অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান : ছোটগল্প সম্পর্কে বহুল প্রচলিত লাইনগুলো রবীন্দ্রনাথের—‘অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্গ করি মনে হবে, শেষ হইয়াও হইল না শেষ।’ এর সঙ্গে আমাদের অনুভবে ও চেতনায় বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতির অপূর্ব মিল দেখতে পাই। বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির জন্য দীর্ঘ সংগ্রাম করেছেন। তার নেতৃত্বে বাঙালির নিজের রাষ্ট্র গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
‘যুদ্ধের ছাই-ভস্ম থেকে সমৃদ্ধির পথে’-বাংলাদেশের অনন্য অভিযাত্রাসর সূচনাও তার হাত ধরেই। অপশক্তির চক্রান্তে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ তিনি শহীদ হয়েছেন ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট। কিন্তু এখানেই বঙ্গবন্ধু শেষ হয়ে যাননি। আমাদের চিন্তায় ও চেতনায় জাগরূক থেকেছেন।
কার সাধ্যি এই অমরাত্মার সমাপ্তি টানার। এমনি অক্ষয় অম্লান ‘ধন্য এই পুরুষ’ যে ‘… যার নামের উপর / কখনো ধুলো জমতে দেয়না হাওয়া / … যার নামের উপর পাখা মেলে দেয় / জ্যোৎস্নার সারস।’ (শামসুর রাহমান)। তাই তো ‘…তার নামের উপর পতাকার মতো / দুলতে থাকে স্বাধীনতা’ (ঐ)।
বহু সংগ্রাম আর তিতিক্ষার পর আমরা আবার তার দেখানো পথেই ফিরেছি। ফিরতে পেরে আমরা নিশ্চয় আপ্লুত। তবু ঐ ‘অন্তরে অতৃপ্তি’ তো রয়েছেই। বারবার মনে হয় যদি বঙ্গবন্ধুকে ওই শোকের আগস্টে হারিয়ে না ফেলতাম তাহলে হয়তো আজ আরও অনন্য উচ্চতায় থাকতো তার প্রিয় বাংলাদেশ। এই অতৃপ্তিটুকু তো থেকেই যাবে।
বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলা’ করে তোলার অভিযাত্রায় আমাদের তাগিদ হিসেবেও কাজ করবে এই অতৃপ্তি। তাই বঙ্গবন্ধুকে তুলনা করা যায় বাঙালির শেষ হয়েও অশেষ গল্প হিসেবে। বাঙালির মহত্তম এই ছোট গল্পের পাঠ চলবে নিরন্তর।
স্বভাবতই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাঙালি কথাসাহিত্যিকেরা অসংখ্য গল্প লিখেছেন। উপন্যাস, নাটক, চিত্রকলাসহ শিল্পকলার অন্যান্য শাখাতেও বঙ্গবন্ধু একইভাবে উপস্থিত আছেন। তবে এই লেখায় তাকে নিয়ে আমাদের কথাসাহিত্যিকদের লেখা ছোটগল্পগুলোর সরল বিশ্লেষণ হাজির করে তাকে স্মরণ করতে চাই।
বাঙালির মহত্তম এই ছোট গল্পের পাঠ চলবে নিরন্তর। স্বভাবতই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাঙালি কথাসাহিত্যিকেরা অসংখ্য গল্প লিখেছেন। উপন্যাস, নাটক, চিত্রকলাসহ শিল্পকলার অন্যান্য শাখাতেও বঙ্গবন্ধু একইভাবে উপস্থিত আছেন।
হয়তো বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিপুল সংখ্যক ছোট গল্প লিখেছেন কথাসাহিত্যিকেরা। সব ক’টি গল্প পড়ে ফেলার প্রবল আকাঙ্ক্ষা থাকলেও বাস্তব কারণেই তা হয়ে ওঠেনি। ‘নান্দনিক বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামে আমি যে গবেষণা-নির্ভর কাজটি করছি তার সুবাদে যে ছোট গল্পগুলো পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে তা থেকে বেছে বেছে ছয়টি নিয়ে কথা বলতে চাই এখানে।
প্রথমেই যে গল্পটির কথা মনে আসে তা শওকত ওসমানের। নাম ‘দুই সঙ্গী’। এটির কথা সবার আগে বলছি কারণ শওকত ওসমান গল্পটি লিখেছেন একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে। সত্য ঘটনাটি লিখে গেছেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে। ঘটনা ১৯৪৯ সালের।
তরুণ বয়সেই ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠা শেখ মুজিব কাজী আলতাফ হোসেনকে সঙ্গে করে গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগের কনভেনশন শেষে নৌকায় যাচ্ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ঘুমন্ত থাকা অবস্থাতেই নৌকায় জলদস্যুরা হামলা করে। কিন্তু ঐ নৌকায় বঙ্গবন্ধু আছেন জানার পর জলদস্যুরা ফিরে যায়।
এই সত্য ঘটনাকেই সাহিত্যের রঙ দিয়ে লিখেছেন শওকত ওসমান। উদ্দেশ্য-পূর্ব বাংলার সব স্তরের মানুষের কাছে তরুণ বয়সেই শেখ মুজিব কেমন গ্রহণীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন তা তুলে ধরা। তাই তো গল্পে দেড় ঘণ্টা ধাওয়া করে নৌকাটি ধরতে পারার পরে জলদস্যু যখন মাঝির কাছে জানতে পারে যে নৌকায় শেখ মুজিব আছেন, তখনই মাঝিকে আঘাত করে রাগতস্বরে বলে ওঠে—‘খামাখা দেড় ঘণ্টা মেহনতি করাইলি-হারামজাদা।’
আমার কাছে মনে হয়েছে আমাদের কবিতায় বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের বহুমুখিতা নিয়ে অনেক কাজ হলেও ছোট গল্পের ক্ষেত্রে বেশি মনোযোগের জায়গায় থেকেছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হারানোর বেদনা আর অপরাধবোধটুকুই। এই প্রসঙ্গে প্রথমেই বলতে হয় আবুল ফজলের লেখা ‘মৃতের আত্মহত্যা’র কথা।
আমার জানা মতে, এটিই সম্ভবত বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা প্রথম ছোট গল্প (৩ নভেম্বর ১৯৭৭ সাহিত্য সাময়িকী ‘সমকাল’-এ প্রকাশিত)। এই গল্পের প্রোটাগনিস্ট সোহেলী একজন সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী। ওই সেনা কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুর হত্যা ষড়যন্ত্রে অংশ নেওয়ায় পরবর্তী অবৈধ সরকার তাকে বিদেশে কূটনৈতিক মিশনে পদোন্নতি দিয়েছিল। কিন্তু তার স্ত্রী সোহেলী পুরো দেশের প্রতিভূ হয়েই যেন সম্পূর্ণ গল্প জুড়ে অপরাধবোধে ভুগেছে। শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার মাধ্যমেই সেই অপরাধবোধ থেকে মুক্তি মেলে সোহেলীর।
বঙ্গবন্ধুকে যে তারিখে হত্যা করা হয় সেই ১৫ আগস্টের ঘটনাবলি নিয়েও ছোটগল্প লিখেছেন আমাদের বরেণ্য কথাসাহিত্যিকেরা। বঙ্গবন্ধু শহীদ হওয়ার ঠিক আগে বা পরে আশেপাশের ঘটনাকেই তারা গল্পের উপজীব্য করেছেন। কোনোটিই পুরোপুরি সত্য ঘটনা অবলম্বনে নয় হয়তো। তবু এই দেশের আলো-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা আর বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসা এই কথকদের লেখনীতে গল্পগুলোও যেন হয়ে উঠেছে একেক টুকরো ইতিহাস।
ইমদাদুল হক মিলন তার গল্প ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’-এ বর্ণনা করেছেন বঙ্গবন্ধুপ্রেমী প্রান্তিক কৃষক রতনের কথা। এই রতন তার এক চিলতে জমিতে যে চিড়ে হয়েছিল তা বঙ্গবন্ধুকে দিতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা তাকে সন্দেহবশত লকআপে আটকে রাখেন রাতে। সেই রাতেই মারা যান বঙ্গবন্ধু।
পরদিন সকালে থানার অফিসার রতনকে ছেড়ে দিয়ে বলেন—‘তার (বঙ্গবন্ধুর) খুব ঘনিষ্ঠ লোকজন, নেতার আদর্শে বিশ্বাসী, একই রাজনীতি দীর্ঘদিন করেছে এমন কেউ কেউ ষড়যন্ত্র করে নেতাকে হত্যা করেছে। তোমার ওপর আমি অবিচার করেছি, ভাই। যাও, বাড়ি যাও।’ বাংলার অভাজনরা বঙ্গবন্ধুকে বরাবরই ভালোবেসেছেন, তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছেন অভিজনেরাই—এই বার্তাটিই মিলন দিতে চেয়েছেন বলে মনে করি।
বঙ্গবন্ধু হত্যায় প্রতিবাদী বাঙালির প্রতিক্রিয়াকে গল্পের বিষয় করেছেন আমাদের অগ্রণী সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক। তার ‘নেয়ামতকে নিয়ে গল্প’-তে দেখি ভবিষ্যদ্বক্তা হিসেবে খ্যাত নেয়ামত গ্রামের ভালো ছাত্র মোতাহার সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে যে সে (মোতাহার) ভবিষ্যতে লাল দালানে মালির কাজ করবে
সকলের কাছে বিষয়টি অবিশ্বাস্য ঠেকে। অথচ বাস্তবে তাই ঘটে। মোতাহার ভালোভাবে পাস করে কলেজে ভর্তি হলেও বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করায় তাকে জেলে গিয়ে গাছে পানি দেওয়ার কাজই করতে হয়। তখন ভবিষ্যদ্বক্তার কাছে মোতাহার জানতে চায়—কেন সে আগেই বলেনি যে বঙ্গবন্ধুকে খুন করা হবে? একই প্রশ্ন প্রতিটি বঙ্গবন্ধুপ্রেমীকেই তাড়া করে ফেরে আজও।
আমাদের মুক্তচিন্তা বিকাশের সংগ্রামের অগ্রণী চিন্তক হুমায়ুন আজাদ নিশ্চয় বঙ্গবন্ধুকে হারানোর মাধ্যমে বাংলাদেশের ‘অদ্ভুত উটের পিঠে’ যাত্রায় ভীষণ সংক্ষুব্ধ ছিলেন। তাই ‘জাদুকরের মৃত্যু’ শিরোনামে বঙ্গবন্ধু শহীদ হওয়ার পরবর্তী বাংলাদেশের চিত্র তুল ধরতে লিখেছেন—‘আমরাও আবার ময়লা হয়ে উঠলাম … স্বপ্ন দেখা ভুলে গেলাম আমরা। আমরা বেঁচে রইলাম, তবুও বেঁচে রইলাম না; আমরা মরে যাইনি, তবু আমরা বেঁচে নেই।
সবশেষে বলতে চাই রশীদ হায়দারের লেখা গল্প ‘শেষটাই সত্য’র কথা। এখানে দেখা যায় মধুমতি নদীর পাড়ের মানুষ হঠাৎ আবিষ্কার করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তার লাশ কবর দিতে সেইখানে হাজির হয়েছে কিছু সামরিক লোকজন। ওই হতবিহ্বল অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধুকে কবরস্থ করার কাজ করতে থাকে তারা। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে কফিন থেকে উঠে দাঁড়ান বঙ্গবন্ধু। রশীদ হায়দার এভাবে লিখেছেন—‘কথা বলতে বলতে উঠে দাঁড়ান মুজিব। দেখে অফিসার, সঙ্গী অফিসার ও সেপাইরা, ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় লাগায় থানার দিকে … বঙ্গবন্ধু চিৎকার করে শুধু বলেন—আমার বাড়িতে ওরা প্রথম এলো, কিন্তু কিছু না খেয়েই চলে গেল?’
পুরোটাই গল্পকারের কল্পনা-সন্দেহ নেই। কিন্তু রূপক হিসেবে কী অসাধারণ! বঙ্গবন্ধুকে সশরীরে আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলেও শেষ পর্যন্ত তিনি তো ফিরে এসেছেন আমাদের জাতীয় চেতনায়। অপশক্তি তো সত্যিই পালিয়ে বাঁচতে চাইছে। তাই হায়দারের শিরোনামটিও যুতসই হয়েছে।
এই শেষটাই তো সত্য। বঙ্গবন্ধু আছেন, থাকবেন। কেননা প্রকৃতিও যে তাকে স্মরণ করে নিরন্তর। প্রতিদিন তিনি নতুন এক কবিতা হিসেবে উদ্ভাসিত হন বাংলাদেশের সবুজ প্রকৃতির মাঝে। মহাদেব সাহার ভাষায়—‘মুজিব গোলাপ হয়ে ফোটে, লালপদ্ম হয়ে ফোটে / হৃদয়ে হৃদয়ে;’। নিঃসন্দেহে তিনিই বাংলাদেশের হৃদয়। বাঙালির গর্বের ধন।
ড. আতিউর রহমান ।। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর