সমাজের শুদ্ধ বিবেক আজাদ তালুকদার


এনায়েতুর রহিম : সাংবাদিক ও গবেষক আজাদ তালুকদার ছিলেন সমাজের শুদ্ধ বিবেক। তিনি এত দ্রুত চলে যাবেন, ভাবিনি। যে অনিবার্য যাত্রাপথ আজাদ তৈরি করে গেছেন, তা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। রাষ্ট্র ও সমাজের অনেক দায় আছে এ মানুষটার প্রতি। কারণ সমাজ পরিবর্তনে কলম সৈনিক হিসেবে এক লড়াকু সাহসী লেখক ছিলেন তিনি।

আজাদ তালুকদার চট্টগ্রাম তথা রাঙ্গুনিয়া উপজেলার কৃতি সন্তান ছিলেন। তিনি ভয়কে জয় করে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার কারণে জীবিতকালে অনেকেই তাঁকে ঈর্ষা করেছেন। তাঁর অসুস্থতার কথা শুনে কিছু মানুষ হয়তো খুশি হয়েছেন। মনে করেছেন, পথের কাঁটা সরে গেল! কিন্তু আল্লাহর বিচার থেকে কেউই রেহাই পাবেন না।

আজাদ বয়সে আমার সাত বছরের ছোট। তবুও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের বয়স দুই দশক হবে। ১৯৯৬ সালে ১৫ আগস্ট পাক্ষিক রুপালী রাঙ্গুনিয়া পত্রিকার অনুমোদন নিয়ে সম্পাদক হিসেবে আমার যাত্রা শুরু। তখন আজাদের সাথে পত্রমিতালি শুরু হয়। আজাদ তখন চিত্রবাংলার প্রতিনিধি ছিলেন। একুশে পত্রিকার জন্ম তখনও হয়নি।

রুপালী রাঙ্গুনিয়া পত্রিকাটি আজাদের চেরাগি পাহাড়স্থ অফিস থেকে ম্যাগাজিন আকারে সম্পাদনা ও প্রকাশ করতাম। সেই সূত্র ধরে অনেক কৃতি সাংবাদিকের সাথে আমার পরিচয় হয়।

ভোর সকালে কর্ণফুলী নদী পাড়ি দেওয়ার সময় ইঞ্জিন চালিত বোটে আজাদের সাথে আমার দেখা হত। আজাদ কর্ণফুলী নদীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, রূপ উপভোগ করতেন। তুখোড় আড্ডাবাজ ছিলেন আজাদ। বড়শি দিয়ে মাছ ধরা তাঁর নেশা ছিল। সঙ্গীত সাধনায় নিজেকে মনোনিবেশ করতেন। ছিলেন পরোপকারী এবং মাঝে মাঝে বাউন্ডুলে হয়ে ঘুরে বেড়াতেন।

মেধা, বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে আজাদ এত দূর এসেছেন। তিনি যে ব্যতিক্রম ও রুচিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন তা দায়িত্ববান মানুষেরাও উপলব্ধি করেছেন। আজাদ নগণ্য সংবাদকে জাতীয় সংবাদে রূপায়ন করে রাষ্ট্রের মনোযোগ আর্কষণ করতে পারতেন। এটাই আজাদের সাংবাদিকতার বৈশিষ্ট্য।

নতজানু সাংবাদিকতার বিপরীতে আজাদ কারও সাথে আপস করেননি। আমি একাধিকবার ফোন করে একটি সিরিজ নিউজ বন্ধ করার চেষ্টা করেও পারিনি। আজাদের সফলতা থেকে একজন মুক্তমনা সাংবাদিকের শেখার অনেক কিছু আছে। তাঁকে অনেক সংবাদ তৈরি করতে পরামর্শ দিয়েছি। আজাদ সফলভাবে সেই নিউজ করেছে। অবহেলা বা পরাজয় নামক শব্দ আজাদের অভিধানে নেই।

আজাদের বাবা ছিলেন একজন আদর্শ ইংরেজি শিক্ষক এবং তুখোড় মেধাবী। আজাদও তাঁর ব্যতিক্রম নয়।

আজাদকে বাঁচাতে পরোক্ষভাবে অনেক তথ্য দিয়েছি। তাঁকে মুম্বাই টাটাতে যেতে বলেছি। আজাদ শুনেনি। পরে যখন মুম্বাই গেলেন, কথা হলো গাইড আকরাম শেখসহ আজাদের সাথে।

ফোনে আজাদকে আমার কান্সার জয় করার তিন বছরের ইতিবৃত্ত তুলে ধরি। আমি আধ্যাত্মবাদের পথে হেঁটে হেঁটে ব্লাড ক্যান্সারকে জয় করেছিলাম। তিনটি বছর আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। লোকচক্ষু থেকে আড়ালে চলে যাই। মহান আল্লাহর রহমতে নতুন জীবন ফিরে পাই।

তখনই কতিপয় সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতা আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতি অভিযোগ এনে ও ভণ্ড পীরের আলামতের অস্তিত্ব খুঁজে আমার চরিত্র হননের চেষ্টা করেছেন। আমাদের দুইজনের শত্রু এক এবং অভিন্ন ছিল। আমি শত্রুের তালিকা থেকে এদের বাদ দিলেও আল্লাহর দরবার থেকে তারা রেহাই পাবেন না।

আজাদকে নিয়ে মাননীয় তথ্যমন্ত্রীর ছোট ভাই এরশাদ মাহমুদের একটি বক্তব্য আমার ভালো লেগেছে। তিনি গত ২ আগস্ট পদুয়ায় আজাদের জানাজায় বলেছেন, ‘আজাদ নামে একটি নক্ষত্রের পতন হয়েছে। বেঁচে থাকলে এই নক্ষত্র সমাজে আরও আলো ছড়াত। আরও অনেক কিছু জাতি নিতে পারতো। কিন্ত আজাদ অকালেই ঝরে গেছে। আমি তাঁর ছেলের মধ্যেই সেই মেধা খুঁজতে চাই। মহান রবের কাছে সেই প্রত্যাশাই করি।’

এরশাদ ভাই আজাদের মেধাবী সত্ত্বা অনেক আগেই উপলব্ধি করেছেন। সত্যিই অপেক্ষাকৃত কম বয়সে আজাদ আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আমাদের সামনে রেখে গেলেন এক অনুকরণীয় জীবনের বর্ণাঢ্য কর্মময় আখ্যান।

পরপারে ভালো থাকবেন আজাদ। মহান আল্লাহ আপনাকে জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করুক। আমিন।

লেখক : সাংবাদিক ও পরিবেশবিদ।