বিদায়, বন্ধু আজাদ


মহসীন কাজী : কয়েকদিন ধরে ঘুমের ঘোরে কাঁদি আর কাঁদি। দিনরাত চোখে ভাসে তার চেহারা৷ মনে পড়ে নানা স্মৃতি। সুখ স্মৃতি তেমন নেই, সবই কষ্টের-চেষ্টার। এ কষ্ট, চেষ্টা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার, কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছার। সাংবাদিকতা পেশায় ঘুরে দাঁড়াবার। সুখের নয়, দুঃখের স্মৃতি; তাই কল্পনায় আসতেই চোখ ভিজে যায়। একা, নির্জনে চোখ ভেসে যায় আমার। নিজে নিজেই কাঁদি। স্বপ্নের মধ্যেও কেঁদে যাই। কাঁদতে কাঁদতে বালিশ ভেজাই।

যার জন্য কাঁদি, কেঁদে যাই, সে আমার বন্ধু; আজাদ তালুকদার। সে আজ অনেক দূরে, পরপারে।

রাঙ্গুনিয়ার উত্তর পদুয়া নামের নিভৃত পল্লীর মসজিদের পাশে যখন তাকে চিরঘুমে শুইয়ে দেওয়া হচ্ছিল, পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম আমি। সন্ধ্যা নামেনি তখনও। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ, কালো মেঘ জানান দিচ্ছিল প্রকৃতিও শোকাচ্ছন্ন। স্বজন, বন্ধু, সহকর্মী আর এলাকার মানুষের মতো প্রকৃতিও যেন শোকে নিথর। এমন শোকাবহ পরিবেশে ধর্মীয় রীতিনীতি অনুযায়ী কিছুক্ষণের মধ্যে সে হয়ে গেলো কবরবাসী। পরপারের বাসিন্দা।

আজাদকে কবর দেওয়ার পুরো প্রক্রিয়া যখন প্রত্যক্ষ করছি তখন আমি যেন নিথর, বোবা। এ শহরের এমন অলিগলি খুব কমই আছে, যেখানে তার সাথে জুটি হয়ে মাড়াইনি। আমি দাঁড়িয়ে দেখছি আর সে যাচ্ছে অনন্তকালের পথে। ভাবতেই বুকের ভেতরে ক্ষরণ শুরু হয়। হৃদয় ছিঁড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছিল। কল্পনায়, ভাবনায় শুধু আজাদ আর আজাদ।

১৯৯৫ সাল। তখন সাপ্তাহিক পত্রিকার রমরমা অবস্থা। দৈনিক রূপালীর চট্টগ্রাম ব্যুরোতে কাজ করলেও আমার পরিচিতি সাপ্তাহিক আজকের সূর্যোদয়’র রিপোর্টার হিসেবে। তখন আজকের সূর্যোদয় প্রচার সংখ্যায় শীর্ষে। প্রতি সপ্তায় ছাপা হতো আমার বাইনেম রিপোর্ট। সূর্যোদয়ের রমরমাকালে একদিন পরিচয় আজাদের সাথে। পরিচয়ের সূত্র জুবায়ের ভাই (জুবায়ের সিদ্দিকী)। আজকের সূর্যোদয়ের পুরাতন গীর্জার অফিসে এক সন্ধ্যায় জুবায়ের ভাই আমার বয়সী এক লিকলিকে চিকন লম্বা, শ্যামবর্ণের তরুণকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ওর নাম আজাদ হোসেন তালুকদার, লেখালেখি করে, তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। পরিচিত হলাম। কুশল বিনিময় হলো। জুবায়ের ভাই চা, নাস্তা খাওয়ালেন।

কিছুক্ষণ কথার পর জানলাম, তার বাসা চকবাজারের কে বি আমান আলী রোডে। আমি জানালাম, আমরা থাকি গণি কলোনি এলাকায়। সে বললো, তাহলে আমরা একসাথে চকবাজার যেতে পারবো। তার কথায় ছিল অন্যরকম আন্তরিকতা। ফেরার পথে একসাথে বের হই। হাঁটতে হাঁটতে আন্দরকিল্লা পর্যন্ত আসতে আসতে আরও অনেক কথা হলো। তারপর এক টাকা ভাড়ার টেম্পুতে চকবাজার গেলাম। সেখান থেকে ধুপির পোলে এসে আমি গেলাম ডানদিকে। আজাদ গেলো সোজা।

আমাদের কথার শুরু হয়েছিল, আপনি সম্বোধনে। ধুপির পোল থেকে দু’জন দুদিকে যাওয়ার আগে তাকে বললাম, ভাই আমরা একই বয়সী, সমান। আপনি বলার দরকার নেই। যাওয়ার আগে একে অপরের বাসার ঠিকানা বিনিময় করি। তার ব্যবহারে মুগ্ধ আমি। কথায় সে কী আন্তরিকতা। ঘণ্টাখানেকের আলাপচারিতায় অন্যরকম টান অনুভব করেছি।

পরদিন সকাল বেলা সে দেখি হাজির, আমার বাসায়। বেরিয়ে কথা বলতে বলতে আমি চলে যাই কে বি আমান আলী রোডে। আবদার করে তাদের বাসায় যাওয়ার। মেইন রোড থেকে ডানে একটা একতলা বাড়িতে থাকত তারা। বাসায় পরিচয় হয় তার বাবা, মায়ের সাথে। গরম গরম চা দেওয়া হয় আমাকে, সাথে বিস্কুট। অনেকক্ষণ ছিলাম। আজাদ জানাল তার বিস্তারিত। তখন তার মা, বাবা ছাড়াও ওই বাসায় থাকত তার প্রবাসী বড় ভাইয়ের স্ত্রী এবং সফল নামে ছোট্ট এক ভাতিজা। ছোট্ট সফলও আমার কাছে এসে ভাব জমিয়ে ফেলে এরইমধ্যে।

আজাদ তখন লেখালেখিতে হাত পাকাচ্ছিল, সে সময়ের আরেক জনপ্রিয় সাপ্তাহিক চিত্রবাংলায়। লিখত আরও নানা ম্যাগাজিনে। আমার রিপোর্টের শিরোনাম যখন সূর্যোদয়ের প্রচ্ছদে যেত, তখন আজাদের প্রতিবেদনের শিরোনাম যেত চিত্রবাংলার সচিত্র প্রচ্ছদে। পাশাপাশি আমি লিখতাম স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিকের ফিচার পাতায়, কখনো শিশুদের পাতায়। অবিরাম চলছিল আমাদের লেখালেখি। সেই পরিচয়ের পর আমার সাথে যোগাযোগ, ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। সম্পর্ক গড়ায় পরিবার পর্যন্ত। তুমি থেকে কখন যে তুইতে চলে আসি তাও মনে নেই। এমনও সময় গেছে আমাদের প্রতিদিন দেখা হতো, কথা হতো।

আমাদের যোগাযোগ, সখ্যতা, বন্ধুত্ব সবকিছুর যোগসূত্র লেখালেখি। তার হাতের লেখা দেখে বিস্মিত হতাম। মুক্তার মতো লেখা। শব্দগঠন আর বানান জ্ঞান ঈর্ষণীয়। একজন সাংবাদিকের জন্য যেসব গুণ অপরিহার্য, তা তার মধ্যে ছিল। আজাদের প্রতি আমার আকর্ষণের মূল কারণ ছিল তার পাণ্ডিত্য, জানাশোনা ও পড়ার আগ্রহ।

এখন যেভাবে বিট ভাগ করে রিপোর্টিং হয়, তখন তা ছিল না। একজন রিপোর্টার কিংবা সংবাদ প্রতিনিধিকে সব বিষয়ে লিখতে হতো। খেলাধুলা থেকে রাজনীতি, অপারধ, বিনোদন, নাগরিক সমস্যা সবকিছুই লিখতে হতো। আজাদ সবকিছুতে পারদর্শী ছিল। রিপোর্টিংয়ের জন্য আমি আর সে মাড়াইনি চট্টগ্রাম নগরীর এমন কোনো ওয়ার্ড নেই। দু’জন একসাথে যাইনি এমন কোনো রাজনৈতিক নেতার বাসা নেই। কারণ তখন নেতাদের বড় বড় সাক্ষাৎকার ছাপা হতো সাপ্তাহিকগুলোতে। পুলিশ কমিশনার, ডিআইজি, এসপি, ডিসি, ওসি— প্রায় সকলের পরিচিতমুখ ছিলাম আমরা।

লেখালেখির কারণে অল্পদিনে আজাদের পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে আমাদের অঙ্গনে। তখনকার দিনে তরুণদের মধ্যে সাইফুল ইসলাম শিল্পী, রিয়াজ হায়দার, মান্নান মেহেদী, তুষার হায়াত, দিলীপ তালুকদার, রফিক উদ্দিন চৌধুরী, আহমদ আলী চৌধুরীদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে আজাদের। মাঝে মধ্যে আড্ডায় মেতে উঠতাম আমরা।

আজাদ আর আমি উভয়ে উভয়ের নানার বাড়ি, মামার বাসা, বোনদের বাসাবাড়িতেও যেতাম। উভয়ের পরিবারের সদস্যরা আমাদের দু’জনকে চেনেন। তাদের বাসার গরুর মাংস আমার পছন্দের ছিল। তাই বাসায় মাংস রান্না হলে আজাদ আমাকে নিয়ে যেত। আর আমি এমনিতে গেলে ভালো রান্না হলে খালাম্মা বলতেন, ‘অ’পুত খাই যাইচ’।

আজাদের বাবা ছিলেন বৃটিশ আমলের ইন্টারমিডিয়েট পাশ। কথাবার্তায় ছিলেন স্মার্ট। কথার মাঝে নির্ভুল ইংরেজি শব্দ জুড়ে দিতেন। আর মাঝে মাঝে ভুল ধরে বসতেন। প্রশ্ন করতেন। আমাকে দেখলে বলতেন, ‘হাম্বাদিকোর ছা আইস্যি’। তার মা ছিলেন মমতাময়ী। সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে।

ওদের নানার বাড়িতে গিয়ে গুনেছি তার নানার নামে বিশাল আয়োজনে ‘বলী খেলা’ হতো। একদিন আজাদকে খালাম্মা একটি ব্যাংকের চেক দেন নিজ হাতে লিখে। প্রথমে ভাবলাম বয়স্ক মানুষ, কী লিখবেন। লেখার পর আশ্চর্য হলাম। এ বয়সেও এত সুন্দর হাতের লেখা। স্বাক্ষরের ঘরে নিজের নাম ‘জাহান আরা বেগম’ লিখে দেন স্পষ্টাক্ষরে। আমি বললাম, খালাম্মা আমার মা ‘আলম আরা বেগম’ লিখেন আপনার মতো করে। তারপর বললেন, ‘তোঁয়ার মা ত আঁর ভইন’।

আজাদ শোনার পর বললো, তোর মায়ের নাম আর আমার মায়ের নামেও মিল দেখছি। একদিন আমাদের বাসায় গেলে আমার মাকেও বলে সে কথা। সে আমার মাকে পরম মমতায় খালা ডাকত। আমার বড়ভাইকে নিজের ভাইয়ের মতো জানত। আমার বড়বোনদের শ্রদ্ধা করত ওর বোনদের মতো। আমার ছোট ভাইবোনের সাথেও ছিল তার সুসম্পর্ক। আমার বড়ভাই এবং ছোটবোন তার পত্রিকায় প্রায়ই লিখত। আমার বাবার সাথেও ভাব জমিয়ে ফেলে। আমার বাবা অফিস থেকে ফেরার পর কোনোদিন আজাদ বাসায় গেলে দেশের এবং স্থানীয় রাজনীতি নিয়ে তারা আলাপ জুড়ে দিত।

আমাদের বাসায় এলে খাবার সময় হলে আমার মা বলতেন, ‘আজাদ তোরে কিছু ন দির। সময় হইয়্যি ভাত খায় ফেলা’। সে বলতো, ‘খালা- বেশি কষ্ট ন গইজ্জোন প্লেটত তরকারি দি দন’। আমি আর সে খেয়ে বের হওয়ার সময় বলতো, ‘তোর মা অডা আঁর মার মত। ক্যানে জানে আত্তে ভোগ লাইগ্যে।’

অনেক আগে রাঙ্গুনিয়ায় আজাদের সাথে গিয়েছিলাম তার নানাবাড়ি। ভরদুপুরে গিয়ে পৌঁছি আমরা। তার বড় মামি সম্ভবত শিক্ষক ছিলেন। তিনি কয়েক মিনিটের মধ্যে আমাদের ভাত দেন। তরকারি ছিল বড় বড় আলুর টুকরো, অর্ধেক করা সিদ্ধ ডিম। আর ডাল। অনেকদিন পর আজাদদের বাসায় ওই মামির সাথে দেখা হয়। তিনি আমাকে চিনতে পারছিলেন না, যখন বললাম ওই তরকারির কথা। তিনি বললেন, এত বছর পরও তোমার মনে আছে। আকবর মামাকে এখনও সে কথা বলে ক্ষ্যাপাই। ক্ষ্যাপাতে ক্ষ্যাপাতে আকবর মামার স্ত্রী অর্থ্যাৎ ছোট মামি (হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক) আমি আর আজাদকে কয়েকবছর আগে দাওয়াত দেন। মামি গরুর নলা, কলিজা, কালো ভুনা থেকে শুরু করে অন্তত ১০ পদ দেন টেবিলে। খাওয়ার পর আজাদ বলে, ‘অডা মামুরে আর কিছু ন কইচ’।

আমার ছোট মামা বীর মুক্তিযোদ্ধা, নৌকমান্ডো আবু মুছা চৌধুরী একাত্তরের ২ অক্টোবর কর্ণফুলীতে তেলবাহী বিদেশি জাহাজ এমটি অ্যাভলুজ ধ্বংসের অপারেশনে গিয়ে মাথায় আঘাত পান, রক্তক্ষরণ হয়। সেই ক্ষরণের কারণে তিনি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডাক্তাররা বলেছেন, আমেরিকায় গেলে উপযুক্ত চিকিৎসা সম্ভব। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান সবাই। তখন মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমানের পরামর্শে মামার বীরত্ব তুলে ধরে গণমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে ‘মানবিক স্টোরি’ করার উদ্যোগ নিই। সেই স্টোরি লেখায় আমার সাথে মামার বাসায় রাতদিন পরিশ্রম করে আজাদ। আমাদের দু’জনের পরিশ্রমে লেখা মানবিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়ায়। তখন ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়া ছিলো না। একের পর এক পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে বিষয়টি সরকারের উচ্চ মহলের নজরে আসে। তৎকালীন সরকারের মন্ত্রী, এমপি, আত্মীয়-স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের সহায়তায় তিনি আমেরিকায় যান। চিকিৎসায় তিনি অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেন।

২০০৫ সালে আমেরিকা থেকে দেশে ফিরেন আমার ছোট মামা। দেশে আসার কয়েকমাসের মধ্যেই আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। দেশের ডাক্তাররা বলেছিলেন, তিনি চিকিৎসা শেষ না করে আমেরিকা থেকে চলে এসেছেন। তাঁকে আবার আমেরিকা যেতে হবে। ডা. মাহফুজুর রহমানের পরামর্শে আবার লেখালেখি শুরু করি। আবারও আমার পাশে আজাদ। তাকে ফের সহযোগিতার কথা বললে প্রথমে সে বলে, ‘তোর মামিরা হারামি। গতবার আমি এত কষ্ট করলাম, তিনি কোনোদিন খোঁজখবর নেননি। দেশে এসেও খোঁজ নেননি কেমন আছি’। আমার অনুরোধে সে আবার সহযোগিতা করতে রাজি হয়। তাকে বললাম, সব মানুষ সমান না। কেউ কৃতজ্ঞ হয়, কেউ ভুলে যায়। তখনও আজাদ আমাকে মামার চিকিৎসা কাজে সহযোগিতা করে। তিনি আমেরিকায় গিয়ে ফের চিকিৎসা করান। দেশে এসে গতবছরের ৮ জুলাই তিনি মারা যান। তখন আজাদ গুরুতর অসুস্থ। ভারতে চিকিৎসাধীন। পরে আমার মামার মৃত্যুর খবর শুনে সে মর্মাহত হয়।

বার্তাসংস্থা ইপিবি হয়ে আজকের কাগজে আসার পর আজাদের সাথে আগের মতো যোগাযোগ হত না। সে সান ফিচার সার্ভিসে কাজের পাশাপাশি ব্যবসায় মনোযোগ দেয় কিছুদিন। সেখানে তার মন টেকেনি। ২০০৪ সালের দিকে চেরাগী পাহাড়ে সালমা ভবনের নিচে ছোট্ট একটি অফিস নেয়। একদিন আমাকে ফোন করে নিজেই সে খবর জানায়। সাথে সাথে আমি যাই তার খোঁজে। ছোট্ট অফিসটিতে একটা টেবিল আর কয়েকটি চেয়ার নিয়ে শুরু করেছে। বলল, তার নিজের প্রতিষ্ঠান ‘একুশে বাংলা’র নাম পরিবর্তন করে ‘একুশে পত্রিকা’ করেছে এবং রেজিস্ট্রেশন পেয়েছে। এখন থেকে নিয়মিত একুশে পত্রিকা প্রকাশ করবে আর সান ফিচারে কাজ চালিয়ে যাবে। পাশাপাশি টুকটাক প্রিন্টিংয়ের কাজ করবে।

আমার অফিস সময়ের বাইরে চেরাগী পাহাড়ে তার অফিসটি হয়ে উঠে অবসর আড্ডার কেন্দ্র। তার অনুরোধে একুশে পত্রিকায় লিখতাম, প্রতি সংখ্যায়। অল্প দিনে মিশুক আজাদ তার বিনয় ব্যবহার দিয়ে আমাদের বন্ধুদের অনেকের প্রিয়জন হয়ে উঠে। আমাদের আড্ডার সারথী বাড়তে থাকে দিনে দিনে। তার পত্রিকা তথা ব্রেইন চাইল্ড একুশে পত্রিকা গুণে মানে স্বকীয় অবস্থান গড়ে তোলে। পত্রিকার সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি বাড়তে থাকে সংবাদের গুণমান।

২০০৫ সালে চট্টগ্রামের তরুণ সাংবাদিকদের নিয়ে প্রকাশিত একুশে পত্রিকার সংখ্যাটি সুধী মহলে ব্যাপক প্রশংসিত হয়। ‘তারুণ্যের আয়না’- শিরোনামের সংখ্যায় যাদের সাংবাদিকতার গল্প তুলে ধরা হয়, তারা প্রত্যেকেই এখন স্ব স্ব অবস্থানে থেকে সাংবাদিকতা পেশায় আলো ছড়াচ্ছেন। মাঝে একটি দুর্ঘটনা কঠিন পরীক্ষায় ফেললেও কঠোর শ্রম আর অধ্যবসায় তাকে থামাতে পারেনি। আবারও ঘুরে দাঁড়ায় আমাদের আজাদ।

যত বাধাই আসুক, লক্ষ্য অটুট থাকলে জীবনে সাফল্য আসবেই— তার জ্বলন্ত উদাহরণও আজাদ। সে তার ব্রেইন চাইল্ড একুশে পত্রিকাকে মাসিক থেকে পাক্ষিক। আবার পাক্ষিক থেকে সাপ্তাহিকে এনে আরও উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করেছে। অনলাইন সংস্করণের চমক আরও দ্রুত। নিবন্ধন পেয়ে নিজের একক মেধায় একুশে পত্রিকাকে দেশের অন্যতম সেরা প্রতিষ্ঠানের কাতারে নিয়ে গেছে।

ওদিকে একুশে টিভি থেকে বৈশাখী টেলিভিশন হয়ে একাত্তর টিভিতে কাজ করে নিজের টেলিভিশন সাংবাদিকতায় যোগ্যতা প্রমাণ করতে সক্ষম হয় আজাদ। প্রিন্ট এবং অনলাইন সাংবাদিকতার পাশাপাশি টেলিভিশন সাংবাদিকতায় সামগ্রিকভাবে সেরাদের সেরা প্রমাণে সক্ষম হয়েছে সে। টিভি সাংবাদিকতায় উচ্চারণের জড়তা দূর করতে পরিণত বয়সে এসে আবৃত্তি ক্লাসে পর্যন্ত ভর্তি হয়েছে।

আমাদের সাংবাদিকদের মধ্যে আজাদের মতো প্রতিভা বিরল। সে গণমাধ্যমের সব শাখায় মেধার স্বাক্ষর রেখেছে। প্রিন্ট, অনলাইন ও টিভি- তিন মিডিয়ার কাজে সমান দক্ষ ছিল। একটি পত্রিকা প্রকাশের জন্য যা প্রয়োজন সব কাজ ছিল তার নখদর্পনে। পত্রিকার অঙ্গসজ্জা, ডিজাইন, পেস্টিং সবই জানত সে। এসব কাজ সে একাই করে একুশে পত্রিকাকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। বলতে গেলে সে ছিল একুশে পত্রিকার সম্পাদক, প্রকাশক, সহ-সম্পাদক, রিপোর্টার, সম্পাদনা সহকারী, কম্পিউটার অপারেটর, গেটআপ মেকআপকারী, পেস্টার, ডিজাইনার সর্বোপরি বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন ম্যানেজার। আজাদের মতো এমন সাংবাদিক, সম্পাদক ও প্রকাশক বিরল।

লেখক, প্রবন্ধকার ও গল্পকার হিসেবেও সে মেধার বিচ্ছুরণ ঘটিয়েছে। রিপোর্টার হিসেবে দেখা নানা ঘটনা, ঘাত-প্রতিঘাত আর অপ্রকাশিত কাহিনি নিয়ে লেখা বই ‘রিপোর্টারের ডায়েরি’ (প্রকাশকাল ১ সেপ্টেম্বর, ২০২০), বিখ্যাত আর সফলদের সাফল্যগাঁথা নিয়ে লিখেছে ‘স্বপ্নফেরি’ (প্রকাশকাল ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২) আর এক হৃদয়স্পর্শী বাস্তব ঘটনার গল্পরূপ দিয়েছে ‘নিগৃহীত সুন্দর’ (প্রকাশকাল ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩) বইয়ে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় বইগুলো যখন প্রকাশ হয় তখন সে মরণব্যাধির সাথে লড়ছিল। বইগুলোর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বর্ণনা’র স্বত্বাধিকারীও সে। আজাদের ইচ্ছে ছিল বড় করে তার বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠান করবে, তাও হল না।

সাংবাদিকতায় আজাদের মতো প্রতিভা বিরল। এতক্ষণ যা লিখলাম তা বন্ধু বলে নয়, একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান। লেখা বরং কমই হবে, এ মুহূর্তে অনেক কিছুই মনে পড়ছে না। সময় করে তার মতো গুণীকে নিয়ে লিখতে গেলে আমি পুরো একটা বই লিখে ফেলতে পারব।

আমাদের দেশে স্ব স্ব ক্ষেত্রে অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে গুণীদের সম্মানিত করা হয়। এই বিচারে আজাদের সঠিক মূল্যায়ন যদি হয় সেও সাংবাদিকতায় রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি রাখে। সাংবাদিকতার প্রতিটি শাখায় তার অবদান দিবালোকের মতো স্পষ্ট। সে অকালে হারিয়ে গেলেও রেখে গেছে তার কর্মকীর্তি। এসব কীর্তি তাকে বাঁচিয়ে রাখবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।

আজাদ গত রমজানের পর মুম্বাই থেকে চিকিৎসা করে আসার পরও সাবলীল ছিল। এত অকালে হারিয়ে যাবে তা তার মনে প্রাণে ছিল না। মুম্বাই থেকে আসার পর আমার কাছে আবদার করেছিল মাইজভাণ্ডার শরীফের গাউছিয়া হক মঞ্জিলের সাজ্জাদানশীন মওলা হুজুরের (শাহসুফি হযরত সৈয়দ মোহাম্মদ হাসান) সাথে দেখা করার। সর্বশেষ মুম্বাই যাওয়ার আগে এসজেডএইচএম ট্রাস্টের অফিসে নিয়ে যাই তাকে। সেদিন প্রায় একঘণ্টা সময় দিয়েছিলেন মওলা হুজুর। আজাদ তার রোগ এবং চিকিৎসার যাবতীয় তুলে ধরে উনার কাছে দোয়া চায়। তিনি আজাদের মাথায় হাত রেখে দোয়া করেন। আজাদ উনার অনুমতি নিয়ে কদমবুসি করে।

পার্কভিউ হাসপাতালে সর্বশেষ কিমো দেওয়ার সময় হঠাৎ আমাকে কল দেয়। বলে, ‘মহসীন তুই কই। আঁই এখন পার্কভিউত কিমো দির’। আমি তার কথা শুনে আসতেছি বললাম। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব থেকে কয়েক মিনিটে আমি পৌঁছে যাই পার্কভিউতে। ইমার্জেন্সির একটা কক্ষে সে কেমো দিচ্ছিল। প্রথমে বাম হাতে ক্যানোলা লাগানো হয়, ব্যথা অনুভব করায় বরফ বক্স দেওয়া হয়। সে বলছিল, তার হাত জ্বলছে। কিছুক্ষণ পর এক নার্স এসে বললেন, আপনার কি ব্যথা হচ্ছে? সে লাগছে, বলতেই নার্স বললেন, ডান হাতে ক্যানোলা লাগানোর চেষ্টা করি। আজাদ সায় দেয়। নার্স ক্যানোলা লাগানো শেষ করে কেমোর সংযোগ দেয়। তারপর আজাদ বললো এখন জ্বলছে না, ভালো লাগছে। তারপরের কেমোর তারিখ ছিল ৩ জুলাই। নার্সকে অনুরোধ করলো সেদিনও যেন তিনি কেমোর জন্য ক্যানোলা লাগান।

কেমো চলছে, তখন তার পাশে ছিল ভাগিনা পাইলট। আমাকে পরিচয় করে দিয়ে পাইলটকে বললো, আমাকে যেন সে তার বক্তব্য শোনায়। পাইলট লজ্জা পায়। বলে, মামা আপনি সুস্থ হন, তারপর শোনাব। পাইলটকে দেখিয়ে দিয়ে আজাদ বলল, আমার ভাগিনা যুবলীগ করে- সুন্দর বক্তব্য দেয়। তারপর অনেক পুরনো কথার ঝাঁপি খুলল আজাদ। বলল, ‘তোর আর আমার বন্ধুত্ব সবচেয়ে পুরনো। তোকে আমার চেয়ে কেউ বেশি চেনে না। তুই এখনো থেকে গেলি সেরকম সহজসরল’। আমাকে একটা কথা প্রায়ই বলতো ‘তুই জাতে মাতাল তালে ঠিক। কখনো ঘরের অনিষ্ট করিসনি, নিজেরটাও নষ্ট করিসনি। মেপে মেপে চলেছিস’।

কথার ফাঁকে ওদের ঘরের অনেকের কথা বলতে বলতে জানতে চাইলাম, নিটনের বাবার (ওদের বড় দুলাভাই মনিরুজ্জামান মাস্টার) কথা। ও বলল, তোর পূর্বকোণের লেখা ঘরে বাঁধিয়ে রেখেছেন। একটা ফোন দে। অনেক আগে দুলাভাইকে পরিচয় না দিয়ে ফোন করে অনেক বিরক্ত করতাম। ফোন দিই দুলাভাইকে। এবারও পরিচয় দিইনি। একথা সেকথা বলে রেখে দিই। তিনি কিছুক্ষণ পর ওপ্রান্ত থেকে খুব নরম সুরে বললেন, ‘অভাই তুই কন, পরিচয় দে’। আমি নিরব থাকলাম। আজাদ হাসলো। আজাদ বলল, রাতে ঘুম হবে না। দুলাভাই আজাদের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। তাদের ঘরের ছোটবড় সবাইকে পড়িয়েছেন। তারা উনার সাথে ঠাট্টা মশকরা তো করেইনি। বরং শিক্ষক হিসেবে শ্রদ্ধা করে। সে সময় সুযোগ হলে আমাকে লাগিয়ে দিয়ে মজা নিত।

আজাদদের এই মনু স্যার আমাকেও পছন্দ করেন। আজাদের মতো করে আমাকেও তুই সম্বোধন করেন। আজাদের আরেক দুলাভাই ছিল বড় আলেম (সাইফুল ও সৌরভের বাবা)। তিনি কয়েকবছর আগে মারা গেছেন। তাঁকেও আজাদরা সমীহ করত। সাইফুলের মৃত্যুর পর তার মেজ আপার আহাজারির কথা মনে পড়লে এখনো আমার কলিজা মোচড় দিয়ে উঠে। অকালে মারা যাওয়া তার বড় আপার ছেলে নিটন ছিল আমাদের বন্ধুর মত। একটা শিশুসন্তান রেখে যাওয়া নিটনের মৃত্যুর পর আজাদ অনেক কেঁদেছে। একবার নিটনের শ্বশুরের বাসায় দাওয়াতে যাই আমি আর আজাদ। মনে হয় কোথাও বেয়াই হিসেবে প্রথম এত কদর পেয়েছি। এসব রোমন্থন করতে করতে মধ্যরাত আড়াইটায় শেষ হয় আজাদের কেমো। তার আগে কথা বলতে বলতে সময় কোনদিকে চলে যায় ভাবতেই পারিনি।

আজাদ একান্ত কথায় তার পরিবারের ভাতিজা, ভাতিজি, ভাগিনা, ভাগনিদের কথা বলতো। আমাদের বন্ধুত্ব শুরুর কালে দেখা সেই ছোট্ট সফল নাকি চবি থেকে এমবিএ শেষ করে এখন কর্পোরেট জব করে। তার মেজ আপার ছেলে সৌরভ, তাকেও শিশু অবস্থায় দেখেছি। সে এখন কুমিল্লা আদালতের সিনিয়র সহকারী জজ। তাদের পরিবারে ভাই-বোনদের প্রতিটি ছেলেমেয়ে মেধাবী এবং প্রতিষ্ঠিত। এক ভাগিনার গান আজাদের মোবাইলের ওয়েলকাম টোন ছিল। সে চবিতে সঙ্গীত বিভাগে পড়ত।

আজাদ অসুখের মধ্যে বেশি ভাবত তার একমাত্র ছেলে অর্ঘ্যকে নিয়ে। বলত, আমার ছেলের জন্য দোয়া করিস। ছেলেটা যাতে মানুষের মতো মানুষ হয়। আজাদ তার ছেলে ক্লাস ফাইভের ভর্তি পরীক্ষায় একসাথে চার স্কুলে টেকার খবর পেয়ে কী খুশি হয়েছিল, আমি দেখেছি। সম্প্রতি তাকে পাঠানো ছেলের লেখা এক হৃদয়গ্রাহী এসএমএস পড়ে শোনায় আমাকে। এটি পড়ার সময় সে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ে।

আড়াইটায় যখন হাসপাতাল থেকে ফিরি, তখন বলছিল— ৩ জুলাই আবার আসিস। কেমো দিয়ে ফেরার পর দু’দিন আমার সাথে তার স্বাভাবিক কথা হয়। তারপর হঠাৎ শরীরে প্রভাব পড়তে শুরু করে। ৩ জুলাইয়ের কেমো আর দিতে পারেনি। প্রস্তুতি শুরু করে আবার মুম্বাই যাওয়ার। মওলা হুজুরের কাছে যেদিন যাই তখনও তার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। মুম্বাইয়ে যাওয়ার আগের দিন ১২ জুলাই তার চন্দ্রনগরের বাসায় যাই আমি আর দেশ টিভির আলমগীর সবুজ।

দরজা খুলে আমাকে জড়িয়ে ধরে। তারপর আমাদের বসতে দিয়ে সে যায় এশার নামাজ পড়তে। আমিও নামাজ পড়বো বললে সে জায়নামাজ এগিয়ে দেয়। নামাজে আরও লোকজন আসে। সে এক ড্রাইভারকে পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে আরেক ড্রাইভার দিয়ে গাড়িটি অন্য জায়গায় রাখার জন্য পাঠাচ্ছিল। সে ড্রাইভারকে বুঝিয়ে দেয় কাগজপত্র। এত অসুস্থতার মধ্যেও সুনিপুণভাবে সবকিছুর তদারক করছিল। ইতিমধ্যে আমরাও বেরিয়ে আসি।

আসার সময় তুলে দেয় তার লেখা তিনটি বই। লিখে দেয় হৃদয় ছোঁয়া দু’লাইন। ফেরার সময় আবার জড়িয়ে রাখে কিছুক্ষণ। আজাদ বুঝেছিল, এ দেখাই শেষ। তাই হৃদয়ের সব আবেগ ছাড়িয়ে জড়িয়ে রেখে যেন মনে মনে বলেছিল, ‘হে বন্ধু, বিদায়!’

মহসীন কাজী : যুগ্ম মহাসচিব, বিএফইউজে- বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন।