এম কে মনির : আহম্মেদুর রহমান (৫৫)। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের মান্দারীটোলা গ্রামের মৃত আবু তাহেরের ছেলে। সম্পত্তি বলতে তার রয়েছে একটি একতলা পাকা বাড়ি, পৈতৃক কয়েকটি আধাপাকা দোকান আর নগদ ৪২ লাখ টাকার ব্যাংক এফডিআর।
বড় ধরণের তেমন কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কিংবা জমিজমা না থাকলেও তিনি একাই হয়েছেন জনতা ব্যাংক বাড়বকুণ্ড শাখার ৩৩ জন ঋণগ্রহীতার কোটি টাকার জামিনদার৷ যেন ব্যাংকঋণ নিয়ে দেওয়া তার দায়িত্ব বা পেশা! তবে ঋণ গ্রহীতাদের দাবি, এসব ঋণের টাকা তারা চোখেও দেখেননি। ১ হাজার করে মাত্র ৩৩ হাজার টাকার বিনিময়ে ৩৩ জনকে বোকা বানিয়ে অন্তত এক কোটি টাকা ঋণ হাতিয়ে নিয়েছেন আহম্মেদুর রহমান।
২ বছর আগে জনতা ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এ কারবার ঘটেছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগী ও স্থানীয়দের।
তবে সম্প্রতি মান্দারীটোলা গ্রামের ৩৩ জন নারী ও পুরুষ জনতা ব্যাংক বাড়বকুণ্ড শাখা থেকে ঋণ পরিশোধের নোটিশ পেলে বিষয়টি সামনে আসে। এরপরই এ নিয়ে এলাকায় ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। কেননা যাদের নামে নোটিশ ইস্যু করা হয়েছে তারা জানেনই না যে তারা ব্যাংকে ঋণখেলাপির তালিকায় যুক্ত হয়েছেন এবং তাদের নামে ১ থেকে দেড় লাখ টাকার অপরিশোধিত ঋণ রয়েছে।
এমনকি কোনো কোনো পরিবারের ৫-৬ জন সদস্যও রয়েছেন খেলাপি ঋণের তালিকায়। তারা প্রত্যেকেই এখন নোটিশ হাতে নিয়ে ঘুরছেন নানা জনের দ্বারে দ্বারে। জানাচ্ছেন শঙ্কার কথা, গ্রেপ্তার-ভীতির কথা। কেননা নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে নোটিশ প্রাপ্তির ১৫ দিনের মধ্যে ঋণের সমুদয় অর্থ সুদে আসলে পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দা, রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি, গণমান্য ব্যক্তিবর্গ সকলের প্রশ্ন একটাই- কীভাবে, কীসের ভিত্তিতে একজন সাধারণ ব্যক্তি আহম্মেদুর রহমানকে ৩৩ জন ব্যক্তির ঋণের জামিনদার করলেন জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তারা?
সচেতন মহল, একাধিক বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা ও স্থানীয়রা এ ঘটনাকে অস্বাভাবিক, সন্দেহজনক ও অসঙ্গতিপূর্ণ আখ্যা দিলেও তা মানতে নারাজ জনতা ব্যাংক বাড়বকুণ্ড শাখার বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, আহম্মেদুর রহমানের বিশাল অঙ্কের এফডিআর জনতা ব্যাংকের ঐ শাখায় জমা আছে। আর এই এফডিআরে ভর করেই তাকে ৩৩ জনের জামিনদার করা হয়েছে। তাছাড়া অপরিশোধিত খেলাপি ঋণগুলো কোনোমতেই অনিরাপদ নয়।
সাধারণত ব্যাংকিং ঋণের বেলায় যেকোনো ঋণগ্রহীতার জন্য একজন জামিনদারের প্রয়োজন হয়। ঋণগ্রহীতার ঋণ পরিশোধের সক্ষমতার পাশাপাশি জামিনদার রাখা ব্যাংকের অন্যতম শর্ত। আর ব্যাংক সবসময় চায় ঋণগ্রহীতার জামিনদাতা সম্পদশালী কিংবা বিত্তবান হোক। যেন ঋণগ্রহীতা ভবিষ্যতে কোনো কারণে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে তার কাছ থেকে আদায় করা যায়। কিন্তু একজন আহম্মেদুর রহমানই হয়েছেন ৩৩ জন ঋণগ্রহীতার জামিনদার। যা কেবল অস্বাভাবিকই নয়, অবিশ্বাস্যও বটে।
অভিযোগ, জনতা ব্যাংক বাড়বকুণ্ড শাখার সিনিয়র অফিসার মো. আব্দুল্লাহ ও সাবেক ব্যবস্থাপক ইমতিয়াজুল ইসলামের যোগসাজশে এ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তারা চেয়েছেন বলেই আহম্মেদুর রহমান ৩৩ জনের জামিনদার হতে পেরেছেন। তারা যদি এক্ষেত্রে আপত্তি জানাতেন আহম্মেদুর রহমানের পক্ষে ৩৩ জনের জামিনদার হওয়া কখনোই সম্ভব হতো না। তারা দুজন অনৈতিক সুবিধা নিয়েই আহম্মেদুর রহমানকে এ সুযোগ করে দিয়েছেন।
নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘ব্যাংকঋণে এটি খুব অস্বাভাবিক ঘটনা৷ সাধারণত এরকম হয় না। একজনকে কীভাবে ৩৩ জনের জামিনদার করা হলো আমার মাথায় ধরে না। হোক সে বিত্তবান। তবুও এরকম করা হয় না। বিষয়টি সন্দেহজনক।’
ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, ২০২১ সালের শুরুতে করোনাকালে সরকার গরীব-দুঃখীদের আর্থিক প্রণোদনা দিচ্ছে বলে কৌশলে নিজ গ্রামের প্রতিবেশীদের জনতা ব্যাংক বাড়বকুণ্ড শাখায় নিয়ে যান আহম্মেদুর রহমান। সেসময় তাদেরকে বলা হয়েছিল, একটি করে সঞ্চয়ী হিসাব খুললেই পাওয়া যাবে নগদ ১ হাজার টাকা। স্বাভাবিকভাবে করোনাকালে অভাব-অনটন কাজ হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন অনেকে। এর মধ্যে পড়াশোনা না জানা কিংবা স্বশিক্ষিত মানুষজনকে টার্গেট করেন আহম্মেদুর রহমান। সেসময় তারা বুঝতেই পারেননি যে জনতা ব্যাংক তাদের কাছ থেকে ঋণের সব কার্যক্রমের ফাইল ও খালি চেকে স্বাক্ষর নিয়ে ফেলা হয়েছে, শুধুমাত্র ১ হাজার টাকার প্রণোদনার কথা বলে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আহম্মেদুর রহমান ১৬ আগস্ট সকালে একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি তাদের জামিনদার হয়েছি, এটা সত্য। তবে টাকা আমি নিইনি।’ তবে কেন এতজনের জামিনদার হয়েছেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি তাদের ভালোর জন্য হয়েছি। তাদের উপকারের কথা চিন্তা করেই হয়েছি। এখন আমি ফেঁসে যাচ্ছি।’
যদিও আগের দিন ১৫ আগস্ট আহম্মেদুর রহমান এ প্রতিবেদককে বলেছিলেন, তিনি কাউকেই ব্যাংকে নিয়ে যাননি, সবাই তার বিরুদ্ধে মিথ্যা বলেছেন। তবে পৃথক বক্তব্যে আহম্মেদুর রহমান জানান, চাঁদপুরের মুকসদুর রহমান সুমন নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে তিনি চালের আড়ৎ দিয়েছিলেন। সেই ব্যক্তি তাকে দিয়ে অনেক ঋণ নিয়েছেন এবং কয়েক বছর ব্যবসা করার পর সুমন সব পুঁজি নিয়ে পালিয়ে যান। কিন্তু অসুস্থতার কারণে আহম্মেদুর রহমান তাকে খুঁজে বের করতে পারেননি। ব্যাংকে আপনার কত টাকা এফডিআর আছে এবং এই টাকার উৎস কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি ২ একর জমি বিক্রি করেছি। এগুলো জমি বিক্রির টাকা।’
তবে আহম্মেদুর রহমানের এসব বক্তব্য মিথ্যা ও বানোয়াট বলে দাবি করেছেন ভুক্তভোগীরা। ভুক্তভোগী মো. ফয়জুল্লাহ বলেন, ‘আমার পরিবারের ৫ জনের নামে মোট ১২ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন আহম্মেদুর রহমান। ৩৩ জনকে দিয়ে ঋণ নিয়ে আহম্মেদুর বাড়বকুণ্ড বাজারে ২০ লাখ টাকায় জমি কিনেছেন এবং বাড়ি বানিয়েছেন।’ তার এ কথার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন উপস্থিত ৩৩ জন ভুক্তভোগী ও গ্রামবাসী।
কীভাবে, কীসের ভিত্তিতে আহম্মেদুর রহমানকে ৩৩ জন ঋণগ্রহীতার জামিনদার করা হয়েছে তা জানতে চাইলে জনতা ব্যাংক বাড়বকুণ্ড শাখার ব্যবস্থাপক মিঠুন ঘোষের দপ্তরে গেলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। এমনকি সৌজন্যতাবোধও দেখাননি। পরে তিনি আগের দিন একুশে পত্রিকার অনলাইনে ‘ঋণ না নিয়েও জনতা ব্যাংকে ঋণখেলাপি কৃষকেরা, নেপথ্যে কারা?’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদের বিষয়ে নাখোশ হওয়ার কথা অন্য এক গণমাধ্যমকর্মীর কাছে প্রকাশ করেন।
এ বিষয়ে জনতা ব্যাংক বাড়বকুণ্ড শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক ও বর্তমানে লালদীঘি শাখার এডভান্সড অফিসার ইমতিয়াজুল ইসলাম বলেন, ‘তার (আহম্মেদুর রহমান) ৪০-৪২ লাখ টাকার এফডিআর জমা ছিল। কৃষি ঋণে কোনো মটগেজ প্রয়োজন হয় না।’ এসময় তিনি আরও বলেন, ‘আমি যতটুকু জেনেছি আহম্মেদুর রহমানের সঙ্গে ব্যাংকের কথা হয়েছে। তিনি কয়েকদিনের মধ্যে সবগুলো খেলাপি ঋণ মিমাংসা করে দেবেন। তিনি তার আত্মীয়স্বজনদের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে এসব ঋণ নিয়েছিলেন।’ তবে আহম্মেদুর রহমানের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা আদায়ের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি।
যদিও আগের দিন জনতা ব্যাংক বাড়বকুণ্ড শাখায় ঋণ বিতরণের দায়িত্বে থাকা সিনিয়র অফিসার মো. আব্দুল্লাহ স্বীকার করেছিলেন, ঋণগ্রহীতাদের ঋণের টাকা জামিনদার আহম্মেদুর রহমানই গ্রহণ করেছেন। ঋণগ্রহীতারা গ্রহণ করেননি। যা তিনি আগে থেকেই অবগত ছিলেন। এমন অনিয়ম সম্পর্কে জেনেও কেন চুপ ছিলেন জানতে চাইলে আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আপনার টাকা আপনি অন্যজনকে দিয়ে দিলে তাতে আমার কী করার আছে?’