কর ও খাজাকে জানাই। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী গাড়ি পোড়ানোর জন্য হোসেনকে দেয়া ১০ হাজার টাকার মধ্যে আমি দিই ৫ হাজার, বাকী ৫ হাজার দেন নগর ছাত্রদল নেতা সাইফুল ইসলাম সিফাত। ১১ জানুয়ারি হোসেন তার সহযোগী সাহাবুদ্দিন, রনি ও হানিফকে নিয়ে তুলাতলি ব্রিজে এসে আমাকে ফোন দেয়। আমি সাজু ও দিদারকে পেট্রোল বোমা নিয়ে ব্রিজে যেতে বলি। রাত আনুমানিক পৌনে আটটার সময় বহদ্দারহাট থেকে আসা হানিফ পরিবহনের একটি বাস ব্রিজে পৌঁছালে হোসেন, সাহাবুদ্দিন, হানিফ ও রনি গাড়িটিতে পেট্রোল বোমা ছুড়ে মারে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। এসময় সাজু ও দিদারসহ আরো বেশ কয়েকজন দলীয় লোক মোটরসাইকেল নিয়ে ঘটনাস্থলের আশেপাশে ছিল। ঘটনার পর সাজু আমাকে ফোন করে বিস্তারিত জানালে বিষয়টি সাথে সাথে আমি বক্কর ও খাজাকে জানাই।’
ইদ্রিস বলেন, ‘ঘটনার পর হোসেন, হানিফসহ আরো কয়েকজন পুলিশের হাতে ধরা পড়লে আমি এলাকা থেকে পালিয়ে যাই।’
এদিকে চলতি বছরের মার্চ মাসে নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম বক্করসহ ২১ জনকে তালিকাভুক্ত অস্ত্র ব্যবসায়ী উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশকে চিঠি দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে তৈরি করা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাঠানো তালিকায় বিএনপি, জামায়াত নেতাকর্মী ছাড়াও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীরা আছেন। তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় অস্ত্র ব্যবসায় জড়িত বলে পুলিশ সূত্র জানায়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক শাখার উপসচিব স্বাক্ষরিত পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, কর্ণফুলী নদীর পাশাপাশি কক্সবাজার ও ফেনী সীমান্ত এলাকা দিয়ে অস্ত্র ব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসীরা অস্ত্র সংগ্রহ করছে। এছাড়া চট্টগ্রাম-কক্সবাজার, ঢাকা-চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি-কাপ্তাই, রাঙ্গুনিয়া-চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি-ফটিকছড়ি, বাঁশখালী-আনোয়ারা, রামগড়-হেঁয়াকো-বারৈয়ার হাট ও চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকা অস্ত্রের রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যেসব অস্ত্র আসছে এর মধ্যে রয়েছে- পিস্তল, কাটা বন্দুক ও দেশীয় এলজি। আর এক্ষেত্রে আবুল হাশেম বক্করকে মোস্ট ওয়ান্টেড দেখিয়ে তিনি সহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়। কিন্তু গত ৬ মাসেও এই সুপারিশ আমলে নিচ্ছে না সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থা।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) সালেহ মোহাম্মদ তানভীর একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আবুল হাশেম বক্করের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট থাকার বিষয় আমার জানা ছিল না। এ ব্যাপারে আমরা খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।’